আধুনিকতার কথা বললেও এ সমাজ অন্ধকারবিলাসী
‘ছোট পোশাক পরে বিপরীত লিঙ্গকে সিডিউস করা বন্ধ করুন’ – এখন ফেসবুকের আলোচিত বিষয়। এই প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে সে নিজেও ছোট পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায় এমন ছবিও এখন পাওয়া যাচ্ছে। পোশাক নিয়ে উচ্চ আদালতের মন্তব্যকে সমর্থন ও অভিবাদন জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক দল শিক্ষার্থী ছোট পোশাকের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কদর্যভাষার প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের প্রধানতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন একটি মৌলবাদী ও উসকানিমূলক কর্মসূচি পালিত হতে পারে, সেটাই বিস্ময়কর। ছাত্রলীগের মতো প্রতাপশালী সংগঠন, বাম সংগঠন ছাড়াও অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। তারা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ প্রশাসিনক কর্মকর্তাদের সামনে একটি প্রতিক্রিয়াশীল এবং একইসাথে সংঘাত ডেকে আনে এমন কর্মসূচি পালিত হওয়ায় অনেকেই ক্ষুব্ধ।
হিজাব বা পুরো শরীর আবৃত করা পোশাকের প্রতি সহনশলীতা কাম্য হয়, তাহলে ছোট পোশাকের প্রতিও হিজাব বা বড় পোশাক পরাদের সহনশীলতা কাম্য। কিন্তু সেটা তারা মানছেন না। অনেকেই হতাশার সাথে বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন এক বড় মাদ্রাসায় পরিণত হয়েছে, কেউবা বলছেন, আফগানিস্তান হতে বাংলাদেশের আর বেশি দেরি নাই।
এগুলো সবই ক্ষোভের কথা। তবে বাস্তবতা হলো, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ দর্শনের বিপজ্জনক চর্চা বেড়ে চলেছে। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তালিবানি নৃশংসতা দেখতে দেখতে আতঙ্কিত হয়েছি আমরা, এখনও হচ্ছি।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এই বর্বরতা মেনে নেওয়া কঠিন। তালিবানি বর্বরতা দেখে যারা আতংকিত তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এদের স্পর্ধা দেখে শঙ্কিত। কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদ, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, খারাপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ধর্মীয় মৌলবাদের এমন প্রদর্শন হলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত হয়। এটা ভেবেই আতঙ্কিত হতে হয়।
তবে এটিই নতুন নয়। সমাজের ভেতরে আসলে পচন ধরে গিয়েছে অনেকদিন আগেই। রোগ দানা বেঁধেছে মনোজগতে। ধর্মান্ধতার যূপকাষ্ঠে বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ধর্মের অফিমে বুঁদ হয়ে আছে সম্প্রদায়গত ভিন্নতা তথা হানাহানি আর তাতেই মৃতপ্রায় মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। কলেজের অধ্যাপিকা টিপ পরলে রাস্তায় প্রকাশ্যে টিপ্পনি ও অশ্রাব্য গালিগালাজ আসে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য থেকে, রেল স্টেশনে চুপচাপ নিজের মতো থাকা তরুণীর উপর হামলে পড়ে হায়েনারা।
এ কয়দিন আগে প্রকাশ্য দিবালোকে, পুলিশসহ অজস্র মানুষের সামনে এক মধ্যবয়সী লোককে দেখা গেল ফার্মগেটে পথ চলতি নারীদের গালি দিচ্ছে, আঘাত করছে হিজাব না পরার জন্য। তাতে কেউ কিছু বলেনি। এই না বলা থেকেই অন্ধকার ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে।
বিষয়টা সামাজিক, কিন্তু তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক ইসলাম প্রায় সব রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং ধর্মের আফিম যদি আধুনিক দেশকে বুঁদ করে রাখে, তবে মৌলবাদ সর্বক্ষেত্রেই প্রভাবিত হবে আর এটাই স্বাভাবিক। এখন সেটাই হচ্ছে। নড়াইলে শিক্ষক নির্যাতন, কিংবা হিন্দু পাড়ায় হামলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উপর হামলা, রংপুরে, ভোলায় সব জায়গায় এই জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রতি রাজনীতির নীরবতা দেখে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে তারা নিজেরা কতটা অসহায়!
মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্যে মানুষ নয়। কিন্তু তালেবান, আলকায়দা, আইএস-এর হিংস্রতার দর্শন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে মুসলিম দেশগুলোতে। এদের দর্শনে একর পর এক লেখক হত্যা হয়েছে, হলি আর্টিজানের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটেছে, একুশে আগস্ট ঘটেছে বাংলাদেশে। তাদের দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে জেএমবি বা নব্য জেএমবি নামের সংগঠন হয়েছে। কিন্তু রাজনীতি ও পেশাজীবীদের মধ্যে বহুত্ববাদের কথা যারা বলতেন তারাও শুধু সরকার বিরোধিতায় বা সরকারপন্থী থাকতে সমাজ এবং সংস্কৃতিকে ধর্মীয় মোড়কে সব সময় ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছেন এখন। এর ফলে সমস্যার গতিপ্রকৃতি সব সময় হয়ে উঠেছে একমুখী। অনুভূতি শুধু তাদের আছে, আর কারও নেই – এমন এক দর্শনকে গ্রহণ করেও নেয়া হয়ে গেছে।
গণতান্ত্রিক মোড়কে রাজনৈতিক ইসলাম এমন এক বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে, যার থেকে মুক্তির উপায় সহজে পাওয়া কঠিন। সাধারণ জনগণ এই ধরনের আচরণে বিরক্ত হলেও কিছু বলতে সাহস করছে না। কারণ ক্ষমতার রাজনীতি মৌলবাদীদের সাথী বানিয়ে চলে। একুশ শতকে আমরা উন্নয়নের কথা বলি, প্রযুক্তিগত বিকাশের কথা বলি, মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা বলি, অথচ মানসিকতার বিচারে আমরা অন্ধকারবিলাসী।
এগুলো নিছক কথার কথা নয়। এই গোষ্ঠীর দাপটে দেশ বলতে গেলে এখন দিশাহীন। রাষ্ট্রের মূল সমস্যাসমূহ এড়িয়ে গিয়ে শুধুই এই মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মানুষকে আজ কেবলই বিভক্ত করছে। শুধু প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে, সামাজিক মাধ্যমে আফসোস করে কিছু হবে না। একটা সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। জাতি হিসেবে আমর কী চাই সেটা স্পষ্ট করে বলার সময়। শিক্ষিত মননকে অশিক্ষিতের হাতে তুলে দিব নাকি মেরুদণ্ড সোজা করে সুস্থ মানুষের সমাজ গড়তে উদ্যোগী হব?
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস