বাংলাদেশের কাছ শেখার আছে উন্নয়নের সহজপাঠ

ফারাজী আজমল হোসেন
ফারাজী আজমল হোসেন ফারাজী আজমল হোসেন
প্রকাশিত: ০৯:৩৯ এএম, ২২ আগস্ট ২০২২

হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র তকমা ঘুচিয়েছি আমরা অনেক আগে। বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নয়ন আর কোন চমক নয়। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৈহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক তার প্রকাশিত পলিসি ম্যাগাজিন ‘হোয়াইট বোর্ড’-এ যথার্থ বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন চমকের বদলে বর্তমানে ‘বাংলাদেশ মডেল’ বলার সময় এসেছে।

বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা অনুন্নত দেশগুলোকে ‘বাংলাদেশ মডেল’ অনুসরণের কথা বলেছে। সেই তালিকায় নতুন রে যুক্ত হলেন ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমসের আফ্রিকা বিষয়ক সম্পাদক ডেভিড পিলিং। সম্প্রতি প্রকাশিক তার এক প্রতিবেদনে আফ্রিকার দেশগুলোকে বাংলাদেশকে আদর্শ উদাহরণ হিসেবে মনে করা উচিত বলে জানান।

তিনি জানান, বাংলাদেশের কাছ থেকে উন্নয়নের সহজপাঠ নিতেই পারে দুনিয়ার বহু দেশ। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বাংলাদেশ অন্যদের শেখাতে পারে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে কীভাবে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হয়। ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস’-এ এমনই মন্তব্য করেছেন ডেভিড পিলিং।

পত্রিকাটির পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৫০০ ডলারেরও কম। গড়ে ৪.৫টি সন্তান প্রসব করতেন এই দেশের নারীরা। ৪৪ শতাংশেরও বেশি মানুষ অতিদারিদ্রতার নীচে বসবাস করতেন। সেই পরিস্থিতি থেকে সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে। মাথাপিছু মোট দেশজ উতপাদন আট গুণ বেড়েছে। প্রজনন গড় এখন কমে দাঁড়িয়েছে দম্পতি পিছু ২ । ফলে শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অন্যান্য বিষয়ে আরও বেশি অর্থ খরচ করার সুবিধা পাচ্ছেন অভিভাবকরা। ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ শিল্পায়নের সুযোগ করে দিচ্ছে। ব্রিটিশ পত্রিকাটিই বলছে, অতি দারিদ্রতার নিচে বসবাসকারীদের সংখ্যা আগের তুলনায় এখন নেমে এসেছে অর্ধেকে।

পাশ্চাত্যের অভিজাত গণমাধ্যমটির মতে, নারীদের সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশে। মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে পুরুষদের তুলনায় এখন নারীরাই সংখ্যায় বেশি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় দেশে প্রতি ৫ জন শিশুর একজন ৫ বছরের কম বয়সেই মারা যেত। এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি ৩০ জনে এক।

ফিনান্সিয়াল টাইমসের সাফ কথা, কোনও দেশের উন্নয়নকে নিয়ে অতিরঞ্জিত প্রচার উচিত নয়। তারাও স্বীকার করেছে বাংলাদেশ এখনো দরিদ্র দেশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিবেশগত বিপদ এবং ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হচ্ছে দেশটিকে। অতি সম্প্রতি দেশের আর্থিক সঙ্কট নিরসনে আইএমএফের কাছে ঋান চাওয়ার বিষয়টিও তাদের নজর এড়ায়নি। কিন্তু উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। হেনরি কিসিঞ্জারের 'তলাবিহীন ঝুড়ি' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের ধারাকে যেভাবে বেগবান করতে সক্ষম হয়েছে তার প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেনি পত্রিকাটি।

ডেভিড পিলিঙের মতে, আফ্রিকার দেশগুলি কথায় কথায় দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টানে। কিন্তু সেই উদাহরন তাদের কোনও উপকার করতে পারেনি। তাই আফ্রিকার বহু দেশ বাংলাদেশের সাফল্য থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে। দেশের উন্নয়নে প্রকৃতপক্ষে কী কী করা সম্ভব তার সঠিক আভাস মিলতে পারে বাংলাদেশ থেকে।

অতীতের ব্যর্থতা ভুলে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পথপ্রদর্শক হিসেবে জাতীয় সম্ভাবনাকে তুলে ধরারও প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশ। রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর দুর্ভিক্ষ এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। অপ্রত্যাশিত ধাক্কা সামলে পদে পদে যাবতীয় ষরযন্ত্রকে রুখে দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাফল্যের বিষয়টি বড় করে দেখানো হয় বিশেষ প্রতিবেদনে।

ফিনান্সিয়াল টাইমসে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বিষয়ক অর্থনীতিবিদ স্টেফান ডারকন বাংলাদেশের উন্নয়নের পিছনে তিনটি প্রধান কারণের উল্লেখ করেছেন। প্রথমেই তিনি আলোকপাত করেন পোশাক শিল্পের ব্যাপক উন্নয়নের দিকটিতে। ১৯৮৪ সালের ৩২ মিলিয়নের পোশাক রপ্তানি বানিজ্য এখন বেড়ে ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে।

শুধু পোশাক রপ্তানি করে ২০২০ সালে বাংলাদেশ ৫৪টি আফ্রিকান দেশের মিলিত আয়ের দ্বিগুণ আয় করেছে। এরপরই বাংলাদেশের উন্নয়নের কারণ হিসাবে রেমিটেন্স আদায়ের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন স্টেফান। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা গত বছর ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। এটাও দেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। পরিশেষে, অক্সফোর্ডের এই অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ পুনর্বাসন সহায়তা কমিটি বা ব্র্যাক এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বেসরকারী সংস্থার ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেছেন। সেইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ সরকারের জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচিরও প্রশংসা করেন।

অর্থনীতিবিদ স্টেফানের 'গ্যাম্বলিং অন ডেভেলপমেন্ট' বা 'উন্নয়ন নিয়ে জুয়া' বইটিকে উদ্ধৃত করে ফিনান্সিয়াল টাইমস বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নের ক্ষেত্রে 'মহান নকশা'র কথা উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে আঘাত কম আসেনি। ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক প্রাণ হারান। তবু পোশাক শিল্পকে উতসাহিত করে চলেছে সরকার। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। ব্রিটিশ গণমাধ্যমে যাবতীয় প্রতিকূলতাকে জয় করে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি বিষয়ক জনপ্রিয় সংবাদপত্রটি রেনেসাঁ ক্যাপিটালের প্রধান অর্থনীতিবিদ চার্লি রবার্টসনের বক্তব্যও তুলে ধরেছে তাদের প্রতিবেদনে। চার্লিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পিছনে তিনটি কারণ দর্শিয়েছেন। তার মতে, সাক্ষরতা, বিদ্যুৎ এবং প্রজননই বাংলাদেশের সাফল্যের মূল ভিত্তি। 'দ্য টাইম ট্রাভেলিং ইকনোমিস্ট' বইতে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ বয়স্ক শিক্ষার হার, মাথাপিছু ৩০০ কিলোওয়াট বিদ্যুত এবং দম্পতি পিছু সন্তান ধারণের হার তিনের কম হওয়ার বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেন। তার সাফ কথা, উন্নয়নের তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ সসম্মানে উত্তীর্ণ। চার্লির মতে, বহু আফ্রিকান দেশে বয়স্ক শিক্ষার হার ৭০ শতাংশের বেশি। কিন্তু সেখানকার খুব কম দেশই তুলনামূলক কম দামে বিদ্যুত সরবরাহ করতে পারে।

গিনি বিসাউয়ের মাথাপিছু ২১ থেকে ইথিওপিয়ার ৮২ এবং নাইজেরিরায় ১৫০ বাংলাদেশের ৩০০ কিলোওয়াট বিদ্যুতের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। তিনি আরও মনে করেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দম্পতি পিছু তিনের নিচে নামাতে না পারলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে তার এই মন্তব্য যে বিতর্কিত সেটাও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। কিন্তু প্রবীণ অর্থনীতিবিদ চার্লির দাবি, পরিবারের আকার, পরিবারের সঞ্চয় এবং শিল্পের জন্য ব্যাংক ঋণের প্রাপ্যতা ও সামর্থ্যের মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। নাইজেরিয়ায় ১২ শতাংশের বিপরীতে বাংলাদেশের জিডিপিতে ঋণের হার ৩৯ শতাংশ এবং নাইজেরিয়ার ৫.২ প্রজনন হারের বিপরীতে বাংলাদেশের হার মাত্র ২, এই উদাহরণও তুলে ধরেন তিনি।

ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, আফ্রিকান দেশগুলির মধ্যে বতসোয়ানা, মরিশাস, মরক্কো এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রজননের হার ৩ শতাংশের কম। এই দেশগুলিই আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে ধনী দেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে অর্থনীতিবিদরা তর্ক করলেও এই দুইয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কিন্তু বেশ শক্তিশালী। আফ্রিকার বাকি অংশে মধ্যম আয়ের দেশ কেনিয়ার প্রজনন হার ৩.৪ এবং বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ নাইজারের প্রজনন হার দম্পতি পিছু ৬.৭ ।

যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমটি ১৯৭৫ সালের দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার তুলনা টেনেছে। সেইসময় দক্ষিণ আফ্রিকার উন্নয়নের চেষ্টাকে অনেকে দিবাস্বপ্ন বলে ব্যঙ্গ করতেন। ডেভিড পিলিঙের মতে, সৎ এবং অগ্রগামী সরকার নিঃসন্দেহে যেকোনও দেশের উন্নয়নে সাহায্য করে। বাংলাদেশ উন্নয়নের জটিল পথ সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় অতিক্রম করে চলেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যমটি দেশের এই অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টার পাশাপাশি স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে নানাধরনের ষড়যন্ত্রকে কাটিয়ে ওঠার বিষয়টিও উল্লেখ করেছে। উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করা হয়েছে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অনেকে সমালোচনা করে বলেছেন, এই উন্নয়ন ফাঁপা এবং দিন শেষে টিকবে না। কিন্তু উন্নয়নের অব্যাহত যাত্রা বজায় রেখে সকল সমালোচকের মুখ বন্ধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কোন সমালোচককে চাপ দিয়ে তার বক্তব্য বন্ধ করাননি। কিন্তু বিগত ১২ বছরে তার অনেক সমালোচক ধীরে ধীরে তার প্রশংসা শুরু করেছেন। কেননা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাবার ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ নির্মাণের যেই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, সেই পথে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে গেছেন।

সকল সমালোচনাকে ধারণ করে তিনি বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। আর যারা শুধু রাজনৈতিক ফায়দার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করেন, তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে কোন কিছুই করতে পারেন। কিন্তু সকল ষড়যন্ত্র ও সমালোচনা পাশ কাটিয়ে ঠিকই কাজ করে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস

বাংলাদেশ উন্নয়নের জটিল পথ সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় অতিক্রম করে চলেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যমটি দেশের এই অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টার পাশাপাশি স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে নানাধরনের ষড়যন্ত্রকে কাটিয়ে ওঠার বিষয়টিও উল্লেখ করেছে। উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করা হয়েছে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।