রোহিঙ্গা সংকট

জাতিসংঘকে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে

মনিরা নাজমী জাহান
মনিরা নাজমী জাহান মনিরা নাজমী জাহান , শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত: ১০:০৯ এএম, ২৮ আগস্ট ২০২২

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক কালো দিন। এই দিনে তামাম দুনিয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট বিশাল এক মানবিক সংকট প্রত্যক্ষ করে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আক্রমণ করে সামরিক বাহিনীর ত্রিশটি চৌকিতে, তাদের আক্রমণের শিকার হয় মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনীও।

এই হামালার কিছু সময়ের মধ্যেই আরসা দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়।আরসার প্রতিক্রিয়া দেয়ার পর পর ই রোহিঙ্গাদের উপর পাল্টা সামরিক আক্রমণ করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী । মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আক্রমণে পুড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রামের পর গ্রাম, নির্বিচারে হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা যুবকদের, ধর্ষণের শিকার হয় রোহিঙ্গা নারী আর কিশোরীরা।

বিভিন্ন জায়গায় পুতে দেওয়া হয় ল্যান্ড-মাইন। সহিংস হামলার শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসে। স্রোতের মত সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশ করে রোহিঙ্গারা । কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের খোঁজে ১১ লাখেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

একটি বিশেষ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে চরম উদারতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু সেই উদারতার সুযোগ নিয়ে যেন বাংলাদেশের উপর চেপে বসেছে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।প্রবেশের পর থেকে আজ অব্দি প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কোন কার্যকরি সহযোগিতার হাত আমরা মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বাড়াতে দেখি নি।বরং মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিতারিত করে আরাকান রাজ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে বেশী আগ্রহী।যে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করেছে চীন,ভারত, জাপান এমনকি ইইউর মতো প্রভাবশালী সংস্থাও। অথচ মিয়ানমার ভুলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা স্বল্প শিক্ষিত, অদক্ষ এক জাতি।

অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে রোহিঙ্গারা হয়ে উঠতে পারতো স্বল্প মূল্যের শ্রমের উৎস। রোহিঙ্গারা না থাকায় এখন তাদের তুলনামূলকভাবে বেশি দামে শ্রম কিনতে হবে। অর্থাৎ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন সহযোগিতা করলে বরং মিয়ানমারের অর্থনৈতিক অঞ্চল গুলো বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নিকট আরও বেশি আকর্ষণীয় হতে পারতো।

তবে এই কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ইস্যু জটিল আকার ধারণ করছে। দিনে কে দিন বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গারা বোঝায় পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ কে পোহাতে হচ্ছে বহুমাত্রিক সমস্যা। রোহিঙ্গা সংকট সমাধান তো দূরের কথা বরং দিন কে দিন এই সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

বাংলাদেশ এমননিতেই জনবহুল একটি দেশ। বাংলাদেশের মত জনবহুল একটি দেশে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তার উপর অস্বাভাভিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরে জনসংখ্যা। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে আমাদের তাকাতে হবে পরিসংখ্যানের দিকে।

২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর ইউনিসেফের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তথ্যমতে, মিয়ানমার থেকে নতুন আসাসহ বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচে ৭ লাখ ২০ হাজার। এদের ৪ লাখ ৫০ হাজারের বয়স ৪ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সী। সেই সময় ১ লাখ ২০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা মা ও অসুস্থ নারীদের বাড়তি পুষ্টিকর খাবার দেওয়া জরুরি ছিল। গত বছরের মে মাস পর্যন্ত পরিস্থিতি উল্লেখ করে ইউনিসেফের আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে ৬০টি রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে।

ব্র্যাকের স্বেচ্ছাসেবকদের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ এই দুই সপ্তাহের মধ্যে ওই ১ লাখ পরিবারে অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যা ছিল ৮ হাজারের বেশি। ইউনিসেফের বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনো আইনি পরিচয় বা নাগরিকত্ব নেই। বাংলাদেশেও জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করা হচ্ছে না,কারণ তাদের বৈধ পরিচয় নেই এবং তাদের শরণার্থী মর্যাদাও নেই।

স্বভাবতই যতদিন যাবে তত বাড়বে শিশুর সংখ্যা। তৈরি হবে এদের নাগরিকত্ব নিয়ে জটিল পরিস্থিতি। যেহেতু মিয়ানমারে এদের কোন আইনি পরিচয় নেই তাই মিয়ানমার এই শিশুদের ফেরত নিতে চাইবে না। অপরদিকে বাংলাদেশেও তাদের আইনি ভাবে জন্ম নিবন্ধন করা সম্ভব হবে না। প্রতিনিয়ত জন্ম নেয়া শিশুদের কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

