পঁচাত্তরের আগস্টে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ

ইয়াহিয়া নয়ন
ইয়াহিয়া নয়ন ইয়াহিয়া নয়ন , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ১৬ আগস্ট ২০২২

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল ৬টায় বাঙালি জাতিকে বেতারে শুনতে হয়েছিল এই ঘোষণা ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ জাতির জনককে হত্যার খবরের সঙ্গে সামরিক শাসন ও কারফিউ জারির ঘোষণাও দেওয়া হয়। বঙ্গভবন, শাহবাগের বেতার কেন্দ্র এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ট্যাংক ও মেশিনগান নিয়ে অবস্থান নেয় খুনিচক্রের অনুসারী সেনা সদস্যরা।

সারাদেশে ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান নেয় সেনারা। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় বাকশাল ও এর সব অঙ্গ সংগঠন। রাজনীতি নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ সভা-সমাবেশ-মিছিল। রাতে কারফিউ। দিনে সেনা টহল। রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড় শুরু হয়। সারাদেশে তৈরি হয় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। সংবাদপত্রের ওপর আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। খবরাখবর জানার মাধ্যম তখন কেবল বেতার।

সরকারি বেতারে চলতে থাকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বিরামহীন অপপ্রচার ও কুৎসা রটনা। সামরিক নিষেধাজ্ঞা অমান্যের শাস্তির বিধান স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে। ভারতকে জড়িয়েও শুরু হয় নানা প্রচারণা। সারাদেশে নানা গুজব ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখনো বঙ্গবন্ধুর লাশ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে। দুপুর ১টায় বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভারই সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। মুজিবকোট পরে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার কিছু সদস্য মোশতাক মন্ত্রিসভায় শপথ গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী পরিস্থিতি ও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সম্পর্কে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন (তখন বাকশালের ছাত্র সংগঠন ছিল জাতীয় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে ছিল এই সংগঠন) নেতা, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রত্যক্ষ প্রতিবাদকারী, বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা নূহ-উল-আলম লেনিন সেই ঘটনা নিয়ে প্রণীত গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘পনের আগস্টের ঘটনার আকস্মিকতায় নেতারা হতবিহ্বল ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কথা বলতে রাজি হননি। কেউ কেউ আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

তাৎক্ষণিক মোকাবিলার নির্দেশ দিতে, ভরসা দিতে, সাহস দিতে তাঁরা ছিলেন অক্ষম। অথচ মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা পাকিস্তানি হানাদারদের সর্বাত্মক আক্রমণ, গণহত্যা ও মৃত্যু পরোয়ানাকে উপেক্ষা করে প্রতিরোধে জাগিয়ে তুলেছিলেন সমগ্র বাঙালি জাতিকে, এখন সুড়সুড় করে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদান করে অথবা প্রতিরোধের চেষ্টা না করে আত্মরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে চরম মেরুদণ্ডহীনতার পরিচয় দেবেন এটা কেউ কল্পনা করতে পারেননি। তবে এটাও সত্য, এমন পাশব হিংস্র হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে, বঙ্গবন্ধুকে তাঁরই মন্ত্রিসভার সদস্য ও দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সহকর্মীদের কেউ হত্যা করতে পারে, সেও ছিল সবার ধারণার বাইরে। এ অবস্থায় একদিকে দল ও নেতৃত্ব অপ্রস্তুত, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ঘটনার আকস্মিকতায় এবং হিংস্রতার ভয়াবহতম রূপ দেখে ভীত ও বিহ্বল হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সহকর্মীদেরই মোশতাকের নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় শপথ নিতে দেখে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের মধ্যে হতাশা ও বিভ্রান্তি দেখা দেয়। তারা নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিরস্ত্র হয়ে পড়ে। ফলে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ তেমন দেখা যায়নি।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে যে রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল তা প্রতিবাদ করার মতো অনুকূলে ছিল না। গোটা জাতি বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। মানুষ ভাবতে পারেনি একাত্তরের পর আরেকটি গণহত্যা সংঘটিত হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষকে কেউ হত্যা করতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিচক্রই ক্ষমতায় ছিল। মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে প্রকৃত ঘটনা বুঝে উঠতে পারেনি। ফলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ তেমন হয়নি। তবে মানুষ যখন অনুধাবন করতে পেরেছে তখনই বিচ্ছিন্নভাবে হলেও প্রতিবাদ করেছে। সেই প্রতিবাদের কথা অনেকেরই জানা নেই।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোররাতের হঠাৎ বিভীষিকা গোটা জাতিকে দিশাহারা করে দিলেও থামিয়ে রাখতে পারেনি প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। চরম প্রতিকূল পরিবেশে খুনিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই বিভিন্ন জায়গায় বহু মানুষ নেমে আসে রাস্তায়; বজ্রকণ্ঠে জানায় প্রতিবাদ, ঘৃণা। জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ আর ঘাতকদের প্রতিরোধে আরেক যুদ্ধের প্রস্তুতিও চলে অনেক জায়গায়; অচিরেই শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ আন্দোলন। ১৫ আগস্ট সকালেই সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ হয় বরগুনা, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, খুলনা, যশোর, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ ও ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে।

প্রতিশোধ-প্রতিরোধের ডাক দিয়ে জীবন উৎসর্গ করে শতাধিক তরুণ। কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে হয়, নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে হয় সারাদেশের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে। ফাঁসির দণ্ডের মুখোমুখিও হতে হয় প্রতিবাদকারীকে।

১৫ আগস্ট সকালেই বরগুনায় বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মোশতাক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে এই প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন বরগুনা মহকুমা প্রশাসক, পরবর্তীসময়ে সরকারের সচিব সিরাজুদ্দিন আহমেদ। তিনি তার বাসভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখেন। ১৫ আগস্ট সকালে কিশোরগঞ্জ শহরের গৌরাঙ্গবাজারে জেলা ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয় থেকে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে বের হয় বিক্ষোভ মিছিল। মিছিল শেষে সভা করতে গেলে তা পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে যায়।

১৫ আগস্ট সকালেই প্রতিবাদ সভা ও গায়েবানা জানাজা হয়েছিল নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। এরপর সেখানে নেমে এসেছিল নারকীয় নির্যাতন। খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজের ছাত্রলীগের কর্মীরা ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল করে। বিকেলেও প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৬ আগস্টও দৌলতপুর-খালিশপুর এলাকায় মিছিল হয়। খুলনার ছাত্র ইউনিয়ন বিক্ষোভ মিছিল, লিফলেট বিতরণ ও পোস্টারিং করে। বিএল কলেজে লিফলেট বিতরণ করতে গিয়ে আটক হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা পরে সাংবাদিক মানিক সাহা, যিনি আঁততায়ীর দ্বারা নিহত হয়েছেন।

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ১৭ আগস্ট থেকে শুরু হয় প্রতিবাদ মিছিল। সরকারি দপ্তরে উত্তোলন করা হয় কালো পতাকা। ফলে শুরু হয় সরকারি বাহিনীর নির্যাতন। দীর্ঘ নির্যাতনের পর কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয় কয়েকজন। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ৩০ আগস্ট যশোর ঈদগাহ ময়দানে বঙ্গবন্ধুর গায়েবানা জানাজার আয়োজন করেন যশোর-২ আসনের সংসদ সদস্য আবুল ইসলাম। আগস্টেই তিনি হেঁটে টুঙ্গিপাড়া গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করেন। এ কারণে তাকে জেল খাটতে হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে পরের বছর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী পালনেও বাধা দেওয়া হয়েছিল। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর স্মরণে মিলাদ মাহফিল ও কোরআন খতমের আয়োজন করার কারণে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ২২ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়।

১৫ আগস্ট ছাত্রনেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিবাদের চেষ্টা করলেও সেনা সদস্যদের কড়া টহলের কারণে ব্যর্থ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতিবাদ হয় দেড় মাস পর বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর। ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি দিবস’ ঘোষণা করে কর্মসূচি পালন করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন।

আগস্ট মাসেই কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সশস্ত্র প্রতিরোধ। গঠিত হয় জাতীয় মুক্তিবাহিনী। এতে অংশ নিয়ে আত্মাহুতি দেয় শতাধিক দ্রোহি তরুণ। রাষ্ট্রদ্রোহি মামলার হয়রানির শিকার হয় প্রায় ছয় হাজার প্রতিরোধ যোদ্ধা। নজিরবিহীন কড়াকড়ি আর সামরিক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই এসব প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা কবিরুল ইসলাম বেগ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তিবাহিনীতে। তিনি ডুমনীকুড়া ক্যাম্পের ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময়কালে জাতীয় ফুটবল দল ছিল মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের মারদেকা টুর্নামেন্টে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পুত্র আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের হত্যাকাণ্ডের খবর গেলে তৎকালীন আবাহনী দলের খেলোয়াড় সালাহউদ্দিন, চুন্নুদের উদ্যোগে বাংলাদেশের খেলার দিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। খেলার শুরুতে খেলোয়াড়রা এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।

বঙ্গবন্ধুর বাসভবন অফিসের কর্মকর্তা মুহিতুল ইসলামের জীবদ্দশায় দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা রুজু করতে লালবাগ থানায় গিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালের ২৩ অক্টোবর। কিন্তু এজাহারের বিবরণ শুনে মামলা না নিয়ে ডিউটি অফিসার মুহিতুল ইসলামের গালে থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন, ‘তুইও মরবি, আমাদেরও মারবি।’

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/ফারুক/এমএস

বঙ্গবন্ধুর বাসভবন অফিসের কর্মকর্তা মুহিতুল ইসলামের জীবদ্দশায় দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা রুজু করতে লালবাগ থানায় গিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালের ২৩ অক্টোবর। কিন্তু এজাহারের বিবরণ শুনে মামলা না নিয়ে ডিউটি অফিসার মুহিতুল ইসলামের গালে থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন, ‘তুইও মরবি, আমাদেরও মারবি।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।