গতি, দুর্গতির চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন

ড. মতিউর রহমান
ড. মতিউর রহমান ড. মতিউর রহমান , গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ১৩ জুলাই ২০২২

মানব সভ্যতার ইতিহসে তিনটি বড় শিল্পবিপ্লব গোটা দুনিয়ার গতিপথ ব্যাপকভাবে পাল্টে দিয়েছিল। প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। বিদ্যুতের আবিষ্কার হয় ১৮৭০ সালে যার ফলে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ত্বরান্বিত হয় এবং তৃতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার ও ১৯৯০ সালে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার অবমুক্ত করার মাধ্যমে। ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তবে আগের তিনটি শিল্পবিপ্লবকে ছাড়িয়ে গেছে আজকের যুগের ডিজিটাল বিপ্লব যাকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হিসেবেও গণ্য করা হচ্ছে।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইন্টারনেট আবিষ্কারের ফলে নানা ধরনের হার্ডওয়ার ও সফটওয়ার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটে দ্রুত গতিতে। ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপি অসংখ্য হাই—টেক কপোর্রেশন ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। মাইক্রোসফট, অ্যাপল, গুগুল, অ্যামাজন, আলীবাবা’র মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। প্রযুক্তিকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মহাকাশে ভ্রমনের জন্য অত্যাধুনিক মহাকাশযান তৈরির প্রতিষ্ঠান।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এইসব প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজসাধ্য করার জন্য নানারকমের ডিজিটাল উদ্ভাবন ও সেবা দোরগোড়ায় পৌছে দিচ্ছে। হার্ডওয়ার, সফটওয়ার সবধরণের সেবা আমরা পাচ্ছি মুহূর্তে। সারা দুনিয়া এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা এদের সেবা ছাড়া অচল। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত প্রত্যেকেই আমরা ডিজিটাল সেবার আওতাভুক্ত। মোবাইল ফোনে দশ টাকার টক টাইম কেনা থেকে শুরু করে নেটফ্লিক্সে সদ্য নির্মিত হলিউডি মুভি দেখা, অনলাইনে খাবার অর্ডার করা থেকে দামী ব্রাণ্ডের গাড়ি কেনা সবই এখন ডিজিটাল বিপ্লবের অবদান। ডিজিটাল এই যুগে কী করা সম্ভব না তার চেয়ে জানা ভাল কী করা যায়না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের জীবনে এনেছে দুর্দান্ত গতি।

প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে গোটা পৃথিবী করোনাভাইরাসের থাবায় পর্যুদস্ত। নিঃসন্দেহে মানবজাতির জন্য এটি বড় ধরনের একটি সংকট বা বিপর্যয়। এই ভাইরাসের কারণে এক সময় গোটা পৃথিবী থমকে গিয়েছিল। সব ধরণের সামাজিক, সাংস্কুতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা ব্যাহত হয়েছিল। এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে মানুষ নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। সরাসরি দেখা—সাক্ষাত বা মেলামেশা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তদুপরি বিভিন্ন দেশের সরকার ঘোষিত লকডাউন বা শাট ডাউনের কারণেও মানুষকে গৃহবন্দী থাকতে হয়েছিল।

এই অবস্থায় প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগই হয়ে ওঠেছিল মানুষের জন্য একমাত্র উপায় বা মাধ্যম। আর এভাবেই প্রযুক্তি—প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সেবা দ্বারা হয়েছে বিপুল অর্থের মালিক। কানাডিয়ান লেখক ও সমাজকমীর্ নাওমি ক্লেইন, এ রকম একটা নজিরবিহীন সংকট ও সংকট—পরবর্তী সময়কে কীভাবে বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি এলিটরা তাদের মুনাফা তৈরির কাজে লাগাতে পারে সে বিষয়টি তুলে ধরেছেন তার ‘দি শক ডক্ট্রিন: দ্যা রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটলিজম’ নামক গ্রন্থে।

বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য থেকে আমরা ইতিমধ্যে জানতে পারছি করোনাকালীন কীভাবে বহুজাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সম্পদ ও মুনাফা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে ওঠেছে। গুগল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, ফেসবুক প্রভৃতির মত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ও মুনাফা বেড়েছে অত্যাধিক।

অন্যদিকে সারাবিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিবিদ প্রতিনিয়ত গবেষণা করে দেখাচ্ছেন যে এই করোনা মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। কর্মহীন হয়েছেন। অনেকে তাদের সমস্ত সহায় সম্পদ হারিয়ে হয়েছেন নিঃস্ব। প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ পেটে ক্ষুধা নিয়ে দিন পার করছেন। ভয়, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় তাদের সময় পার করতে হচ্ছে। অপরদিকে, কোটি কোটি বিলিয়ন খরচ করে কেউবা মহাকাশে ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন।

অতঃপর রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ ভয় ও নিরাপত্তাহীনতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যিই এক অদ্ভূত সময় আমরা পার করছি। যদিও করোনা শুরুর আগেই বিশ্বব্যাপি ১ শতাংশ মানুষের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত ছিল। করোনার আগ্রাসন সেই ব্যবধানকে কতটা বাড়িয়েছে সেটি এখন নতুন করে গবেষণার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একথা প্রমাণিত যে, করোনা সংকটে সবচেয়ে বেশি আর্থিক লাভবান গোষ্ঠী হাইটেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক করপোরেট সংস্থা। সেইসাথে অনলাইন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহ। এই করোনা সংকটে যারা আর্থিকভাবে ফুলে—ফেঁপে ওঠেছে। অপরদিকে, বিপুলসংখ্যক মানুষ হয়েছেন নিঃস্ব।

আমাদের মতো দেশ, যেখানে এমনিতেই অধিকাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, তাদের জন্য এ এক মহাক্রান্তিকাল। করোনাকালে অর্থনীতির এই বেহাল দশা সমাজ ও রাষ্টে্রর জন্য অসম্ভব পরিবর্তনকামী। সমাজ পরিবর্তনের কারণগুলো যারা কার্যকর করে, তাদের বলা যায় পরিবর্তনের অনুঘটক। এই অনুঘটকগুলোর মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন একেক সময়ে একেক দেশে তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার বৃহৎ একটি অংশ এখন কোন না কোনোভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির সংগে যুক্ত। তবে তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এখনও ডিজিটালি নিরক্ষর। এদের হাতে হাতে এখন ইন্টারনেটের সুবিধাযুক্ত স্মার্ট ফোন। সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যম ব্যবহার করে যোগাযোগ স্থাপন বা ভাব বিনিময়, মোবাইল ফোনে কথা বলা থেকে ক্যাবল সংযোগের মাধ্যমে টিভিতে সিনেমা দেখা সবই সম্ভব হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির এই যুগে।

ধনী, দরিদ্র, গ্রাম ,শহর নির্বিশেষে সবাই আজ প্রায় ডিজিটাল বিপ্লবের সুবিধাভোগী। তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একটি বৃহৎ অংশ ইন্টারনেট প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত। লেখা পড়ার পাশাপাশি বিনোদন খুঁজতে গিয়ে তারা অন্যান্য বিষয়য়েও আসক্ত হচ্ছে। অপরদিকে, ঘরে ঘরে ডিশ বা ক্যাবল সংযোগের মাধ্যমে বিদেশি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত নাটক, সিনেমা দেখে আমাদের ভাবনাজগতেও পরিবর্তন হচ্ছে।

ওটিটি প্লাটফর্মে এখন আমরা সিনেমা দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। যে সব সিনেমার বেশির ভাগই আমাদের আবহমান সংস্কৃতির সাথে মানানসই নয়। কিন্তু তাতেই আকৃষ্ট হচ্ছি। ইন্টারনেটের গুগুল বা যে কোনো সার্চ ইঞ্জিনে ঢুকলেই সেগুলোর বিজ্ঞাপন অযাচিতভাবেই আমাদের চোখে পড়ছে। কৌতূহলবশত কেউ যদি সেখানে ঢুকে দেখতে চাই তাহলে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। অনেকেই পর্ণগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এছাড়াও অনলাইন গেমস ও জুয়াতে আসক্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এইভাবে আমাদের অগোচরেই কিছু বিষয় আমাদের মাথায় ঢুকে যাচ্ছে যা আমাদের আচার আচরণে পরিবর্তন আনছে।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি এদেশের সিংহভাগ মানুষ এখনও ডিজিটালি সচেতন নয়। ইন্টারনেটে তারা কী দেখছে তা আমরা জানিনা। এ সম্পর্কিত কোনো গবেষণাও আমাদের দেশে হয়েছে বলে জানা নেই। সেই সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনও অবধি ইন্টারনেটের নিরাপাদ ব্যবহার সংক্রান্ত কোনো শিক্ষা দেয়া হয় বলে জানা নেই। সরকারিভাবেও কোনো উদ্যোগ আছে বলে জানা নেই। কারণ এখানে ব্যবসায়ের একটা বিষয় রয়েছে— তাহলো মুনাফা অর্জন।

