ধর্ম
সন্তানের সুশিক্ষা ও পিতা-মাতার ভূমিকা
প্রতিদিন কত ধরনের অপরাধের সংবাদই না কানে আসে। এসব অপরাধের সাথে যারা জড়িত তারা তো কোনো না কোনো পিতা-মাতারই সন্তান। নেশার অর্থ না পেয়ে নিজ মাকে হত্যা করতেও আজ আমাদের আদরের সন্তানরা দ্বিধা করছে না। আমাদের সন্তানদের অবস্থা আজ এতটা খারাপ কেন? সন্তানদের এই অবস্থার জন্য কি আমরা যারা পিতা-মাতা রয়েছি তারা দায়ী নই? আমরা কি আমাদের সন্তানদের বিষয়ে যতটুকু সচেতন থাকার ও দায়িত্ব পালনের কথা ততটা করছি? হয়তো অনেকেই করছি কিন্তু একটি বৃহৎ সংখ্যা এ থেকে অনেক দূরে।
জন্মের পর মানুষকে শিক্ষালাভ, চরিত্র গঠন এবং জীবনধারণের জন্য বিবিধ কাজে নিয়োজিত থাকতে হয় আর চলার এই পথে সদাচরণ, বিনয়, নম্রতা ইত্যাদির সমন্বয়ে স্বভাবে যে বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে, তাকে আদব-কায়দা বলে। এই আদব-কায়দা তথা চরিত্র গঠন প্রক্রিয়া জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয়ে যায়। এমনকি মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ও পিতা-মাতার গুণাবলি সন্তানের মধ্যে বিকশিত হয়। তাই সন্তানের সুশিক্ষা ও তরবিয়তে পিতা-মাতার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সন্তানসন্তুতি পিতা-মাতার দর্পণস্বরূপ। পিতা-মাতা তাদের সাথে যে ব্যবহার করবেন, তাদের মধ্যেও সেই চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত হবে। বাল্যকাল থেকেই শিশুর গ্রহণ ও অণুকরণ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। সে যা দেখে তারই অনুকরণ করতে শেখে। তাই তাদের সাথে সর্বদা ভালো আচরণ করা উচিত। সন্তানসন্তুতির জন্য পিতা-মাতার দোয়া জাদুর মতো কাজ করে। শিষ্টাচারপূর্ণ আচার-আচরণ শেখার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত। পবিত্র কোরআন আমাদের এই দোয়া শিখিয়েছে যে ‘হে আমাদের প্রভু-প্রতিপালক! তুমি আমাদের স্ত্রী ও সন্তানের মাধ্যমে আমাদের চোখের স্নিগ্ধতা দান কর আর আমাদের মুত্তাকিদের নেতা বানাও’ (সুরা ফুরকান, আয়াত: ৭৪)
মূলত আল্লাহতায়ালা হচ্ছেন আমাদের সবার প্রকৃত অভিভাবক। আমাদের সবার সব ধরনের চাহিদা তিনিই পূরণ করেন। পবিত্র কোরআনে যেভাবে বলা হয়েছে, ‘তোমরা জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক। তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক ও কতই না উত্তম সাহায্যকারী’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪০)। অন্যত্র বলা হয়েছে ‘তুমি বল, আকাশসমূহ ও পৃথিবীর আদিস্রষ্টা আল্লাহ ছাড়া আমি কি অন্য কোনো অভিভাবক গ্রহণ করতে পারি? তিনি সবার আহার জোগান এবং তাকে আহার জোগান দেওয়া হয় না’ (সুরা আন আম, আয়াত: ১৪)। পবিত্র কোরআনের এই দুটি আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, আমাদের সবার প্রকৃত অভিভাবক হচ্ছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।
আমাদের সবার প্রকৃত অভিভাবক যদিও আল্লাহ, তথাপি একজন সন্তানের সুশিক্ষা এবং দেখভালের দায়িত্ব তিনিই পিতা-মাতার ওপর দিয়েছেন। তাই সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হয়। আল্লাহতায়ালা পিতা-মাতার ওপর সন্তানের দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছেন। যেমন- বলা হয়েছে, ‘সন্তান যার, ন্যায়সঙ্গতভাবে তার ওপরই তাদের খাদ্য ও বস্ত্রের দায়িত্বভার ন্যস্ত। কারও ওপর তার সাধ্যাতীত দায়িত্বভার ন্যস্ত করা যায় না’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৩৩)।
