তরুণদের বহির্গমন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ২০ আগস্ট ২০২২

আমার সাথে অনেক তরুণ তরুণীর কথা হয়। পড়াতে গেলে ক্যাম্পাসে বা নানা ইভেন্ট ও আড্ডায়। বড় অংশটিই চায় একটি সরকারি পাকা চাকরি। এটাই এখন জীবনের মূল্য লক্ষ্য। একটা যে কোন মানের সরকারি চাকরি জুটলেই যেন নিশ্চিত জীবন, অর্থ, বিত্ত, সুযোগ সুবিধার কোনো অভাব থাকবে না। তবে মেধাবীদের বড় চাওয়া ভালো কাজের পরিবেশ। বাকিদের জন্য কেবল জীবন চালিয়ে নেওয়া। এই কিছুদিন আগেও যেটা দেখিনি সেটা ইদানীং দেখছি। বেশিরভাগ চায় দেশ ত্যাগ করতে। এমন নয় যে, তাদের সবাই এদেশে আর্থিক ও সামাজিকভাবে খারাপ আছে। ভালো চাকরি বা ব্যবসা, সচ্ছল জীবন কিন্তু তবু চলে যাওয়ার তাড়া।

লোভনীয় বৃত্তিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিয়ে ছাত্রাবস্থায় অনেকেই যাচ্ছে উন্নত দেশে। শিক্ষাজীবন শেষে তাদের লোভনীয় চাকরির ব্যবস্থাও আছে সেসব দেশে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের যাওয়াটা অনেকদিন ধরেই দেখছি। এখন দেখছি মেধাবী কর্মীরা চলে যাচ্ছে। বড় কারণ অর্থনীতি। বাংলাদেশ গত দুই যুগেরও বেশি সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে বড় সাফল্য দেখিয়েছে।

দেশে অনেক উন্নত স্থাপনা নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রযুক্তিগত বিকাশের ফলে অনেক ধরনের ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শ্রমবাজারে যত মানুষ প্রবেশ করছে তত কাজ নেই, তত ব্যবসা নেই। এবং বড় প্রবৃদ্ধির আড়ালে আয়বৈষম্য সাধারণ মানুষকে বড় চাপে ফেলে রেখেছে বহুদিন ধরে।

ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপ মূলত দুই চেহারায় অবতীর্ণ হচ্ছে। একদিকে তরুণদের একটা অংশ দ্রুত ধনী হয়ে যাচ্ছে যারা ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে ঢুকে যেতে পারছে। তারা ক্ষমতাবান হয়ে ব্যবসা, বাণিজ্য, চাকরি সব দখলে নিয়ে ফেলছে। এটা দেখে অন্যরা হতাশায় ডুবছে। বৈষম্যের চেহারাটা বড় কদর্য হয়ে এখন তার রূপ দেখাচ্ছে। যারা বলেন, শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হতে হবে, সেখানেও ভিন্ন অবস্থা আছে। অনেকে পারছে, কিন্তু বড় অংশই পারছে না। একদিকে অর্থায়নের সংকট আরেক দিকে দুর্নীতি। ব্যবসা মানেই সরকারি দপ্তরের দুর্নীতির সংস্কৃতি মেনে চলা। এটা অনেকের পক্ষেই আর সম্ভব হয় না।

সমাজের ঐক্যের চেহারাটা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শুধু আয়ের অনৈক্য নয়, যে জিনিসগুলো আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড়, সেগুলোর ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। উন্নয়ন অবশ্যই হয়েছে। জাতীয় আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, দারিদ্র্যের সংখ্যা যেটুকু কমেছিল, সেটা করোনা কালে আবার বেড়েছে এবং বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বাড়ায় সেটা বেড়েই চলেছে। এমনিতেই জনপরিষেবার অবস্থা আমাদের দেশে খুব ভালো নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তার মতো ব্যাপারগুলোতে খুব বড় রকম বৈষম্য বহুদিনের। অর্থনীতি টালমাটাল হলে সেটা আরও বাড়ে।

কথা বললেই হতাশা প্রকাশ করে এখনকার তরুণ তরুণীরা। দীর্ঘক্ষণ কথা বললেই টের পাওয়া যায় ক্রমশ এক অব্যক্ত বেদনার অভিব্যক্তিতে তারা অস্থির হয়ে উঠছে। শুধু আর্থিক চাপ নয়, বিভাজিত রাজনীতি, সমাজের বিকাশমান সাম্প্রদায়িকতা ও গোড়ামি, মানুষের কল্যাণ ভাবনাহীন শাসন ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ পায় তাদের কথায়। পোশাক, চলাচল নিয়ে যে পশ্চাৎপদ সহিংস দৃষ্টিভঙ্গির চেহারা দেখা যাচ্ছে এতে করে তরুণীরা আরও বেশি চিন্তিত তাদের জীবন নিয়ে।

নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর অনেকেই বিদেশের বড় আয়ের সুযোগ ছেড়ে দেশে ফিরেছিলেন। তারাও আজ হতাশ। দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশগামীদের অনেককেই আটকাতে ভূমিকা রেখেছে। এখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। প্রচুর ছেলেমেয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে পড়তে এবং অনেকেই আর ফিরছে না।

এটি বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি। এর চেয়েও বড় ক্ষতি দেশের মেধাবী সন্তানদের আমরা হারিয়ে ফেলছি। এটা একটা বড় জাতীয় সমস্যা। আমাদের ছেলেমেয়েরা কেন বিদেশে পড়তে যাচ্ছে? কেন তারা পড়ালেখা শেষ করে আর দেশে ফিরছে না?