তবে এসবের একটা নেতিবাচক প্রভাব যে রয়েছে সে বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। যেমন, অনলাইনে প্রতারণা, নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, নারী ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক সহিংসতা, স্বামী কতৃর্ক স্ত্রী হত্যা, স্ত্রী কতৃর্ক স্বামী হত্যা, সন্তানসহ হত্যা, শিক্ষক—শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্কের পরিবর্তন, দুনীর্তি, মাদক ও জুয়ার বিস্তার, নারী ও শিশু পাচার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য ও গোপনে ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়া, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রেমিক বা প্রেমিকার বাড়ীতে বিয়ের জন্য অনশন এসবই এখন ঘটছে। সুতরাং একথা বলা যায় গতানুগতিক সমাজে যে নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও বন্ধন ছিল তার পরিবর্তন ঘটছে। আর এসবের পিছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবিত বিভিন্ন মাধ্যম।

মানুষ মানুষের উপর আস্থা ও বিশ্বাস হারাচ্ছে। সততা ও আদর্শের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে। আমরা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চরমপন্থা, সহিংসতা এবং অনৈতিকতায় জড়িয়ে পড়ছি। নীতি, নৈতিকতা, মানবতা, সহানুভূতি, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও দয়ার মতো মানবিক গুণাবলী দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে যাকে সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক পুঁজির সংকট বলে বর্ণনা করেছেন। এই সংকট কতদিন চলবে তা এখনই বলা মুস্কিল।

ডিজিটাল যুগে এসে আমাদের পূর্বেকার সংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে বসেছে। এজন্য এখন আর কেউ সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে আগ্রহী হয় না। বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি যেমন গান, নাটক ও সিনেমার ফিউশন তৈরি করা হলেও তা আর আগের মতো আবেদন রাখতে পারছেনা।

পূর্বে যে সব নাটক, গান, যাত্রাপালা ও সিনেমা আমাদের হৃদয় ও মনকে আকৃষ্ট করত, আমাদেরকে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিত, আত্মিক উন্নতি ঘটাত সেরকম এখন আর আবেদন সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এক ধরণের আত্মিক ও নৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবস্থাও তাই। আর এই আত্মিক ও নৈতিক শূন্যতার জায়গায় স্থান নিচ্ছে ধমীর্য় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার।

এই সুযোগে ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আমাদের মনোজগতে ঢুকে পড়ছে। আমাদের আচ্ছন্ন করছে ধমীর্য় কুসংস্কারের মায়াজালে। অনুকূল পরিবেশে বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ধমীর্য় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দ্বারা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ যে আচ্ছন্ন হয় তারও অসংখ্য প্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে। অনেকেই ধর্মীয় উগ্রবাদিতায় জড়িয়ে পড়ছে। এভাবেই আমাদের গতানুগতিক ও উদার সমাজ ব্যবস্থা পরিণত হচ্ছে একটি অনুদার ও রক্ষণশীল সমাজে। এ এক ক্রান্তিকাল বা ট্রানিজিশনাল পিরিয়ড। কতদিন এ অবস্থা চলবে সেটা নির্ভর করবে নতুন সংস্কৃতিতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার ওপরে। আর এই সংস্কৃতি হতে পারে কল্যাণকামী অথবা অকল্যাণকামী।

অন্যদিকে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে নতুন তথ্য প্রযুক্তি উদ্ভূত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হলো মানুষের গোপনীয়তা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কর্মকাণ্ডের তথ্য সংগ্রহ ও তথ্য বণ্টন নতুন বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, সে অনুযায়ী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সেবা উদ্ভাবন করে বাণিজ্য করবে। এ যুগে তাই গোপনীয়তা রক্ষা করা খুব কঠিনই হবে।

নতুন এই কঠিন পরিস্থিতিতে গোপনীয়তার সংজ্ঞাই বদলে যাবে। আগের মতো অনেক কিছুকে আর গোপনীয় বলে রক্ষা করতে পারব না আমরা। সবকিছুই খোলামেলা হয়ে গেলে মূল্যবোধকেও নবতর নিম্নস্তরে নামিয়ে এনে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন পড়বে। অর্থাৎ আমাদের নৈতিকতা ও নৈতিক সীমারেখাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে বাধ্য করবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে যান্ত্রিক মেধা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোনো নৈতিকতা দিয়ে চলবে না, সে চলবে অঙ্কের নিয়মে। মূল্যবোধহীন যান্ত্রিক মেধার অবারিত বিকাশ সামাজিকতার যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তার বিলোপ ঘটাতে পারে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্টে্র স্থান দখল করবে ব্যবসা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে পুঁজির চাহিদাই মূল্যবোধে রূপান্তরিত হয়েছে এবং রাষ্ট্র সে মতে আইন পরিবর্তন করে লিবারেল সেজেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পরিণত হলে দেখা যাবে, মানবের সৃজনশীলতা উদ্ভূত অ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্তে যা আসে, তা—ই ধীরে ধীরে মূল্যবোধ বলে পরিগণিত হবে। এতে সমাজে পাপের অস্তিত্ববিলীন হয়ে উঠতে পারে এবং মানব মননে পাপবোধ বলে কিছু অবশিষ্ট রইবে না।

মানবমনের বিবিধ চাহিদাই হয়ে উঠবে মূল্যবোধের ভিত্তি। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যখন উপনিবেশে সংঘাত সৃষ্টি করেছে ও লুটপাট অব্যাহত রেখেছে, তখন ইউরোপের বস্তবাদী নাগরিক তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, কেননা তাতে আর্থিক মুনাফার যোগ ছিল। আর্থিক মুনাফাই নৈতিকতার সীমা ঠিক করে দিয়েছিল। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলো এভাবে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে যার বর্তমান নীতি হলো, ব্যক্তি ও ব্যবসার যেকোনো চাহিদাই নৈতিকতার ভরকেন্দ্র — হোক তা আগের মানদণ্ডে অনৈতিক বা বেঠিক (ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি, ২০২০)।

প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব যেসব দেশে সংঘটিত হয়েছিল তার প্রভাবে সমাজ জীবনেও ঘটেছিল ব্যাপক পরিবর্তন। সেসব পরিবর্তনের ইতিহাস আমরা সমাজচিন্তক ও ইতিহাসবিদদের রচনা থেকে জানতে পারি। সমাজবিজ্ঞানীরাও সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন তত্ত্ব প্রদান করেছেন। সেসব তত্ত্বের ভিত্তিতে ও বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের স্বভাব, সংস্কৃতি ও জীবনাচারে অনেক পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে।

আমাদের দেশেও আধুনিক প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল বিশাল এক জনগোষ্ঠীর মানস জগতেও ঘটে গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যার ফলে সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ ও নীতি, নৈতিকতার সাথে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার জনিত কারণে তাদের আচার আচরণে এক ধরণের সংকট তৈরি হয়েছে। অন্য কথায় বলতে গেলে বস্তগত সংস্কৃতি ও অবস্তগত সংস্কৃতির পার্থক্য থেকে সাংস্কৃতিক ব্যবধান তৈরি হচ্ছে।

প্রযুক্তি যেহেতু বস্তুগত সংস্কৃতি সেই প্রযুক্তির যর্থার্থ ব্যবহার এখনও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। কতদিনে এই দুই সংস্কৃতির ব্যবধান দূর হবে তা নির্ভর করছে আমাদের মানস জগতের ইতিবাচক ও প্রগতিমুখী পরিবর্তনের ওপরে।

মোট কথা বলা যায় আমরা একটি ট্রানজিশনাল সময় অতিক্রম করছি। সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন সংক্রান্ত যত তত্ত্ব, উপাদান ও কারণ রয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে বলা যায় বর্তমান সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তবে এই পরিবর্তন কতদিনে সম্পন্ন হবে তা সময়ই বলে দিবে।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/এএসএম

অনেকেই পর্ণগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এছাড়াও অনলাইন গেমস ও জুয়াতে আসক্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এইভাবে আমাদের অগোচরেই কিছু বিষয় আমাদের মাথায় ঢুকে যাচ্ছে যা আমাদের আচার আচরণে পরিবর্তন আনছে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।