একজন পিতা-মাতাকে অবশ্যই উন্নত আদর্শের হতে হবে। মহানবি (সা.) পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘কোনো পিতা তার পুত্রকে উত্তম শিষ্টাচার অপেক্ষা অধিক শ্রেয় আর কোনো বস্তু দান করতে পারে না’ (তিরমিযি)। তাই পিতা-মাতার উচিত হবে সন্তানদের উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। আবার পিতা-মাতার প্রতিও সন্তারের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি আমাদের যা করণীয় এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমার প্রভু-প্রতিপালক একমাত্র তারই ইবাদত করার এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার তাগিদপূর্ণ আদেশ দিয়েছেন।
তোমার জীবদ্দশায় তাদের একজন বা উভয়েই বার্ধক্যে উপনীত হলে তুমি তাদের উদ্দেশ্যে বিরক্তিসূচক উহ্ও বলো না এবং তাদের বকাঝকা করো না, বরং তাদের সাথে সদা বিনম্র ও সম্মানসূচক কথা বলো। আর তুমি মমতাভরে তাদের উভয়ের ওপর বিনয়ের ডানা মেলে ধর। আর দোয়ার সময় বলবে, হে আমার প্রভু-প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি সেভাবে দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমায় লালনপালন করেছিল’ (সুরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ২৩-২৪)।
হাদিসে উল্লেখ আছে, এক সাহাবি মহানবি (সা.) এর কাছে এসে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! সন্তানের ওপর পিতা-মাতার কি হক বা দাবি আছে? তিনি (সা.) বললেন, তারা উভয়েই তোমার বেহেশতও এবং দোজখও’ (ইবনে মাজাহ)। সন্তান ভালো হবে না খারাপ হবে তা নির্ভর করে পিতা-মাতার কাছে। সন্তান যে পরিবেশে বড় হবে তাই সে শিখবে। পিতা-মাতা যদি আদর্শবান হোন এবং ধর্মীয় নিয়মকানুন অনুযায়ী চলেন এবং সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলেন তাহলে সন্তান অবশ্যই ভালো হবে।
আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবীতে ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দিয়ে থাকেন পরীক্ষা করার জন্য। অনেককে আল্লাহতায়ালা প্রচুর ধনসম্পদ দান করেন ঠিকই কিন্তু সেই ধনসম্পত্তির সঠিক ব্যবহার না করার ফলে দেখা যায় সে ধ্বংস হয়ে যায় আবার কাউকে সন্তান-সন্তুতি দেন ঠিকই কিন্তু তাদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করার ফলে এই সন্তান তার জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
সন্তানসন্তুতি যদি প্রকৃত নৈতিকগুণ সম্পন্ন না হয় তাহলে মাতা-পিতার জন্য তা একটি আজাব ছাড়া কিছুই নয়। জীবন বিধান আল কোরআনের সুরা কাহাফের ৪৬ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দুনিয়ার সৌন্দর্য। এ সন্তান-সন্তুতি যদি আদর্শ চরিত্রের না হয় তাহলে তা হয় মা-বাবার জন্য পরীক্ষার কারণ দুঃখের বোঝা।’ আর এজন্যই আল্লাহতায়ালা কোরআন কারিমে মুমিনদের হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘আর জেনে রাখ, তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্তুতি পরীক্ষার কারণ (সুরা আনফাল, আয়াত: ২৭)। আরও বলা হয়েছে, ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন থেকে বাঁচাও’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৬)।
