জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ফেসবুক স্ট্যাটাস ও একদল নির্বোধের কাহিনি

জ্বালানি তেলের দাম সহসা লাফ দেওয়ায় দেশজুড়ে যে কিছুটা অস্থিরতা সেটা বলাই বাহুল্য এবং প্রত্যাশিতও। এতদিন আমরা শুনে আসছিলাম সাতসাগর পারের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচ লেগেছে ইউরোপে। বেড়েছে খাবার-দাবারসহ সবকিছুর দামই এবং সাথে অবশ্যই জ্বালানিরও। পড়েছি আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে জেনেছি রাশিয়াকে বর্শির টোপ গিলিয়ে এখন একই পরিস্থিতির শিকার খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।

বুমেরাংয়ের আঘাতে ধরাশায়ী মার্কিনিরা আর সাথে তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা। শোনা যাচ্ছিল এ আঁচ এসে লাগবে আমাদের ঘরেও। পাকিস্তানের টালমাটাল অবস্থা তো আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। মুদ্রাস্ফীতি গিয়ে ঠেকেছে আকাশে। দেউলিয়া প্রায় পাকিস্তান সরকার শ্রীলঙ্কার মতো সুনামি ঠেকাতে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি। তারপরও শেষ রক্ষা হবে কি না বলা মুশকিল।

জ্বালানির দাম বেড়েছে প্রতিবেশী ভারত আর নেপালেও। তারপরও আমরা আশায় ছিলাম, আশা করি আমরা পার পেয়ে যাব। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার সরকার প্রতি বছর তেল আর গ্যাসে ভর্তুকি দেয় অর্ধলাখ কোটি টাকা। বসে খেলে তো রাজার ভাণ্ডারও ফুরায়। আমরা যদি সময় মতো সচেতন না হই তাহলে শকুনের দোয়ায় গরু মরতে কতক্ষণ?

বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হোক এ আশায় বুক তো বেঁধেছে অনেকেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আঁচটা যখন শেষমেশ ঘরে এসে লাগলই তখন মানুষকে হাজারো মিথ্যা বুঝিয়ে শ্রীলঙ্কার মতো আন্দোলনের দিবা স্বপ্নে মগ্ন এখন এদেশের একদল ‘সো কল্ড’ রাজনৈতিক নেতা আর সুশীল।

দুই.
জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বলছেন- লিখছেন অনেকেই। মাননীয় জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটি ব্যাখ্যা ভাইরালও হয়েছে। এ নিয়ে আরও বেশি লিখে এই লেখাটাকে সংখ্যা আর গণিতে ভরিয়ে তোলার আগ্রহ আমার ন্যূনতম। প্রকৌশলী পিতার সন্তান হয়েও আমার চিকিৎসা পেশাকে বেছে নেওয়ার একটা বড় অনুপ্রেরণাই ছিল সংখ্যার প্রতি আমার অনীহা।

তারপরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্ট আলোচনায় না আনলেই নয়। জয় লিখছেন যে, মূল্যবৃদ্ধির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম ছিল কলকাতার চেয়ে প্রায় ৩৪ টাকা আর পেট্রলের ক্ষেত্রে প্রায় ৪৪ টাকা কম। একইভাবে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় তো বটেই, এমনকি তেল রপ্তানিকারক আরব আমিরাতের চেয়েও এই দামগুলো ছিল অনেক কম।

জয় আশ্বস্ত করছেন আওয়ামী লীগের জনবান্ধব সরকার একান্ত নিরুপায় হয়েই এই দাম বাড়ানোর পথে হেঁটেছেন আর বিশ্ব বাজারে পরিস্থিতি ঘুরতে শুরু করলে তা পুনরায় কমিয়ে আনতেও এই সরকার একদমই দেরি করবে না। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, এর আগেও ২০১৬ সালের এপ্রিলে সরকার তেলের মূল্য এক দফা কমিয়ে ছিল। এর চেয়ে স্বস্তির সংবাদ এই মুহূর্তে আর কি-ই বা হতে পারে?

তিন.
কথা হচ্ছিল একজন আইনজীবীর সাথে। পেশার কারণেই নানান শ্রেণির মানুষের সাথে তার ওঠাবসা। বলছিলেন রিকশায় চড়তে গিয়ে তার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা। রিকশাওয়ালা ফেসবুক দেখা বিদ্যায় তাকে বুঝিয়েছেন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোটা কতটা যৌক্তিক ছিল। বাড়তি এই খরচের ধাক্কা সেই রিকশাওয়ালা এখন সামলাচ্ছেন ভাড়াটা গড়ে পাঁচ-দশ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে।

তিনি খুব ভালোই বোঝেন অর্থনীতির এই ক্রান্তিলগ্নে জ্বালানির দাম না বাড়িয়ে মানুষকে খুশি করার মতো সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনে যদি সরকার ছুটতো, তাহলে আমাদের অবস্থা যে শ্রীলঙ্কার চেয়ে ভালো কিছু হতো না এ কথাও এই আইনজীবী ভদ্রলোক শুনেছেন ওই রিকশাওয়ালার মুখেই।

সবচেয়ে যা দারুণ তা হলো, রিকশাওয়ালা তাকে বলেছেন আইএমএফএর কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেওয়ায় আমাদের সরকারের সামনে এর চেয়ে ভালো বিকল্প আর কিছু ছিল না। বুঝুন! আর এমন সমঝদার জাতিকে কি না বোকা বানাতে চায় ওই বোকার দল!

চার.
কদিন আগে কবিতা ক্যাফেতে গিয়েছিলাম এক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে মাসকো সুজের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। এরই মধ্যে সাঝ গড়িয়েছে। গাড়ি আসছে না দেখে বারবার ঘড়িতে চোখ বুলাচ্ছি। চেম্বারে পৌঁছানোর একটা তাড়াতো আছেই। স্লোগান শুনতেই বুঝলাম দেরির কারণটা। খেয়াল করছিলাম ‘একদা বাম আর হালের ডানের চেয়েও বেশি ডান’ এক নেতা পাশেই দাঁড়িয়ে বারবার ঘড়ি দেখছেন।

ভাবছিলাম আমার মতোই বোধহয় তিনিও গাড়ির অপেক্ষায়। হারিকেন হাতে জনা বিশেক ভ্রষ্ট লোকের সরকারের পতনপ্রত্যাশী স্লোগানে বুঝলাম এই নষ্ট বামের অস্থিরতার কারণ। ল্যাম্পপোস্টের ঝকঝকে আলোয় এলিফ্যান্ট রোডে বিকট জ্যাম বাঁধিয়ে হারিকেন হাতে সরকারকে আরও এক দফা ফেলে দিয়ে মিছিলটা মোড় ঘুরতেই ভদ্রলোক উধাও। আমার গাড়িও পৌঁছে গেছে ততক্ষণে। অতএব আমিও চেম্বারের পথে।

পাঁচ.
চেম্বারে যাওয়ার পথে এলিফ্যান্ট রোডের জ্যামে বসে ভাবছিলাম, গত দুটো নির্বাচনে মানুষ তো এদের হাতে হারিকেন ধরিয়েই দিয়েছে। খামোখা হারিকেন হাতে মিছিলের দুর্বুদ্ধি এদের হলো কেন? কেন হলো জানি না, তবে তাদের ধন্যবাদটুকু না দিয়ে পারছি না। বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি হিসেবে আমাদের দুর্নাম কম নয়। বিএনপি আমলে বিদ্যুতের দাবিতে জনরোষে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দৌড়ে পালানো আর নিরীহ মানুষের ওপর পুলিশের গুলির কথা আমরা তো বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম।

জ্যামে বসে যখন নিজের রক্তচাপের পারদটা ঊর্ধ্বমুখী, তখন উপরে থুতু ছুড়ে সেই থুতু নিজের মুখে মাখানোর জন্য অমন নির্বোধদের নির্বুদ্ধিতা উপভোগে সময় কাটানোটা বেশ উপভোগ্যই মনে হচ্ছে।

লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি হিসেবে আমাদের দুর্নাম কম নয়। বিএনপি আমলে বিদ্যুতের দাবিতে জনরোষে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দৌড়ে পালানো আর নিরীহ মানুষের ওপর পুলিশের গুলির কথা আমরা তো বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।