বৈশ্বিক দুরবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

মাসুদ রানা
মাসুদ রানা মাসুদ রানা , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

মহামারি করোনাভাইরাসের আঘাতের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি এবং খাদ্যসামগ্রীর চড়া দামে বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের মতো ভুগছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষও। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, আমাদের অর্থনীতি কি আসলেই সংকটে আছে, নাকি বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কিছুটা চাপে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান এই অর্থনীতি?

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপের কারণে আমাদের অর্থনীতি কিছুটা চাপের সম্মুখীন হলেও আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি বলেই মনে করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আতঙ্কের কোনো কারণ নেই এবং অর্থনীতির ওপর থেকে চাপ কমাতে সব অংশীজনের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, এই চাপ কাটিয়ে উঠতে রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক বিনিয়োগে আমাদের নজর দিতে হবে। এসএমই ফান্ডিং সহজ করতে হবে। ঢাকা ব্যাংকের এমডি ও সিইও ইমরানুল হক বলেন, যে কোনো খাতে নিরবচ্ছিন্ন সাপ্লাই চেইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রতিটি খাত ঠিকভাবে চললেও বর্তমানে দেশের অর্থনীতির ওপর যে চাপ তার একটি বড় কারণ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার যেসব সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো আমাদের এখনো ভালো অবস্থায় রেখেছে।

দায়িত্বশীল সংবাদ প্রকাশে গুরুত্বারোপ করে ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও সিইও হুমায়রা আজিম বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ফরেন পোর্টফলিও ইনভেস্টমেন্টে বাংলাদেশের ফোকাস করার এখনই উপযুক্ত সময়। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বৈধপথে রেমিট্যান্স দেশে আসে। দেশের করদাতাদের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। এর পাশাপাশি বিশেষ নজর দিতে হবে কৃষিখাতেও, সরকারি ভর্তুকি দিতে হবে। আইডিএলসির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ জাভেদ নূর বলেন, আমাদের মৌলিক অর্থনীতিকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। করোনার সময় কিছুটা ডাউন হয়েছিল। কিন্তু তা শক্তভাবে আবার ফিরে এসেছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিবাচক দিক তুলে ধরেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসও। সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুরবস্থার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধও বলছে, আমাদের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের জায়গা এখনও সৃষ্টি হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অর্থনীতির তুলনায় যথেষ্ট ভালো অবস্থানে আছি আমরা।

বেঞ্জামিন পার্কিন ও জন রিডের যৌথ নিবন্ধে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংকট নানা ধরনের দুরবস্থার মুখে ঠেলে দিচ্ছে এবং এজন্য দায়ী মূলত সেসব দেশ যারা আদর্শ উন্নয়ন অর্থনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবিবেচনাপ্রসূত ব্যয় করেছে। এটি এখন এক সুদীর্ঘ প্রচেষ্টায় অর্জিত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল উদীয়মান অর্থনীতির অঞ্চলকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে, যা দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রের কেন্দ্রে অবস্থিত।

জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমানে ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনসের প্রধান মার্ক ম্যালোক ব্রাউনের মতে, এ সংকট বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও মডেলের দেশগুলোকে বিপদে ফেলছে। গার্মেন্টস শিল্পের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যান্য জায়গার অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ধসে পড়ছে।

স্বাধীনতার পর সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে শ্রীলঙ্কা। দুই দশকের মধ্যে গত মে মাসে দ্বীপরাষ্ট্রটি প্রথম এশিয়া-প্যাসিফিক দেশ হিসেবে ঋণখেলাপি হয়। সংকটে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানও। দেশটির আদালত সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে শাস্তির রায় দিয়েছে এবং সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বেশি ঘনীভূত হচ্ছে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দেশ নেপাল ও মালদ্বীপও।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ধাক্কা থেকে সুস্থ আছে, যার বড় কারণ এর সফল রপ্তানি খাত। দেশটির অর্থনীতি যাতে কোনো ধরনের সংকটে না পড়ে সেজন্য আগে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো ও জলবায়ু পরিবর্তজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় সহায়তার জন্য আইএমএফ এর ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের আবেদন করেছে শেখ হাসিনার সরকার।

এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ আরও ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। আইএমএফ বলেছে, জিডিপির ৩৯ শতাংশ ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ কোনো সংকটের মধ্যে নেই। এই ঋণের অনুপাত প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অনেক কম। মালদ্বীপের ঋণের অনুপাত ১৪৬ শতাংশ, ভুটানের ১২০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ১০১ শতাংশ, পাকিস্তানের ৮৮ শতাংশ, ভারতের ৫৫ শতাংশ এবং নেপালের ৪২ শতাংশ। তবে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কেন্দ্র করে প্রচুর অনিশ্চয়তা থাকায় বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে বলেও সতর্ক করেছে দাতা সংস্থাটি।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, যেখানে অন্যান্য সব দেশ চাপের মুখে আছে, সেখানে বাংলাদেশ কোনো গভীর অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়ার মতো অবস্থায় নেই। বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সাথে তুলনা করলে চলবে না। ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো আমাদের প্রজেক্টগুলো সম্পর্কে জানে, আমাদের ব্যালেন্স শিট ভালোমতো জানেন। তারা জানেন, ঋণ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত উপমহাদেশ থেকে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ সালে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর ‘নতুন’ দেশ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়। কিন্তু সে বিপদ সফলভাবে কাটিয়ে ওঠে বাংলাদেশ। পরবর্তী দশকগুলোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অদক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা বাদ দেওয়া হয়, কর মওকুফ ও বৃহৎ বাজারগুলোতে ডিউটি ফ্রি সুবিধা পায় এবং নারী ও পুরুষের বিশাল কর্মসংস্থান তৈরি হয়। বৈদেশিক রেমিট্যান্সও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৯১ সাল থেকে দারিদ্র্য ৫৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে অর্ধেকেরও বেশি কমে ২০১৬ সালে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে, সেই সাথে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও প্রভূত উন্নয়ন হয়, যার ফলে সাক্ষরতা ও শিশু মৃত্যুর হারেও অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মে মাসের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের মাথাপিছু আয় ২,৮২৪ ডলার, যা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে ২০২৬ সালের মধ্যে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে।

আশির দশকে দেশের রপ্তানি খাতে মাত্র ৪ শতাংশ অবদান রাখতো তৈরি পোশাক খাত, যেটা বর্তমানে ৮০ শতাংশ অবদান রাখছে। নব্বইয়ের দশকে এশীয় অর্থনৈতিক সংকটের সময় বিপদে পড়েনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, যার ফলে তারা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কারে মনোনিবেশ করেনি, যা তাদের চলমান সংকট থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারতো।

শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান কখনোই পলিসিমেকিংয়ে উন্নতি করার চেষ্টা করেনি, যা বাংলাদেশ করেছে। বরং তারা (শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান) বারবার আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের জন্য দেনদরবার করেছে, যা কখনোই নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যে তাদের স্থির করতে এবং তারা তাদের পলিসিতে স্থায়ী কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। এখানে লক্ষণীয় যে, করোনা মহামারির আগে থেকেই শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন সমস্যার পথ সৃষ্টি করেছে।

২০১৯ সালে জনগণের কর মওকুফের পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বন্ড বিক্রি ও চীন থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নেয়, যে অর্থ পরে তারা আর আয় করতে পারেনি। পাকিস্তানও ট্যাক্স কর্তন এবং রপ্তানি খাত দুর্বল হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করে চলেছে। দেশ দুটির মূল সমস্যা হলো তাদের ঋণের অধিকাংশই ছিল বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যার ফল ভোগ করছে তারা। এদিক থেকে বাংলাদেশ যথেষ্ট ‘সেফজোনে’ আছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও জ্বালানি সম্পদ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সমস্যার কারণে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠিক রাখতে কমানো হয়েছে জ্বালানি তেল আমদানি। গত জুলাই মাসে দেশের ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য স্কুল ও অফিস সময় কমিয়ে এনেছে।

সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য শিগগির দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হবে, কমাতে হবে আমদানিনির্ভরতা। দীর্ঘ মেয়াদি ও মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে পর্যটন খাতের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। একইসঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণ করা এখন সময়ের দাবি। সবকিছু এখন কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় এই শহরে যানজটসহ সবকিছুই বেশি। বিকেন্দ্রীকরণ হলে তখন অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক।

ফারুক/এমএস

সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য শিগগির দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হবে, কমাতে হবে আমদানিনির্ভরতা। দীর্ঘ মেয়াদি ও মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে পর্যটন খাতের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। একইসঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণ করা এখন সময়ের দাবি। সবকিছু এখন কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় এই শহরে যানজটসহ সবকিছুই বেশি। বিকেন্দ্রীকরণ হলে তখন অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।