প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় যে খবরটি নিয়মিত থাকে তা হলো চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি। পত্রিকার পাতায় এ খবরগুলো খুব ভালো করে স্থান দখল করে নিয়েছে। এমন কোনো দিন বাদ যায় না যে, যেদিন এসব খবর প্রকাশ পায় না। এদেশে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ টুকরা করার মতো খবরও প্রকাশিত হয়, আবার ঐশীর মতো পথভ্রষ্ট মেয়েদের খবরও প্রকাশ হয়। এসব অপকর্ম যারা করে তারা তো কোনো না কোনো পিতা-মাতারই সন্তান।
এছাড়া তারা কোনো না কোনো ধর্মের অবশ্যই অনুসারী। সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন, কোনো ধর্মেই এ ধরনের গর্হিত কাজকে অনুমতি দেয় না। দিনের পর দিন আমাদের সন্তানরা কেন এতো খারপ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে? এর কারণ কি? সমাজে যারা নানান অপকর্মে লিপ্ত তাদের সম্পর্কে যদি আমরা একটু খোঁজ নেই, তাহলে দেখতে পাব যে, তাদের পিতা-মাতা তাদের সেভাবে গাইড করেননি। সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কাদের সাথে বন্ধুত্ব করছে এসবের কোনো খেয়ালই রাখা হয় না।
সন্তানদের সম্পর্কে কোনো চিন্তা নেই বলেই তাদের মাধ্যমে আজ সংগঠিত হচ্ছে যত ধরনের ঘৃণ্য কাজ। আমাদের সন্তান সম্পর্কে আমরা যদি সচেতন থাকি এবং উত্তম শিক্ষা প্রদান করি, তাহলে কোনো পিতা-মাতার সন্তানের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় কারও ক্ষতি করা। আমরা দেখতে পাই অনেকেই এমন আছেন যারা চান সন্তানদের ধর্মের আলোয় আলোকিত করতে কিন্তু অধিকাংশ পরিবারই আজ সন্তানদের জাগতিক উন্নতির দিকেই যেন বেশি দৃষ্টি দেন, ফলে সন্তান কোনো কিছুতেই সফল হতে পারে না।
সন্তান ভালো হবে না খারাপ হবে তার অনেকটাই নির্ভর করে পিতা-মাতার ওপর। সন্তান যে পরিবেশে বড় হবে তাই সে শিখবে। পিতা-মাতা যদি আদর্শবান হন এবং ধমীর্য় নিয়মকানুন অনুযায়ী চলেন এবং সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলেন তাহলে সন্তান অবশ্যই ভালো হবে। আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবীতে ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দিয়ে থাকেন পরীক্ষা করার জন্য। অনেককে আল্লাহতায়ালা প্রচুর ধনসম্পদ দান করেন ঠিকই কিন্তু সেই ধন-সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার না করার ফলে দেখা যায় সে ধ্বংস হয়ে যায় আবার কাউকে সন্তানসন্ততি দেন ঠিকই কিন্তু তাদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে না তোলার ফলে সেই সন্তান তার জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব আদর্শবান সন্তানসন্তুতি গড়ে তোলার চেষ্টা করা এবং তাদের চারিত্রিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য উন্নত শিক্ষা প্রদান করে সমাজে, রাষ্ট্রে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুণগত মানসম্পন্ন এক সমাজ কাঠামো নির্মাণ করা। কারণ সন্তান-সন্ততি যদি প্রকৃত নৈতিক গুণসম্পন্ন না হয়, তাহলে মাতা-পিতার জন্য তা এক আজাব বই কিছুই নয়। জীবনবিধান আল কোরআনের সুরা কাহাফের ৪৬ আয়াতে বলা হয়েছে, ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার সৌন্দর্য।
সন্তানসন্তুতি যদি আদর্শ চরিত্রের না হয়, তাহলে তা হয় মা-বাবার জন্য পরীক্ষার কারণ-দুঃখের বোঝা। আর এজন্যই আল্লাহতায়ালা কোরআন কারিমে মুমিনদের হুঁশিয়ার করে বলেছেন, আর জেনে রাখ, তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্তুতি পরীক্ষার কারণ (সুরা আনফাল, আয়াত: ২৮)। আরও বলা হয়েছে, ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন থেকে বাঁচাও’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৬)