এই রোহিঙ্গাদের চাপ সামলাতে গিয়ে পরিবেশ গত ভাবেও বাংলাদেশকে দিতে হয়েছে চড়া মুল্য। পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পরতে হচ্ছে বাংলাদেশকে ।কক্সবাজার বন বিভাগের (দক্ষিণ) তথ্যমতে, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারে চালানো গণহত্যার পর দেশটির রোহিঙ্গারা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, তাননিমারন খোলা, মক্করারবিল বা হাকিমপাড়া, জামতলী বাঘঘোনা, শফিউল্লা কাটা এবং টেকনাফের পুটিবুনিয়া ও কেরনতলী বন বিভাগের পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। এতে ধ্বংস হয়েছে ৬ হাজার ২০০ একর সামাজিক ও প্রাকৃতিক বন। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৪২০ কোটি টাকারও বেশি। তবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির অষ্টম সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ধ্বংসপ্রাপ্ত বনজসম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে প্রায় ৪৫৭ কোটি এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি প্রায় ১ হাজার ৪০৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। মোট ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এতে আরও বলা হয়, ৫৮০ একর সৃজিত বন এবং ১ হাজার ২৫৭ একর প্রাকৃতিক বনসহ ক্যাম্প এলাকার বাইরে জ্বালানি সংগ্রহে রোহিঙ্গারা বনাঞ্চল উজাড় করেছে ১ হাজার ৮৩৫ একর।

সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণে মোট ধ্বংসপ্রাপ্ত বনের পরিমাণ ৮ হাজার ১ দশমিক ০২ একর এবং সর্বমোট বনজদ্রব্য ও জীববৈচিত্র্যসহ ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৪২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।পরিবেশের ওপর প্রভাববিষয়ক ইউএনডিপির এক গবেষণায় উঠে আসে, রোহিঙ্গা বসতির কারণে উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় মোট ১১ ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ফলে এক ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন আমরা হলাম। যত দিন যাবে এই পরিবেশ গত ঝুঁকি বাড়তেই থাকবে। এক সময় হয়তো এই ক্ষতি মোকাবেলা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

সবচেয়ে ভয়াবহ যে ঝুঁকি বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা হচ্ছে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি।কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘিরে গড়ে উঠেছে জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা। মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তানসহ ছয় দেশ থেকে আসা টাকা দিয়ে ক্যাম্পগুলোতে পাতা হচ্ছে জঙ্গিবাদের জাল। এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যরা জাল নোট তৈরি এবং ইয়াবা ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়েছে।

গণমাধ্যমের কল্যাণে যে সব জঙ্গি সংঠনের তৎপরতা সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি তার মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা),রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও),ইসলামী মাহাজ এবং জমিউয়তুল মুজাহিদীন,আল-ইয়াকিন’ প্রভৃতির নামউল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সম্প্রতি সময়ে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে আরেক গা শিউড়ে ওঠার মত ঘটনা তা হচ্ছে বাংলাদেশের ভেতর রোহিঙ্গাদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের আকাশ-কুসুম পরিকল্পনা করছে ভয়ংকর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন। ভাবা যায় কি ভয়াবহ নিরাপত্তা জনিত ঝুঁকিতে বাংলাদেশকে ফেলার চেষ্টা করছে এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী?

যেসব তথাকথিত তারকা, রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা কূটনীতিকরা গণমাধ্যমের সামনে বড় বড় বুলি আওড়িয়ে গেলেন। তাদের সেই আওড়ানো বুলির উদ্দেশ্য কি ছিল সমস্যার সমাধান নাকি গনমাধ্যমে নিজেদের ইমেজ বৃদ্ধি? রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না করার দায় কি জাতিসংঘ এড়াতে পারে?

বাংলাদেশ নামক ছোট্ট দেশটি তার শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে চরম মানবিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে বিশ্ব মোড়লদের অহেতুক কথা বন্ধ করে সত্যিকারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার। শুধু তাই না জাতিসংঘকেও এই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কার্যকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। তা হলে সংগঠন হিসেবে জাতিসংঘ কার্যকারিতা নিয়েও একদিন প্রশ্ন উঠবে।

লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস

বাংলাদেশ নামক ছোট্ট দেশটি তার শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে চরম মানবিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে বিশ্ব মোড়লদের অহেতুক কথা বন্ধ করে সত্যিকারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার। শুধু তাই না জাতিসংঘকেও এই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কার্যকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। তা হলে সংগঠন হিসেবে জাতিসংঘ কার্যকারিতা নিয়েও একদিন প্রশ্ন উঠবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।