পেরেস্ত্রোইকা ও গাসনস্ত এবং মিখাইল গর্বাচেভ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের বড় ঘটনা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙেপড়া। খোলা দরজা খোলা হাওয়ার ছবক নিয়ে তাতে অনুঘটক ছিলেন মিখাইল গর্বাচেভ। বিগত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ ভাগে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় এসে নানা নাটকীয় ঘটনাক জন্ম দেন তিনি।
৯১ বছর বয়সে মারা গেলেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ। এ নিয়ে রুশ গণমাধ্যম আরটি লিখেছে, গর্বাচেভের থেকে কম সময়ে কেউ সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাঙতে পারতো বলে বিশ্বাস করা কষ্ট। ১৯৮৫ সালে দেশের ক্ষমতায় এসে তিনি যে সংস্কার সাধন করেছেন, তার প্রভাবে ১৯৯১ সালেই ভেঙে যায় মহাশক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়ন। যদিও গর্বাচেভের নিজের সেই উদ্দেশ্য ছিল না। সোভিয়েতের ভাঙন যেমন তার নিজস্ব অর্জন তেমনি তার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিও এই ঘটনাই।
মানব ইতিহাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কী? বেশিরভাগের উত্তরই হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তবে অনেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে টুকরো হওয়াকেও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন। আর গর্বাচেভ ছিলেন সেই ঘটনার কারিগর। বিশ্বের সব থেকে ক্ষমতাধর এবং বড় দেশটির ভাঙনের পেছনে ছিল সেই দেশেরই শাসক। এজন্য তিনি পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছেন। পেয়েছেন নোবেল পুরস্কারও।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন গর্বাচেভ। সোভিয়েত ভাঙার অনেক বছর পর তিনি বলেছিলেন, ‘আনি আবমানুলি নাস’ অর্থাৎ ওরা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
মিখাইল গর্বাচেভ ১৯৩১ সালের ২ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ববর্তী প্রধান কনস্তান্তিন চেরনেনকোর মৃত্যুর পর ১৯৮৫ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও প্রধান নেতা নিযুক্ত হন।
১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজমের পতন হলে তিনি দেশটির প্রথম এবং একমাত্র প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির দিন তিনি পদত্যাগ করেন। গর্বাচেভের পদত্যাগের মধ্য দিয়েই বিশ্বে চার দশক ধরে চলা স্নায়ুদ্ধের সমাপ্তি হয়। তিনি পেরেস্ত্রোইকা ও গাসনস্ত নীতির প্রবর্তক।
১৯৮৪ সালে ৫৩ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি হন গর্বাচেভ। আবার এই সোভিয়েত নেতার সময়ই মধ্য ও পূর্ব ইউরোপজুড়ে কমিউনিজমের পতন ঘটেছিল। লাখ লাখ সোভিয়েত নাগরিকের কাছে তিনি স্বাধীনতা প্রদানকারী ত্রাণকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আবার দেশের পরবর্তী বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য তার সমালোচনা করেছেন বহু নেতা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে গর্বাচেভ আখ্যায়িত হন ইতিহাসের এক ‘কলঙ্কিত নায়ক’ হিসেবে।
বার্লিন প্রাচীরের পতন রোধে শক্তি প্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গর্ভাচেভ। তার সিদ্ধান্ত ছিল এতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো যেতে পারে। স্নায়ু যুদ্ধের দুনিয়ায় বার্লিন প্রাচীর তখন একটা প্রতীক। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাশক্তিতে পরিণত করেছিলেন। পূর্ব ইউরোপকে তিনি মস্কোর অধীনে নিয়ে এসেছিলেন।
বিশ্বজুড়ে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তিনি। তবে গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্তালিন যুগের আগের সময়ে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ভ্লাদিমির লেনিনের আদর্শ ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির কাঠামোতে পরিবর্তন আনারও ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান গর্বাচেভ। কিন্তু দ্রুতই তার পা কাদামাটিতে আটকে যায়।
মূলত গর্বাচেভ যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের দায়িত্ব পান তখন অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল না। কিন্তু এর পরই বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করায় খারাপের দিকে যাচ্ছিল। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ধীরে ধীরে বাড়ছিল। ১৯৭৩ সালে চতুর্থবারের মতো আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বাধলে তা কয়েক মাসের মধ্যে ৪০০ শতাংশ বেড়ে যায়।
এতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি অপ্রত্যাশিতভাবে চাঙা হয়ে ওঠে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশ আয় হয়েছে তেল রপ্তানি থেকে। তেলের দাম বাড়ার ফলে তেল রপ্তানিকারক আরব দেশগুলোর প্রচুর লাভ হয়, সেই লাভের টাকায় তারা ব্যাপক সামরিকায়ন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কেনা বাড়িয়ে দেয়। এই সুবাদে সোভিয়েত ইউনিয়নেও ব্যাপক সামরিকায়ন ঘটে।
পশ্চিমা অর্থনীতিবিদরা জ্বালানি তেলকে বলতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘আকিলিসের গোড়ালি’, মানে অত্যন্ত নাজুক জায়গা। গর্বাচেভের দুর্ভাগ্য, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই তেলের দাম কমতে শুরু করে। ১৯৮৬ সালে কমে যায় ৬৯ শতাংশ। এর মধ্যে ওই বছরই ঘটে চেরনোবিল দুর্ঘটনা, যার প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিপুল।
তবে শেষ পর্যন্ত সোভিয়েতের পতন হলেও রাশিয়ানরা তাদের কাঙ্ক্ষিত দেশ পায়নি। ক্ষমতায় আসেন বরিস ইয়েলতসিন। তার সময়ে রাশিয়ায় উত্থান ঘটে বিলিয়নিয়র অলিগার্কদের। তারাই রাশিয়ার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। গণতন্ত্র রাশিয়ায় বিশৃঙ্খলা ছাড়া কিছু নিয়ে আসেনি। এভাবেই দেশটিতে ক্ষমতায় আসেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
এরপর থেকে গত দুই দশক তার অধীনেই রয়েছে রাশিয়া। এই সময়ে দেশটিতে নয়া-রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের উত্থান হয়েছে। ক্রমে ক্রমে তারা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই পশ্চিমের বিরোধী হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাকি অংশগুলো পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
মহা শক্তিধর দেশের সুপারপাওয়ার স্ট্যাটাস মুছে যাওয়ায় অনেক রাশিয়ানই গর্বাচেভকে অপছন্দ করেন। সোভিয়েত পতনের পর রাশিয়ার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন গর্বাচেভ। তবে তিনি এতে ব্যর্থ হন। এক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ১ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছিলেন। মূলত সোভিয়েত পতনের মধ্য দিয়েই গর্বাচেভের রাজনৈতিক মৃত্যু হয়।
সেই রাশিয়া আজ তারই প্রতিবেমী ইউক্রেনের সঙ্গে যখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, সেই সময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন মিখাইল গর্বাচেভ। বিশ্ব ইতিহাসে রেখে গেলেন তার পেরেস্ত্রোইকা ও গাসনস্ত (খোলা দুয়ার ও মুক্ত হাওয়া) দর্শন।
লেখক : সাংবাদিক।
ফারুক/এমএস