প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য সে যেন কেবল নিজেই মুত্তাকি না হয় বরং সে নিজে এবং পরিবারের সবাইকে পুণ্যবান-মুত্তাকি করে গড়ে তোলে। সব ধরনের পাপ ও খারাপ থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের সঠিকভাবে শিক্ষা দেয়। আমরা যদি সন্তানদের প্রকৃত ইসলামের শিক্ষায় লালিতপালিত করি তাহলে পরিবার, সমাজ, জাতি, দেশ সর্বত্রই শান্তি বিরাজ করবে এটা নিশ্চিত। সন্তানদের যদি আমরা উত্তম শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলি তাহলে এদেশে থাকবে না কোনো সন্ত্রাসী, থাকবে না কোনো চোর-ডাকাত, হতে পারে না কোনো মারামারি আর কাটাকাটি। এক কথায় বলা যায় সব প্রকার অরাজকতা থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।
আমরা যদি আমাদের সন্তানদের প্রতি দৃষ্টি না দেই তাহলে আল্লাহতায়ালার কাছে আমরা অবশ্যই এজন্য জিজ্ঞাসিত হবো। যেভাবে নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকই রাখাল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্তদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত করা হবে যে তোমরা তাদের কিরূপ রক্ষণাবেক্ষণ করেছ (বুখারি ও মুসলিম)।
আজ আমরা দেখতে পাই সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে দিয়েই আমরা নিশ্চিন্তে বসে থাকি, এই খোঁজ নেই যে, আমার সন্তান কি ঠিকভাবে ক্লাস করছে না বাজে বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। এমনই বেখেয়াল অবস্থায় এক সময় দেখা যায় যে, আদরের সন্তান এমন একপর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যেখান থেকে ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব নয়। তাই সময় থাকতেই সন্তানের প্রতি গভীর দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
আমরা যদি নেক সন্তান রেখে যেতে পারি, তাহলে দেশ ও জাতির জন্য তা যেমন কল্যাণকর হবে, তেমনই আমাদের মৃত্যুর পরও এ সন্তান আমাদের জন্য সদকায়ে জারিয়া হিসেবে থেকে যাবে। তাই পুণ্যবান সন্তান পেতে হলে প্রথমে পুণ্যবতী মা’র প্রয়োজন। মা যদি ভালো না হয় সেই ঘরের সন্তানসন্ততিও ভালো হওয়া দুষ্কর। ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যদি প্রতিদিন ঝগড়াঝাটি লেগে থাকে, তাহলে সে ঘরের সন্তান ভালো হওয়ার আশা করা যায় কি? তাই স্ত্রী হিসেবে আমরা যাকে মনোনীত করতে চাই প্রথমে তার ধার্মিকতা দেখা।
প্রতিনিয়ত আমরা দেখি, স্ত্রী নির্বাচনে যারা কেবল দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি নজর দিয়েছে তাদের হাত সর্বদা ধূলিমাখা থেকেছে, তাদের সংসারে নেই শান্তি। যেভাবে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, একটি আদর্শ জাতি পেতে হলে একটি আদর্শ মায়ের প্রয়োজন। তাই আদর্শবান সন্তানসন্ততির জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন আদর্শবতী একটি মা।
মহানবি (সা.) বলেছেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। এ হাদিসের মর্মকথা হলো প্রথমে মাকে জান্নাতি হতে হবে, তবেই না সন্তান জান্নাতি হবে। এখানে ‘মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত’ বলতে মায়ের কঠোর অনুশাসন, শিক্ষা ও স্নেহ মমতায় সন্তান পুণ্যবান হতে পারে আর এর ফলশ্রুতিতে সন্তান এ দুনিয়ায়ও জান্নাত লাভ করবে এবং পরকালেও। নেক সন্তান পেতে নেক মায়ের চেয়ে বড় কোনো যন্ত্র আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি আর হতে পারেও না।