উত্তর সবার জানা। মেধাবীরা বৃত্তি পেলে উন্নত দেশে উন্নত মানের উচ্চশিক্ষা নিতে যাবেই। যারা বৃত্তি পায় না, তাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকলে নিজের খরচে পড়তে যাচ্ছে। এদেশে উচ্চশিক্ষার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ নেই। আমাদের কোনো সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র‌্যাংকিং নেই। শিক্ষার মান নিম্নগামী। ক্যাম্পাসগুলোতে অসুস্থ পরিবেশ।

অস্থিরতা, রাজনৈতিক হানাহানি, এমনকি টর্চার সেলের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। খুন ও ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। এসব নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাই তারা নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়েও চেষ্টা করছেন সন্তানের কল্যাণ নিশ্চিত করতে। উন্নত দেশে দামি ডিগ্রি নিয়ে সেসব দেশেই ভালো কাজ পেলে কেউ দেশে ফিরতে চায় না।

এটা হলো যারা পড়তে যাচ্ছে তাদের কথা। কিন্তু এখানে ভালো চাকরি, বড় বেতন, উন্নত জীবন থাকার পরও কেন যেতে চায় তরুণরা? অনেকেই বলে, উন্নত দেশে করদাতা হিসেবে একজন মানুষের মর্যাদা আছে। ‘একজন বেতনভোগী হিসেবে আমি অনেক টাকা কর দেই। কিন্তু কী পাই আমি দেশ থেকে? সামান্য নাগরিক মর্যাদা নেই।

ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরের যে কেউ যখন তখন আ্মাকে অপমান করতে পারে, আমাকে নিগ্রহ করতে পারে, এমনকি ধরেও নিয়ে যেতে পারে’, এ কথা বলেছেন এক তরুণ যে প্রায় তিন লাখ টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে এখন আমেরিকার পথে। আরেকটি বড় ভাবনা সন্তানের ভালো শিক্ষা, শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ও বয়সকালে নিজেদের চিকিৎসা।

বড় খরচ ছাড়া এর কোনোটিই এখানে নেই বলে তারা মনে করে। ভালো স্কুল মানেই হাজার হাজার টাকা টিউশন ফি। আর চিকিৎসা মানেই বাণিজ্যিক বেসরকারি হাসপাতাল। চিকিৎসা ব্যবস্থা চলে গেছে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে। আজ পর্যন্ত দেশ তার নাগরিকদের জন্য একটা স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবিমা প্রথা চালু করতে পারল না। উন্নত ধনী দেশেও সরকারি হাসপাতাল নির্ভরতার প্রতীক। আর আমাদের দেশে ঠিক উল্টো। লোকের ধারণা হয়েছে যে, বড় বড় বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালেই শ্রেষ্ঠ চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে যেটা তার আয়ত্বের মধ্যে নেই।

জনকল্যাণের যে মানসিকতা শাসন ব্যবস্থায় দরকার সেটা অনুপস্থিত। তরুণ সমাজ দেখছে সরকারি কোনো সিদ্ধান্তই সাধারণ মানুষের ভাবনা ভেবে নেওয়া হয় না। জ্বালানি ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো, পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর কোনোটিতেই যে মানুষকে ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি সেটা স্পষ্ট তাদের কাছে। আন্তর্জাতিক বাজারের গণিত দিয়ে তাদের বোঝানো যায় না, কারণ তারা সব বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য হাতে রাখে।

আমাদের শাসন ব্যবস্থা দুটি পৃথক জনগোষ্ঠীর জন্ম দিয়ে চলেছে যেন এক দেশের ভেতর আরেকটি দেশ। এক পক্ষে আছে সামাজিক মর্যাদা আর প্রাচুর্যের অঢেল সুযোগ, আরেক পক্ষে কেবল হীনম্মন্যতা আর হতাশা। তারুণ্য হতাশা চায় না।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

আমাদের শাসন ব্যবস্থা দুটি পৃথক জনগোষ্ঠীর জন্ম দিয়ে চলেছে যেন এক দেশের ভেতর আরেকটি দেশ। এক পক্ষে আছে সামাজিক মর্যাদা আর প্রাচুর্যের অঢেল সুযোগ, আরেক পক্ষে কেবল হীনম্মন্যতা আর হতাশা। তারুণ্য হতাশা চায় না

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।