সম্পর্ক এগিয়ে যাক পারস্পরিক স্বার্থ ও মর্যাদায়
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের একটা ঐতিহাসিক, কূটনৈতিক, ইমোশনাল, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। আরেকটু ছোট করে বললে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্কটা নাড়ির টানের। ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান একটি অভিন্ন রাষ্ট্র ছিল ভারত নামে। ব্রিটিশরা দুইশ বছরের শাসন শেষে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে ভেঙে দিয়ে যায়। সৃষ্টি হয় পাকিস্তান নামে এক অদ্ভুত রাষ্ট্রের।
ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল ১১০০ মাইল। কিন্তু মানসিক দূরত্ব ছিল হাজার কোটি মাইল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা সেই দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ তো নেনইনি বরং তাদের শোষণ, বঞ্চনা আর অবহেলায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে সৃষ্টি হয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম শেষে একাত্তরে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
এক সময়ের পূর্ববঙ্গ, পরের পূর্ব পাকিস্তান বদলে যায় স্বাধীন বাংলাদেশে। স্বাধীনতা অর্জনের পর পাকিস্তানের সৌজন্যের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও, তা বরাবরই শীতল রয়ে গেছে। কিন্তু ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কটা তেমন নয়। বাংলাদেশ আর ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ একসময় অভিন্ন বাংলা ছিল। ১৯০৫ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গ হয়। ১৯১১ সালে আবার বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। তবে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পুরোপুরি ভেঙে যায় বাংলা।
পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ হলেও পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্কটা এখনও রয়ে গেছে। দেশভাগের সময় বা পরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এপার বাংলা থেকে সংখ্যালঘুদের অনেকেই ভারতে চলে গেছেন বা চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যতই বাধ্য হন, তাদের শেকড় তো বাংলাদেশেই।
ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কটা কৃতজ্ঞতার। এই কৃতজ্ঞতা জন্মের। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের সরাসরি সহায়তা করেছে। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার পরিচালিত হয়েছে কলকাতা থেকে। ভারত আমাদের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, খাইয়েছে। তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দৃঢ় কূটনৈতিক পদক্ষেপ বাংলাদেশকে অনেক বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়। একাত্তরের এই অপরিসীম সহায়তা আমরা কোনোদিন ভুলিনি, ভুলবো না। এ ধরনের ক্ষেত্রে সাধারণত সৈন্যরা নতুন দেশে ঘাঁটি গেড়ে বসে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে প্রথম সুযোগেই ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠান।
এতকিছুর পরও ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কটা বরাবরই অম্লমধুর। বিশেষ করে ’৭৫-এর পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে যায় ভারত বিরোধিতা, কখনো কখনো তা অন্ধ ভারত বিরোধিতা। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভারতের মতো একটি বড় দেশের সাথে সম্পর্ক খারাপ রেখে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন।
ভারত শুধু সমৃদ্ধ ও বড় দেশ নয়, বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী। আর এটা তো সত্যি বন্ধু বদলানো যাবে, প্রতিবেশী বদলানো যায় না। কিন্তু স্বার্থটা যখন একতরফা হয়ে যায়, তখন সম্পর্কটা টেকসই হয় না। আমাদের যেমন ভারতকে দরকার, তেমনি ভারতেরও আমাদের দরকার।
একসময় ভারত বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে শান্তিবাহিনীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। আবার ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করেছে। আবার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় চট্টগ্রাম বন্দরে আটক হওয়া ১০ ট্রাক অস্ত্র তো ভারতেই যাচ্ছিল। তখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ছিল অবিশ্বাস আর সন্দেহের। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তখন ভারতের ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসের সাথে দারুণ বোঝাপড়া হয়। দুই দেশই নিজেদের স্বার্থটা বুঝে নিতে চেষ্টা করে। ফলে স্বস্তি আসে দুই দেশেই। কিন্তু কংগ্রেসকে হারিয়ে বিজেপি ভারতে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে সাময়িক অস্বস্তি তৈরি হয়। কারণ আওয়ামী লীগের সাথে কংগ্রেসের সম্পর্কটা ঐতিহাসিক।
