বেপরোয়াই থেকে গেল গণপরিবহন
যতবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে ততবার এই পরিবহন মালিকরা মানুষকে জিম্মি করে, সরকারকে জিম্মি করে এবং সড়কে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতিটি ইস্যুতে মানুষ বিরোধী গণপরিবহন খাতের ব্যাপারে সরকারের নমনীয় মনোভাব ও তাদের প্রতি সব ধরনের প্রশ্রয় লক্ষ্যণীয়। এবং এ কারণেই তারা জেলা শহরে সরকারি বাস কোম্পানি বিআরটিসির গাড়ি আটকে যাত্রীদের পথের মাঝে নামিয়ে দিতে পারে, সরকারি গাড়ির চালকদের হুমকি দিতে পারে।
সম্প্রতি ফরিদপুরে এই ঘটনা ঘটেছে এবং সড়ক পরিবহন ও মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এই পরিবহন দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশে পরিবহন খাত একমাত্র ব্যবসা যার কোন লোকসান নেই, কারণ পথে নামলেই অসংখ্য মানুষ। একমাত্র ব্যবসা যেখানে মালিক শ্রমিক ভয়ংকর ঐক্য বিরাজমান নৈরাজ্য আর উচ্ছৃঙ্খলতার পক্ষে এবং তাদের প্রতি ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর অবস্থানকারী বড় মানুষরা বরাবরই নমনীয় মনোভাব দেখিয়ে আসছেন।
সরকার হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে। এর প্রভাব জনজীবনের প্রতিটি স্তরে পড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বড়েছে, সেবার মূল্য এখন হাতছাড়া। চিকিৎসা ব্যয় মানুষের আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে। পড়ালেখার খরচও আকাশ ছোঁয়া। তবে কোথাও কোন নৈরাজ্য হয়নি। হয়েছে পরিবহন খাতে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার স্বল্পতম সময়ে সরকার বাস ভাড়া বাড়িয়েছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বাস ভাড়া সম্ভাব্য কত বাড়তে পারে, তার একটা হিসাব দিয়েছিল। তাতে মহানগরে ১৩ ভাগ এবং দূরপাল্লায় ১৬ ভাগ ব্যয় বাড়বে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভাড়া বেড়েছে যথাক্রমে ১৬ ও ২২ শতাংশ। কিন্তু বাস মালিকরা নিচ্ছেন তার চেয়ে বেশি আর পরিবহন শ্রমিকরা মানুষের পকেট থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে তার চেয়েও বেশি।
তেলের দাম বাড়লেই মালিকরা নানান আজগুবি খরচের হিসাব নিয়ে আসেন। টায়ার-টিউব, রক্ষণাবেক্ষণের বিশাল খরচের বহর দেখিয়ে বাস ভাড়া বাড়িয়ে নিতে চান মালিকরা। অথচ ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর বাসের চেহারা দেখলে কেউ বলবে না এরা বাসের কোন যত্ন নেয়। অবস্থাটা এমনই যে, সিএনজির দাম না বাড়লেও এই সুযোগে সিএনজিচালিত বাস ও স্কুটারের ভাড়াও বেড়েছে। এরা এত নির্লজ্জ যে সিএনজির দাম বাড়লে ডিজেলচালিত বাসের ভাড়াও বাড়িয়ে দেয়।
সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেটা কার্যকর হলো না, অথচ মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ কিছুই বলছে না। এ কারণেই অনেকে বলেন, পরিবহন খাত হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মাফিয়া। তারা বারবার জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায় করে, সেটা ভাড়ার ক্ষেত্রেই হোক আর নতুন আইনের ক্ষেত্রেই হোক।
বলা হয় প্রকৃত ব্যবসায়ীদের হাতে নেই পরিবহন খাত। মালিক শ্রমিকদের বড় অংশই রাজনৈতিক নেতা। এবং এখানে সরকারি, বিরোধী এমনকি বামপন্থী নেতারাও ঐক্যবদ্ধ। আর এ কারণেই পরিবহনে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়ছে। এ খাতে চলমান নৈরাজ্যের নেপথ্যে এই রাজনীতিই বড় প্রভাব রাখছে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন কোন সদস্য ও তাদের পরিবারের মালিকানায় বেশিরভাগ পরিবহন। এবং এ কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে কারণ ক্ষমতার জোরে এরা ট্রাফিক আইন মানে না।
ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর এদের বসবাস, তাই রাজনৈতিক আধিপত্য লক্ষ্যণীয়। আর এ কারণেই পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরছে না। মানা হচ্ছে না সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কোন নিয়মনীতি। ফলে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। মালিকদের প্রভাবে চালকরাও বেপরোয়া। সেইসঙ্গে আইনের দুর্বলতায় দুর্বল শাস্তির বিষয়তো রয়েছেই। অনেকের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাবেই মিলছে যানবাহনের সহজ রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস ও রুট পারমিট।
বিভিন্ন রুটে আধিপত্য বিস্তারের কাজ করছেন তারাই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রুট নির্ধারণ, সিটিং সার্ভিসে ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানিরও অন্যতম কারণ পরিবহন মালিকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং সেই ক্ষমতা প্রদর্শন। বাস ভাড়ার পর এখন লঞ্চ ভাড়া বাড়ছে। কিন্তু সেখানেও সেবা বলে কিছু নেই। ট্রেন ভাড়া বাড়ানো ভাবনার কথাও জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী।
গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকেই সড়কে নৈরাজ্য। বেসরকারি বাসে বেপরোয়া ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। মানা হচ্ছে না কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম। অভিযোগ করার ব্যবস্থাও জানা নেই মানুষের। যত কর্তৃপক্ষ আছে তারা মানুষের কষ্ট দেখছেও না, শুনছেও না। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, জ্বালানি তেলের বিশ্ববাজারের সহনীয় হলে দেশেও কমানো হবে যদিও বিশ্ববাজারের যখন কমছে তখনই সরকার বাড়িয়েছে।
যাই হোক, যদি জ্বালানি তেলের দাম কমেও অবস্থাটা এমন যে, জ্বালানির দাম কমলেও গণপরিবহনের ভাড়া কমানো হবে না এবং বিআরটিএ তখনও চুপ করেই থাকবে। সড়ক মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ’র কাছে জানতে চাই- ভাড়ার তালিকা সব বাসে লাগানো রয়েছে কি? সরকারের বেঁধে দেওয়া বা নির্ধারিত ভাড়া কি নিচ্ছে বেসরকারি বাস? যাত্রীদের অভিযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? কোথাও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না– এ কথাটা কি নিশ্চিত করবেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান?
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
এইচআর/এমএস