শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে সফলতার গল্প

ফারাজী আজমল হোসেন
ফারাজী আজমল হোসেন ফারাজী আজমল হোসেন
প্রকাশিত: ০৯:৪৪ এএম, ২৬ আগস্ট ২০২২

শিশু এবং প্রসবকালীন মৃত্যু কমানোর হারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। গত পাঁচ দশকে শিশু মৃত্যু এবং প্রসবকালে মায়েদের মৃত্যু প্রতিরোধে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করছে পশ্চিমা বিশ্ব। প্রতিবেশী ভারত বহু আগেই স্বীকার করেছে সামাজিক অন্যান্য সূচকের মতো এই দুটি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ তাদের পিছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের অনুমান অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে গড়ে ২১টি শিশু মারা যায় বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনতার পর থেকে শিশুমৃত্যুর এই হার ৮৫ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয়েছি আমরা। স্বাধীনতার সময় দেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ১৪১। সেই সময় সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের থেকে শিশুমৃত্যুর হার পশ্চিম পাকিস্তানে কম ছিল। সেখানে প্রতি হাজারে ১৩৯টি শিশুর মৃত্যু হতো। এখন বাংলাদেশের প্রতি হাজারে গড়ে ২১ শিশুর মৃত্যুর বিপরীতে পাকিস্তানে ৫৫টি শিশু মারা যায়।

শুধু শিশুমৃত্যু প্রতিরোধেই নয়, গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ দারুণ সাফল্য লাভ করেছে। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সূচকগুলিই এই তথ্য তুলে ধরছে। আন্তর্জাতিক মহলেরও প্রশংসা পাচ্ছে বাংলাদেশ। ইউনাইটেড নেশনস চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট ফান্ড বা ইউনিসেফ ৫ বছরের কম শিশুদের মৃত্যু হ্রাস করানোয় অসাধারণ সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইতিমধ্যেই এম়ডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল) অ্যাওয়ার্ড-২০১০ প্রদান করেছে।

শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে বাংলাদেশের অবদান গোটা দুনিয়াতেই এখন সমাদৃত। এটাকেই পাশ্চাত্য দুনিয়া বলছে, বাংলাদেশের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল। ইউনিসেফের পাশাপাশি অন্যান্য বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থাও স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের অসাধারণ সাফল্যের।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৯ সালেও জীবিত সন্তান প্রসবকালে প্রতি ১ লক্ষ মায়ের মধ্যে ২৬৯ জন মারা যেতেন। এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬৫। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এই হারকে ৫০-এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)-৩ একটি সার্বজনীন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রতি ১ লক্ষ জীবিত প্রসবে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০-এর কম করতে হবে। সেইসাথে নবজাতকের (এক মাসের কম বয়সী) মৃত্যু প্রতি ১ হাজারে ১২-তে কমিয়ে আনতে হবে।

৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু প্রতি হাজারে ৩৮-এ কমিয়ে আনার লক্ষ্যও রাখা হয়েছে। এই সবকিছুই অর্জন করতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। বাংলাদেশ আত্মবিশ্বাসী। ২০৩৫ সালের মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২০-তে নামিয়ে আনতে চায় শেখ হাসিনা সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সেই লক্ষ্যেই কাজ শুরু হয়েছে।

মা ও শিশুদের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠ কর্মীদের সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে। কারণ তারা গ্রামীণ জনগণের কাছে জরুরি ও প্রাথমিক চিকিৎসা পৌঁছানোর পাশাপাশি উপযুক্ত পরামর্শ দিয়ে সকলকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলছেন। ফলে মাতৃত্বকালীন এবং শিশুমৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর মাতৃস্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিশুর পুষ্টি ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার সুফলও দেশবাসী এখন ভোগ করতে শুরু করেছেন।

বিভিন্ন পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। হাসিনা সরকার সঠিক স্বাস্থ্যনীতি গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি বিষয়ক ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়। এবিষয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়। মানবিক সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর বার্ষিক 'গ্লোবাল চাইল্ডহুড রিপোর্ট ২০১৯' বলছে, গত দুই দশকে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমেছে। এ জন্য বর্তমান আওয়ামী লিগ সরকারের প্রশংসা করছে পশ্চিমা গণমাধ্যমের বড় অংশ।

ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপাল এই চার দেশের মধ্যে বাংলাদেশেই শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে দ্রুত কমছে। গত দু-দশকে ভুটানে ৬০ শতাংশ, নেপালে ৫৯ শতাংশ এবং ভারতে ৫৭ শতাংশ শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। আর বাংলাদেশে ৬৩ শতাংশ কমেছে শিশুমৃত্যুর হার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সরকার মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমাতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে। ২০১৭ সালে গর্ভাবস্থায় মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১ লক্ষে ১৭৬ থেকে কমিয়ে এখন ১৭২-এ আনা সম্ভব হয়েছে। ২০১৫ সালের প্রতি হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে ২০ জন মারা গেলেও এখন সেটা কমে হয়েছে ১৮.৪। তিনি এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকারের কল্যাণমূলক কর্মসূচির কথা উল্লেখ করেন।

তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি-র নির্ধারিত লক্ষ্য মতোই প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যুর হার ১২-র নীচে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট সমস্ত বিভাগের মধ্যে সমন্বয় রেখে দ্রুত গতিতে কাজ চলছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শিশুমৃত্যুর হার আরও কমানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশ আন্তরিক। তাঁর আশা, এসডিজির বেধে দেওয়া লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ সফল হবেই।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মতিউর রহমান জানান, দেশ জুড়ে পরিবার পরিকল্পনা পরিষেবার অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। ৩ হাজার ৩৬৪টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র থেকে মা ও শিশুরা স্বাস্থ্য সুবিধা পাচ্ছে নিয়মিত। এছাড়াও ২ হাজার ১৮৯টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ প্রসবের সুবিধা রয়েছে।

সবমিলিয়ে বাংলাদেশ সরকার গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও স্বাস্থ্য পরিষেবার বন্দোবস্ত করেছে। সেইসঙ্গে মা ও সদ্যজাতের পুষ্টির বিষয়টিও মাথায় রেখেছে সরকার। তাই সাফল্য আসছে। আর এই সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক মহল সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বকে। তার হাত ধরে অর্থনৈতিক সাফল্যও দেশকে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের অগ্রযাত্রাতেও সহায়ক হয়ে উঠেছে।

স্বাস্থ্যখাতে এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দূরদর্শী চিন্তা চেতনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহরমুখী মানুষের ঢল কমাতে প্রান্তিক পর্যায়ে উন্নয়ন ও সংযোগে গুরুত্বারোপ করেছেন। এর ফলে উন্নত হয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ খাত। বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তিক অঞ্চলে রয়েছে একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সরকারের লক্ষ্য অনুসারে প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে একজন করে ডাক্তার প্রেরণ করা হবে। সেই সঙ্গে সুযোগ সুবিধাও বাড়ানো হবে। এ ছাড়াও নারী শিক্ষা ও নারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের মাধ্যমে এখন ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে বাহিরে আসছে নারী। অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে তারা নিজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারছে, দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের কারণেই শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে আজ সফলতা এসেছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস

শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে বাংলাদেশের অবদান গোটা দুনিয়াতেই এখন সমাদৃত। এটাকেই পাশ্চাত্য দুনিয়া বলছে, বাংলাদেশের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল। ইউনিসেফের পাশাপাশি অন্যান্য বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থাও স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের অসাধারণ সাফল্যের।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।