সবার আশঙ্কা ছিল বিজেপি সেই সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে কি না। কিন্তু দুই দেশের স্বার্থটা বুঝতে সমস্যা হয়নি ক্যারিশমেটিক মোদীরও। সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও উষ্ণ এবং দ্বিপাক্ষিক হয়। দীর্ঘদিনের জিইয়ে থাকা ছিটমহল সমস্যা সমাধান দারুণ আশাবাদের সৃষ্টি করে। তবে এখনও বাংলাদেশের সাথে ভারতের সব সমস্যা মিটে যায়নি। সীমান্তে হত্যা, চোরাচালান, বাণিজ্য ঘাটতি তো আছেই; সবচেয়ে বড় সমস্যা তিস্তার পানি।
তবে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় সমস্যা ভারতের মানসিকতায়। এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন সুষমা স্বরাজ ভারতের সংসদে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির অনুমোদন দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হলে বাংলাদেশের এলডার ব্রাদার হতে হবে, বিগ ব্রাদার নয়। এটাই মূল কথা। কিন্তু সমস্যা হলো, ভারতের অনেকেরই আচরণ এলডার ব্রাদারসুলভ। ভারত আয়তনে, জনসংখ্যায়, সম্পদে সবকিছুতে আমাদের চেয়ে এগিয়ে। তবে বাংলাদেশও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশও অনেক এগিয়েছে। এমনকি অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সূচকে বাংলাদেশ এখন ভারতের চেয়েও এগিয়ে।
শুধু বড় প্রতিবেশী বলেই নয়, নানা কারণেই বাংলাদেশ-ভারতের একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক দুই দেশের জন্যই দরকার। বর্তমান সরকারের আমলে দুই দেশের সম্পর্ক অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছেছে, এটা যেমন ঠিক; আবার বাংলাদেশ চীনের সাথেও চমৎকার কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখছে।
একই সঙ্গে ভারত এবং চীনের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার যে ভারসাম্যের কূটনীতি, তাতে বাংলাদেশকে বেশ সফলই বলা যায়। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও ভারতের সমর্থন দরকার বাংলাদেশের। তারচেয়ে বড় কথা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বদলে যাওয়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং চাপের মুখে থাকা অর্থনীতি সামাল দিতে দুই দেশের পারস্পরিক সহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এমনই প্রেক্ষাপটে চারদিনের সফরে আজ ভারত যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে শীর্ষ বৈঠক ছাড়াও নানা কর্মসূচি রয়েছে শেখ হাসিনার। শীর্ষ বৈঠকে অন্তত পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে। মূল ইস্যু বাণিজ্য ঘাটতি কাময়ে আনা। জ্বালানি নিরাপত্তায় পারস্পরিক সহায়তার বিষয়টিও গুরুত্ব পেতে পারে আলোচনায়।
বিভিন্ন সময়ে অনেক কথা হলেও সীমান্ত সমস্যা পুরোপুরি মেটেনি। বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। এ বিষয়টি নিয়েও নিশ্চয়ই আলোচনা হবে। তবে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যু তিস্তার পানি বণ্টনে তেমন অগ্রগতির সুযোগ নেই। শেখ হাসিনার সফরকে সামনে রেখে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে কুশিয়ারার পানি বণ্টন নিয়ে অগ্রগতি হয়েছে। আপাতত হয়তো কুশিয়ারার পানিতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
তবে শীর্ষ বৈঠক বা কিছু সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হলো কূটনীতির সামনের অংশ। পর্দার পেছনেও থাকবে এই সফরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। দেড় বছর পর বাংলাদেশে এবং দুই বছর পর ভারতে জাতীয় নির্বাচন। দুই দেশের নির্বাচনেই পারস্পরিক সম্পর্কের একটা বড় প্রভাব থাকে। সেই রাজনীতি নিয়েও নিশ্চয়ই দুই নেতা কথা বলবেন।
ভারত একটি স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশও একটি স্বাধীন দেশ। আমাদের সম্পর্ক হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধার, ভালোবাসার, মর্যাদার এবং সর্বোপরি পারস্পরিক স্বার্থের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর থেকে যেন আমরা নিজেদের স্বার্থটা বুঝে নিতে পারি ষোলআনা।
৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম