যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগজনক জীবনাধিকার পরিস্থিতি

শেখ ফয়সল আমীন
শেখ ফয়সল আমীন শেখ ফয়সল আমীন
প্রকাশিত: ১০:৩৫ এএম, ১১ জুলাই ২০২২

যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৬তম স্বাধীনতা দিবস বরাবরের মতোই এবারও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও সর্বসাধারণের অংশগ্রহণে খুব গৌরব, মর্যাদা, আনন্দ ও উৎসবের মধ্য দিয়ে পালিত হলো। রাষ্ট্র থেকে সমাজ, সমাজ থেকে পরিবার ও ব্যক্তি পর্যায়ে তাদের স্বাধীনতা-উৎসব ছড়িয়ে পড়ে সর্বজনীনরূপে। তাছাড়া বিশ্বের প্রতিটি দেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসগুলোতেও অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় বহুমাত্রিক আঙ্গিকে।

৪ জুলাই মার্কিনিদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দিবসটিকে ঘিরে মার্কিন চৌকশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। এবারও ছিল। তবে বিবিসির একটি সংবাদে চোখ পড়তেই কপালে ভাঁজ পড়লো। শিকাগো শহরের হাইল্যান্ড পার্কে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ চলাকালীন বন্দুকধারীর গুলিতে ৬ জন নিহত! ২৪ জন আহত!

স্বাধীনতা দিবসের দিনে এমন বর্বরোচিত হামলা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সক্ষমতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলা ও নির্বিচারে মানুষ হত্যার ঘটনা বিগত কয়েক বছরে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। আততায়ী মারছে, পুলিশ মারছে, শেতাঙ্গ মারছে। স্কুলে, শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে, বারে, শপিংমলে, গির্জাসহ প্রায় সর্বত্র হচ্ছে বন্দুক হামলা! চারিদিকে শুধু হত্যাযজ্ঞ! কোথাও নিরাপত্তা নেই! জীবনের নিশ্চয়তা নেই!

পত্রপত্রিকার তথ্য বলছে, এ-বছরের প্রথম ৬ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আড়াইশ বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। যেখানে ২০২১ সালে ঘটেছিল ৬১টি বন্দুক হামলার ঘটনা, আর ২০২০ সালে দেশজুড়ে ৪০টি। যুক্তরাষ্ট্রের গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের তথ্য মতে শুধু এক মাসে আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসে প্রাণ গেছে শতাধিক নিরপরাধ মানুষের।

অন্য একটি বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালে দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় (হত্যা এবং আত্মহত্যা) প্রাণ গেছে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষের। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি উন্নত ও শক্তিধর দেশে এসব ঘটনা ও পরিসংখ্যান জাতীয় নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা তথা গণতন্ত্রের জন্য চরম হুমকি।

আরেকটি মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে সে-দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই বর্ণবৈষম্যকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, লালন করছে। এমনকি বর্ণবৈষম্যের ভাবাদর্শকে ধারণ করে তারা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের হত্যা করছে। গত ২৭শে জুনের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ সে-দেশের কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জেল্যান্ডকে হত্যা করেছে একাধারে ৬০টি গুলি ছুড়ে। আইন ও বিচার ব্যবস্থার কী অধঃপতন! কী ভয়ঙ্কর অপরাধপ্রবণ মনস্তত্ত্ব! তবে এ-ঘটনাও নতুন নয় বিশ্ববাসীর কাছে।

২০২০ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষের জীবনাধিকার তথা মানবাধিকার হরণ হতে আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি সেদিন কীভাবে জনসম্মুখে পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চাওভিন হাঁটু দিয়ে জর্জ পেরি ফ্লয়েডের ঘাড় ৯ মিনিট যাবৎ চেপে ধরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল। সেই ঘটনার অগ্নিগর্ভ-উত্তাপ কাটতে না কাটতেই একই অঙ্গরাজ্যে, একই পুলিশ বাহিনীর হাতে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে নিহত হন আরেক জন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ডন্টে রাইট।

বিনা বিচারে এবং নির্বিচারে এমন সব হত্যাকাণ্ড জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রকে চ্যালেঞ্জ করছে। ঘোষণাপত্রের তিন নম্বর ধারাটির চরম লঙ্ঘন হচ্ছে। যেখানে বলা হয়েছে, “প্রত্যেকেরই জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তির নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে।” আইনের শাসন লঙ্ঘনের এই চর্চা দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সুশাসনের উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাছাড়া, বিশ্বজুড়ে তাদের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক তদারকি-প্রবণতার নৈতিক-অধিকারকে অগ্রহণযোগ্য করে তুলবে।

রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে তার নাগরিকের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একজন নাগরিক সুস্থভাবে জীবনযাপন করবে, এ জন্য প্রয়োজনীয় সকল আয়োজন রাষ্ট্রকেই করতে হবে। এটি নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার। এ দৃষ্টিকোণ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এছাড়া, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের পরিবর্তন ও কঠোর প্রয়োগের দাবি বারবার উত্থাপিত হলেও শাসকশ্রেণি বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।

তাছাড়া ন্যাশনাল রাইফেল এসোসিয়েশান এই আইনের পরিবর্তন ও কঠোর প্রয়োগের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এসবের মধ্যে কয়েকটি রাজ্য আবার আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতি-আইন পাশ করছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালের জুনে টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট একটি "অনুমতিহীন বহন বিল" আইনে স্বাক্ষর করেন যা রাজ্যের বাসিন্দাদের লাইসেন্স বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই হ্যান্ডগান বহন করতে অনুমতি দেয়।

টেক্সাসকে অনুসরণ করে চলতি বছরের ১২ই এপ্রিল জর্জিয়া আগ্নেয়াস্ত্র গোপন বা প্রকাশ্যে বহন করার অনুমতির প্রয়োজনীয়তা দূর করতে আইন পাশ করে। আইনে বলা হয় রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের লাইসেন্স বা পারমিট ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র বহন করার অধিকার রয়েছে। এসব অপরিণামদর্শী আইনের পরিণতি কী হচ্ছে তা আমরা সবাই দেখছি। অথচ যদি কানাডার দিকে তাকাই, এই ধরনের সংকটের একটি সমাধান-কৌশল আমরা দেখতে পাই।

কানাডা সরকার ম্যানিটোবার, "বন্দুক এবং গ্যাং ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিন" শীর্ষক উদ্যোগে ২.৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। তহবিলটি গ্যাং এবং বন্দুক সহিংসতার বিরুদ্ধে গৃহীত পাঁচমুখী কৌশলকে বাস্তবায়ন করবে। সেগুলো হচ্ছে, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং বিনিময়, শিক্ষা এবং সচেতনতা, সংহতিনাশ এবং প্রয়োগ, সম্প্রদায় তত্ত্বাবধান, পর্যবেক্ষণ, গ্যাং-প্রস্থান কৌশল এবং কর্মক্ষমতা পরিমাপ কৌশলগুলো কার্যকরকরণ।

উন্নত ও অত্যাধুনিক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ট্রেন্ড বিশ্বের অনেক দেশের জনসাধারণ অনুসরণ করে, অনুকরণ করে। এখন আশঙ্কা হচ্ছে যে, জীবনহরণের এই ভয়াবহ ট্রেন্ড যদি বিপথগামী মানুষজন বিভিন্ন দেশে চর্চা করে তাহলে সারা পৃথিবীতে চরম মানবিক বিপর্যয় তৈরি হবে। এই বন্দুক সহিংসতা সংস্কৃতির লাগাম টেনে ধরাটা খুব দরকার। তা না হলে বিশ্ব ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।

তাই এখনই সময়, যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করার। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতিগুলোর সমালোচনা ও সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করার ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক জোট ও সংঘগুলোকেও তদ্রূপ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। প্রত্যাশা করি, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও পরামর্শে বিদ্যমান সংকট ও প্রতিকূলতা কাটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের জীবনাধিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, সুরক্ষিত হবে।

লেখক : কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি।

এইচআর/জেআইএম

এখনই সময়, যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করার। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতিগুলোর সমালোচনা ও সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করার ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক জোট ও সংঘগুলোকেও তদ্রূপ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। প্রত্যাশা করি, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও পরামর্শে বিদ্যমান সংকট ও প্রতিকূলতা কাটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের জীবনাধিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, সুরক্ষিত হবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।