যেহেতু সন্তানসন্ততি আল্লাহতায়ালার দান। কোনো সন্তানই জন্ম থেকে খারাপ হয় না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা পিতা-মাতার অবহেলার কারণেই সন্তান মন্দ পথে পা বাড়ায়। একটি সন্তান যখন ধীরে ধীরে বড় হয়, তখনই তার মাঝে পারিপার্শ্বিকতার খারাপ দিকগুলো চলে আসে। এজন্য প্রত্যেক পিতা-মাতার দায়িত্ব হলো সন্তানকে একেবারে শৈশব থেকেই ধর্মীয় আদব কায়দা শিখানো। কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, এ বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা দরকার। পরিবার পরিজনদের মুত্তাকি করে গড়ে তোলার দায়িত্ব অভিভাবকের।
হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেছেন, কোনো পিতা তার পুত্রকে উত্তম শিষ্টাচার অপেক্ষা অধিক শ্রেয় কোনো বস্তু দান করতে পারে না’ (তিরমিযি)। অন্য একটি হাদিসে হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার দু’টি কন্যাসন্তানকে তাদের শিশুকাল থেকে সঠিকভাবে লালন-পালন করে, বিচার দিবসে সে আমার সঙ্গে হাতের দুই আঙুলের ন্যায় (কাছাকাছি) অবস্থান করবে’ (মুসলিম)।
সন্তানের সুশিক্ষার জন্য পিতা-মাতাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার, সাধনা ও দোয়া করতে হয়। প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত, প্রথমে নিজেকে সংশোধন করা যে, নিজের ভিতরে যা খারাপি রয়েছে তার সংশোধন করা। পিতা-মাতার স্বভাবেই যদি খারাপ কিছু থাকে, তবে আমরা কি করে আশা করতে পারি যে, সন্তান ভালো হবে। কারণ, শিশুরা হচ্ছে অনুকরণ প্রিয়।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কথায় আছে, কাঁচাতে না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাশ্ ঠাশ্। কথাটি খুবই মূল্যবান। কাদামাটি উত্তমরূপে ছেনে সুন্দর ছাঁচে ফেলে যেমন ইচ্ছেমতো সুদৃশ্য জিনিস তৈরি করা যায়, তেমনি মানবের শৈশবকালে উত্তম শিক্ষার মাধ্যমে উত্তম মানুষ তৈরি করা সম্ভব। সন্তানকে সুশিক্ষাদানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন পিতা-মাতা। আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ এবং পিতা-মাতার বদৌলতে একটি শিশু পৃথিবীতে আসে।
মানব সন্তান যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে থাকে অসহায়। বাবা-মা তাকে পরম যত্নে লালন পালন করে বড় করে তোলেন; বাবা-মায়ের সান্নিধ্য সে সবচেয়ে বেশি লাভ করে। আর তাই তাদের ওঠা-বসা, কথাবার্তা, সভ্যতা-ভদ্রতা, বিনয়, নম্রতা এসব কিছুর প্রভাব সন্তানের ওপর পরে এবং তারা এ থেকে শিক্ষা লাভ করে। একজন আদর্শ পিতা-মাতাই পারেন সমাজকে আদর্শ জাতি উপহার দিতে।
শিশু যখন তার স্বল্পবুদ্ধির বয়সে প্রবেশ করে তখন তার নির্দিষ্ট ও সরাসরি তরবিয়্যতের সময়কাল শুরু হয়ে যায়। মা-বাবা যদি শিশুকাল থেকেই তাদের সন্তানের আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা, নামাজ পড়া, সত্য বলা, বড়দের সম্মান করা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর শিক্ষা দেন এবং পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষার ওপর জোর দেন, তাহলে সন্তান নিঃসন্দেহে সুশিক্ষিত হবে।
হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক শিশু ফিৎরতের (প্রকৃতি ও স্বভাব) ওপর জন্মলাভ করে। পরে বাবা-মা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা মাজুসি করে গড়ে তোলে’ (বুখারি ও মুসলিম)। এই হাদিসের অর্থ এটা নয়, যখন শিশু বয়ঃপ্রাপ্ত হয় তখন মা-বাবা তাকে গির্জায় নিয়ে খ্রিস্টান বানায়। বরং এর অর্থ এই, শিশু বাবা-মার কর্মজীবন অনুকরণ করে। পবিত্র কোরআনের শিক্ষা হলো, একজন মু’মিন নারী অবশ্যই একজন মু’মিন পুরুষকে বিয়ে করবে এবং মু’মিন পুরুষ যেন একজন মু’মিন নারীকে বিয়ে করে।
এই নির্দেশ দেওয়ার কারণ হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম যেন পিতা-মাতার কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা অর্থাৎ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। ধর্ম মানুষকে সঠিক শিক্ষা দেয়। আর একমাত্র ধার্মিক পিতা-মাতাই পারে সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে। মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক হলো পিতা-মাতা। হিংসা, লোভ-লালসা, ক্রোধ, কামভাব, ধর্মবিমুখতা প্রভৃতি থেকেই পাপ জন্ম লাভ করে।
এখন ভেবে দেখা উচিত, এসব কি সেই সব অভ্যাস নয় যা শিশুকাল থেকেই শিশুরা রপ্ত করতে থাকে? শৈশবকালই কি সেই সময় নয়, যখন থেকে মনের গভীরে এসব বিষয়ে নকশা খোদিত হতে থাকে? পিতা—মাতা শালীন হলে সন্তানরা লজ্জাশীল হবে, পিতা-মাতা নম্র হলে সন্তানরা বিনয়ী হবে। পিতা-মাতা সত্যবাদী হলে সন্তানরা নীতিবান হবে। মোট কথা, পিতা-মাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি না হলেও সন্তানরা অধিকাংশই তা লাভ করে।
হজরত রাসুল করিম (সা.) আমাদের এশিক্ষাও দিয়েছেন যে, ‘সন্তানসন্ততিকে সম্মান কর এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে এবং উত্তম তরবিয়ত দাও।’ কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমান যুগে, পিতা-মাতারা নিজদের নিয়ে এতো বেশি ব্যস্ত থাকে যে, তাদের বাচ্চাদের সাথে উত্তম আচরণ করা এবং তাদের সম্মান দেখানোর মতো সময় হয় না। ফলে সেই সব সন্তান বিভিন্ন প্রকার খারাপ কাজে লিপ্ত হয়, যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ ফল বয়ে আনে।
তাই প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত হবে, তাদের সন্তানসন্ততিকে সঠিক শিক্ষা দান করা, তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, তাদের ভালোবাসা, তাদের সব কাজের প্রতি লক্ষ্য রাখা, তাদের সময় দেওয়া। পিতা-মাতা যদি উপরোক্ত কাজগুলো সঠিকভাবে পালন করে আর সন্তানের জন্য বেশি বেশি দোয়া করে, তাহলে ইনশাআল্লাহ সেই পিতা-মাতার সন্তান দুনিয়াতে আদর্শ সন্তান হবে, যা পিতা-মাতার জন্য গর্বের কারণ আর পরকালেও সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কাজ করবে।
সেই সাথে আমাদের সব সময় খেয়াল রাখতে হবে বাড়িতে সন্তানসন্তুতিরা নিয়মিত নামাজ পড়ছে কি না, কোরআন তেলাওয়াত করছে কি না। বর্তমান যুগ যেহেতু বিজ্ঞানের যুগ, তাই আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনে বর্তমান যুগে ইন্টারনেট, টিভি, ক্যাবল সংযোগ, মোবাইল ফোন ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ যেমন অহরহ সামাজিক অপকর্মে লিপ্ত হতে শুরু করে তেমন নিত্যনতুন নৈতিক পদস্খলনের শিকারও হচ্ছে। তাই এসবের খারাপ জিনিসগুলো বাদ দিয়ে ভালোকে গ্রহণ করতে হবে এবং সন্তানরা যেন খারাপ কোনো কিছুর দিকে আসক্ত না হয় সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
আল্লাহতায়ালার কাছে এই কামনাই করি, প্রতিটি পরিবারের সন্তানরা যেন প্রকৃত ইসলামের আদর্শে জীবন পরিচালনার তৌফিক লাভ করেন।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস