ভীতুদের আর্তনাদ
আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে আমি পাকিস্তান গিয়েছিলাম ইউপিএলের প্রয়াত কর্ণধার মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে। উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধে শত্রুপক্ষ কী ভেবেছিল। নিয়াজী, রাও ফরমান আলী থেকে বেনজির ভুট্টো, সাবেক প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, সচিব প্রায় পঁচিশ জনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। পাকিস্তান কেন ভাঙলো- এর উত্তরে অনেকে অনেক কারণ দেখিয়েছিলেন কিন্তু একটি বিষয়ে সবাই একমত ছিলেন। তাহলো- বাঙালিরা হাফ মুসলমান, হাফ হিন্দু। হাফ হিন্দু হওয়ার বড় কারণ, পূর্ববঙ্গে হিন্দু শিক্ষক বা বুদ্ধিজীবীদের প্রভাব, স্কুল শিক্ষক হয়ে তারা শিশু বাঙালদের মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করে। সে কারণে বাঙালরা হিন্দু বা হিন্দু রাষ্ট্র ভারতের প্রতি বিরূপ নয়।
১৯৭১ সালে রফি রাজা ছিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও মন্ত্রী। একটি বইও লিখেছিলেন তিনি। নাম- ‘জুলফিকার আলী ভুট্টো অ্যান্ড পাকিস্তান’। তার সঙ্গে করাচিতে দেখা করতে গিয়েছিলাম, আলাপকালে বাঙালিদের সব সময় ‘বিংগো’ বলছিলেন, জানিয়েছিলেন, ‘ইস্ট পাকিস্তানদের তাচ্ছিল্যভরেই দেখত রুলিং ক্লাস। ভারত, সেখানে হিন্দুরা ডমিনেট করছে। বেসিক্যালি হিন্দুদের সঙ্গে ইস্ট বেঙ্গলিদের এক করেই দেখা হতো।’
এমবি নকভী ছিলেন পাকিস্তানের নাম করা কলানিস্ট। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের পক্ষ না নেওয়ায় ডন পত্রিকা তার লেখা ছাপা বন্ধ করে দিয়েছিল। করাচিতে তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি বলেছিলেন- ‘১৯৭১-এর আগে আরেকটি ব্যাপার ঘটেছিল। এখানে একটা ধারণা জন্মেছিল যে, বাঙালিরা হিন্দু ঘেঁষা। তাদের ভাষা সংস্কৃতের কাছাকাছি। হিন্দুদের সঙ্গে তাদের মাখামাখি বেশি, সুতরাং, তারা নিখুঁত মুসলমান নয়। আর যারা সাচ্চা মুসলমান নয় তাদের সমানভাবে দেখার কোনো প্রশ্নই আসে না। It disposed them as adversarial role saw them as antagonist, as virtual enemies, I did not say actual but virtual’
এক সময়ের কূটনীতিবিদ, পরে সাংবাদিক খালেদ আহমদ লাহোরে আমাকে বলেছিলেন, ‘সেই সময় আমাদের একটাই বক্তব্য ছিল, সবকিছুর জন্য দায়ী হিন্দুস্থান।’ বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনাকারী রাও ফরমান আলী বলছিলেন রাওয়ালপিন্ডিতে, ‘একবার ক্যান্টনমেন্টে এক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধনকালে আমি বলেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তানিরা হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। আমি জানতাম না সেখানে একজন হিন্দু নেতা বসে আছেন, আমি তখনো বুঝিনি যে, গোটা সমাজেই তারা মিশে আছেন।’
আমি বললাম, ‘আপনার বইতে পড়েছি ১৯৬৯ সালে আপনি ঢাকায় একটি পোস্টারে একটি ধুতি পরা লোকের হাতে ছড়ি দেখেছেন কিন্তু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধুতি পরে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন বলব, ধুতির প্রচলনটাই প্রায় নেই। আছে লুঙ্গির। এই ধুতি-লুঙ্গির পার্থক্যের মধ্যেই পূর্ব ধারণা নিহিত। ধুতি পরা মানে লোকটি হিন্দু।
আমি বলতে চাচ্ছি, আপনাদের মধ্যে প্রচলিত সংখ্যার ও পূর্ব ধারণা এই যে, হিন্দুরা মুসলমান বাঙালিদের প্রভাবিত করেছে। আর হিন্দু মানেই তো ভারতীয়। ফরমান তা স্বীকার করে বললেন, ‘আমরা এখনো বিশ্বাস করি যে, হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তানিদের মনমানসিকতাকে প্রভাবিত করেছিল।’ তিনি মনে করতেন তাজউদ্দীন আহমদ হিন্দু পরিবারের সন্তান।
নিয়াজীর সঙ্গে দেখা করতে লাহোর গিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানে একটা আশঙ্কা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে একটি শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায় আছে। তারা সরকার গঠনে একটা বড় রকমের ভূমিকা পালন করবে এবং তাহলে তারা সরকারকে প্রভাবিত করতে পারবে। হিন্দুদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। তারা সবাই ছিলেন শিক্ষিত। সবাই কায়েম ছিলেন ভালো সরকারি পদে। এদের অনেকে ছিলেন শিক্ষক, অধ্যাপক। এরকম অবস্থায় দেশের জন্য কোনো শাসনতন্ত্র রচনা ও অনুমোদন করতে হিন্দুরা জোর প্রভাব ফেলবে। পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তত এধারণাই কাজ করেছে।’
মুক্তিযুদ্ধটা হয়েছিল পাকিস্তান ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের পক্ষে আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে পাকিস্তানয়নের পক্ষে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, রাজনীতিবিদ ও সাধারণের অনেকেই কাজ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানয়ন অস্বীকার করে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ শুরু করেন। তবে, স্বাধীনতার পর স্বাধীনতাবিরোধী ও ১৯৭১ সালে নিষ্ক্রিয় ছিলেন কিন্তু ডানপন্থি মানুষজন মিলে ১৯৭৫ সালের পর বিএনপি গঠন করে।
বাংলাদেশের ছিল একটি আদর্শের প্রতীক। সেই প্রতীক বিনষ্টের জন্য ১৯৭৫-এর পর থেকে বিএনপি-জামায়াত-কওমি মাদরাসা, বিভিন্ন পির ও ডানপন্থি দলগুলো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ জোট করে কাজ শুরু করে এবং সে ধারা অব্যাহত। এখন একটু পার্থক্য আছে, শাসকদের একটি অংশ তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ছে।
পাকিস্তানিদের দুটি উদ্ধৃত দিচ্ছি। সাংবাদিক নকভী বলেছিলেন, ‘১৯৯৬ সালে আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম এবং তখন বিএনপির একজন মন্ত্রীর ভাষা আমাকে অবাক করেছিল। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তিনি বলছিলেন। এবং তিনি যে ভাষা ব্যবহার করছিলেন এবং যে ভাষায় গালি-গালাজ করছিলেন সে ভাষা ১৯৭১ সালে আমি পাকিস্তানিদের মুখে শুনেছিলাম।’
সাংবাদিক খালেদ তার পত্রিকায় একটি রিপোর্ট করেছিলেন বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে। সে রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন, ১৯৯০ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাপতি জেনারেল আসলাম বেগ ঢাকায় এসেছিলেন। সেখানে সেনাবাহিনীর কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং একজন জেনারেলকে ১০ কোটি টাকা প্রদান করেছিলেন। উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে সে ব্যবস্থা করা। ১৯৯০ সালে সবাই জানত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। এবং ১৯৭১ সালের ধারাবাহিকতায় প্রচণ্ড অত্যাচার করেছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও অন্যান্য প্রগতিশীলদের ওপর।
২.
আমরা নই, পাকিস্তানিরাই বলছেন বিএনপির ধ্যান ধারণা কেমন। তাদের আমলে [এর সঙ্গে যুক্ত এরশাদের আমল] বাংলাদেশে পাকিস্তানয়ন প্রক্রিয়া জোরদার হয়ে ওঠে। এই প্রকল্প গ্রহণে তারা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। একটি জাতির প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তারা বদলে দিতে পেরেছে। বিএনপি, জামায়াত ও কওমি মাদরাসা ভিত্তি করে গড়ে ওঠা হেফাজত মিলে একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। এদের আমরা হেজাবি বলতে পারি। তিনটি দল আলাদা, কিন্তু বিভিন্ন সময় একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে হেজাবি হিসেবে। তারা ধর্মকে আশ্রয় করে বাংলাদেশে পাকিস্তানয়ন প্রকল্প আরও জোরদার করে তুলছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। এটি সম্ভবত দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে ও তার প্রচুর সাফল্যের ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন দলের মানুষজন এসে নতুন নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগের ডানপন্থা জোরদার করেছে। শেখ হাসিনা হেজাবিদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করার জন্য হেফাজতের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছান। এর মূল লক্ষ্য ভোটের বাক্স স্ফিত করা।
আমি আওয়ামী লীগের নতুন পুরোনো অনেক নেতার কাছে শুনেছি, আপনার এক ভোট, মাদরাসার একজনের এক ভোট। তাদের কখনও মনে হয়নি, মাদরাসার ভোট তাদের বাক্সে পড়ে না। আওয়ামী লীগের যেমন কৌশল আছে। তাদেরও তেমন কৌশল আছে। সেটি হলো আওয়ামী লীগকে দিয়ে পাকিস্তানয়ন সম্পন্ন করা এবং লীগের মধ্যে ও বাঁ ঘেঁষা সমর্থকদের প্রভাব হ্রাস করা।
পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮ সালে মানসজগতে পরিবর্তন আনার জন্য পাঠ্যক্রম ও স্কুলে ধর্ম শিক্ষা এবং নামাজ বাধ্যতামূলক করা হয় তৎকালীন ডিপি আই ড. কুদরতে খুদার সাহায্যে। হেফাজতিরা কিছুদিন আগে একইভাবে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য সরকারের সঙ্গে আঁতাতের পর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের মাধ্যমে পাঠ্যসূচির ‘হিন্দুয়ানি’ বাদ দিয়ে ‘মুসলমানী’ করা হয়। এতে শোনা যায় প্রবলভাবে সমর্থন করেছিল আওয়ামী লীগের হেজাবি সমর্থকরা।
এখানে উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর সময়ও এধরনের দুটি ধারা ছিল। কিন্তু, তার আদর্শগত স্থান পরিবর্তন করেননি। তিনি সমর্থন নিয়েছেন মধ্যপন্থি ও বাঁ ধারার। ডানপন্থার কাছে নতি স্বীকার করেননি। ডানপন্থার নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার মোশতাক। অন্যদিকে, তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধু, আশ্চর্য ভোটের কথা চিন্তা না করে মনোযোগ দিয়েছেন সাধারণ মানুষকে কীভাবে নিজের পক্ষে আনা যায়। এবং তার কারণেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন।
আওয়ামী লীগে এখন পরিচিত কোনো নেতা বা মন্ত্রী নেই। শেখ হাসিনাই একমাত্র পরিচিত। তিনি এখন অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। কিন্তু, দলের ডানপন্থার অনুপ্রবেশ, সরকারের আমলাদের ডানপন্থায় ঝোঁক সব মিলে এখন বাংলাদেশের শহর-মফস্বলে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়ছে। অদ্ভুত ধরনের ইসলামীকরণ হচ্ছে। যেমন- পোশাক বদলে যাচ্ছে। মুখের অবয়ব বদলে যাচ্ছে। মাদরাসার সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার দেশ ত্যাগ করছে।
এসব মন্তব্যে সরকারের অনেকে নারাজ হচ্ছেন। তারা নারাজ হতে পারেন কিন্তু বাস্তব বদলে যাচ্ছে। মহাপ্রকল্প সব সফল হচ্ছে, শেখ হাসিনার সাফল্যে আমরা উজ্জীবিত। কিন্তু বাংলাদেশের যে ইমেজ তিনি গড়ে তুলতে চাচ্ছেন, আধুনিক, স্মার্ট, শিক্ষিত সংস্কৃতিবান একটি দেশ তা হচ্ছে না। এদেশের মানুষ ক্রমেই পশ্চাৎপদ ধারণার বশবর্তী হচ্ছে। শেখ হাসিনা যে রকম দেশ চাচ্ছেন, সে দেশের মানুষরা ক্রমেই পাকিস্তানি হয়ে যাচ্ছে। এখানেই আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে হেরে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা যে ভিত্তি গড়ে দিচ্ছেন সে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে হেজাবিরা ‘আধুনিক’ পাকিস্তান গড়ে তুলবে।
গত একবছরে শিক্ষাক্ষেত্রে কী ঘটছে দেখুন। প্রধানত হিন্দু শিক্ষকরা অবমাননার শিকার হচ্ছেন। ছাত্ররা দুর্বিনীত হয়ে উঠছে, সংবাদপত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ছাত্র সংগঠন সম্পর্কে প্রতিদিন যে সব খবর ছাপছে তা শেখ হাসিনার সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে।
সারাদেশেই এমন ঘটছে। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক ঘটনা একটার পর একটা ঘটেই চলছে। এবং এর সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের হেজাবি অংশ, আমলাতন্ত্র। নড়াইলে যে ঘটনা ঘটল সেখানে ওবায়দুল কাদের নিশ্চয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিকে জুতার মালা পরাতে বলনেনি। ওই লোকটি বারবার বলছিল ‘ও শাহিনুর ভাই, মালাডা কুহানে’। সেখানে উপস্থিত ডিসি এসপি বা ওসিকে শেখ হাসিনা নির্দেশ দেননি যে যখন একদল লোক কু-কাম করছে তখন তা দর্শকের মতো দেখার জন্য।
ফলটা হলো সারাদেশে প্রতিবাদ। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলেননি, কিন্তু, বিষয়গুলোতো তার পক্ষে যায়নি। এর একটি কারণ, এসব ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের কারও শাস্তি হয় না। খুব বেশি হলে পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। আমলা বা সরকারি কর্মচারীদের কোনো শাস্তি হয় না। যিনি শত বাধা অতিক্রম করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারেন তিনি এসব ক্ষেত্রে অসফল হবেন এটিই আমরা মানতে পারছি না।
‘জাগো নিউজে’ গত সপ্তাহে আমার, স্বদেশ রায় বা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর লেখায় এ বিষয়গুলোই তুলে ধরা হয়েছে। স্বদেশ রায় লিখেছেন, ‘বাস্তবে আমরা যারা রাজনীতির কাছে, রাষ্ট্রের কাছে সমাজের এই অধোগতি ঠেকানোর বিষয়টি আশা করি। মনে করি রাষ্ট্র বা রাজনীতি এটা করে দেবে। আমরাও অসহায়।...রাজনীতি যখন কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে প্রমত্ত রূপ ধারণা করে তখন রাজনীতির মূল শরীরের থেকে তাকে আরও বেশি বড় মনে হয়। তারা নিজেরাও নিজেদের শরীর চিনতে পারে না। তখন স্বভাবতই রাজনৈতিক শক্তি মনে করে তারা রাজনীতি দিয়ে সব কিছু উদ্ধার করে ফেলবেন।’
বিচারপতি মানিক যথার্থই লিখেছেন, ‘ঘটনাটিকে শুধু স্থানীয় একটি ছোট বিচ্ছিন্ন বিষয় মনে করা হবে যৌক্তিকতার খেলাপ। এটিতে পরিলক্ষিত হয়েছে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থানের কথা।’
এটি প্রাসঙ্গিক মনে হবে যদি আরও কয়েকটি উদাহরণ দিই। আমাকে একজন ফেসবুকের একটি পোস্ট পাঠিয়েছেন। ‘জাগো বিএনপি জাগো’। সেখানে দেখানো হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১৭টি পদে ১৭ জন হিন্দু রয়েছে। এবং নানা মন্তব্যে বলা হয়েছে সেই পাকিস্তানিদের মতো-যদি মুসলমান দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় হিন্দুদের প্রাধান্য থাকে তাহলে কোথায় যাবো! এ প্রাধান্য কে আনছে? কে আবার আওয়ামী লীগ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের বৃহত্তম মন্ত্রণালয়। সেখানে ১৭ বা ১৭০ জন হিন্দু থাকলে কী আসে যায়। তাদের প্রভাবে কাত হয়ে যাবেন ডা. দীপু মনি। আসলে তা নয়, বিএনপি বলতে চায় হিন্দুরা সব নিয়ে নিচ্ছে, ‘জাগো বিএনপি জাগো’।
এই একই বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, জাতীয় পার্টির এমপি ফখরুল ইমাম জাতীয় সংসদে। তিনি জানাতে চেয়েছেন বা হয়তো এই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন মুসলমানত্ব গেল আমাদের। পরে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। কারণ এই সংবাদটি ছিল কুশক্তির ধারক ইনকিলাবের। এবং তা ২০১৬-এর। অর্থাৎ বিএনপি, জাতীয় পার্টি মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঘৃণার বীজ বপন করতে চাইছে। সুতরাং বিচারপতি মানিক যে বলেছেন, কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয় তা সঠিক।
ধরে নিতে পারি, নির্বাচন যত এগোবে এধরনের ঘটনা তত বাড়বে। কারণ, কারও কোনো শাস্তি হয় না। আওয়াম লীগের যে নেতা যুক্ত থাকে তাকে বহিষ্কার করা হয়, ওসি প্রত্যাহার হয়, খুচরা দু-একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর সব ধামাচাপা পড়ে। সরকার ভাবে সব ঠিক হ্যায়। কিন্তু ঠিক তো থাকে না। ভিকটিমরা নিঃস্ব হয়ে যায়। কেউ পাশে থাকে না। শেখ হাসিনা যেখানে বিশ্বের একটি সেরা প্রকল্প আশ্রয়ণ করেছেন, তারা সেই আশ্রয় থেকে বঞ্চিত। শুধু নির্মূল কমিটি দ্বারে দ্বারে চাঁদা তোলে এদের সহায়তার জন্য।
৩
এ বিষয়ে সম্প্রতি আমার পুরোনো সহকর্মী সুব্রতশংকর ধরের একটি চমৎকার লেখা চোখে পড়ল- ‘একটি উদ্বেগজনক প্রশ্ন, ‘মালাডা কুহানে’। [প্রথম আলো, ৩.৭.২২] আমরা এতদিন যা বলে আসছি সুব্রত মূলত তাই বলেছেন। কিন্তু, দুটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তিনিও বলছেন- যে দল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, অর্থাৎ পাকিস্তান ভেঙেছে, জঙ্গিবাদ দমন করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করছে, বারবার অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলছে, এগুলো তো বিএনপি+ জাতীয় পার্টি বা হেজাবিদের কাছে ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কৌশলগতকরণে তারা হয়তো কাছে থাকার ভান করে যাবে। কিন্তু সুযোগ পেলেই ছোবল দেবে।’
যেহেতু হেজাবিদের অনেকে কু কাজ করার ফলে জেলে তাই হেজাবি নেতারা বারবার যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে নেতাদের জামিনের জন্য। কয়েকদিন আগেও তারা দেখা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এবং সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্মূল কমিটি তাদের অর্থের উৎস নিয়ে যে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সে তদন্ত বন্ধ করা হয়েছে। এটি সত্য না মিথ্যা জানি না, কিন্তু এই যে বক্তব্য এটি কি সরকারের পক্ষে যায়? হেজাবিরা হচ্ছে এরকম।
সুব্রত যে প্রশ্নটি তুলেছেন তাহলো- ‘সাম্প্রদায়িকতার জন সংস্কৃতি’র বিস্তৃতি ঘটছে। তৃণমূল বদলে যাচ্ছে। আমি এর সঙ্গে যোগ করব, ভারতীয় রাজনীতির কথা যার অভিঘাতও এখানে পড়ছে। এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে ‘মোদীই রক্ষক’ এ ধারণা পরিবেশ প্রতিকূল করে তুলছে।
যেখানে কোটি কোটি করিমুদ্দীন বদলে যাচ্ছেন, সেই জনসংস্কৃতিতে আওয়ামী লীগের জনভিত্তিটি কীভাবে তৈরি হবে? “লিখেছেন সুব্রত আর জনভিত্তি না থাকলে আওয়ামী লীগকে জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকতে হবে, পুলিশ দিয়ে, আমলা দিয়ে, অপরাপর শক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে। একটা অবাধ নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় থাকার উপায় তার থাকবে না। হ্যাঁ, সেভাবে বিশ্বের কিছু দেশে অনেকেই ক্ষমতায় আছেন। কিন্তু সেখানেও জনসংস্কৃতি যাঁদের সহায়ক নয়, তাঁরা বিশেষ স্বস্তিতে নেই। তাহলে কি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ‘আশঙ্কা’র কথাও ভাবে? সম্ভবত না। কারণ, তার শাসনামলে রয়েছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের ইতিহাস। এই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়ার পরিণতির কথা ভাবলে নিশ্চয়ই শিউরে উঠবে। একটা স্ট্যাটাস কো (স্থিতাবস্থা) অন্তত ধরে রাখতে চাইবে আওয়ামী লীগ। সেটাও কি সম্ভব?”
আওয়ামী লীগের জনভিত্তি তো তৈরি হয়েছিল, গরিবের সুবিধা দেওয়ার জন্য এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার জন্য। সুব্রত বলছেন, জনসংস্কৃতি বদলে গেলে আমলারাও বদলে যাবেন। যার উদাহরণ আমরা দেখেছি। ‘তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে, রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারা আরও বদলে যাবে। একটা সময় আসবে যখন সেই রাষ্ট্রযন্ত্রে অসাম্প্রদায়িকতার বয়ান জারি রাখা আওয়ামী লীগের কোনো বৈধতা আর থাকবে না। আর আওয়ামী লীগ খোলনলচে বদলে সাম্প্রদায়িক হতে চাইলেও সে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে পাকিস্তান ভাঙা এবং মানবতার বিরুদ্ধের অপরাধের বিচার করেছে দলটি। এক করিমুদ্দীন হয়তো আবারও প্রশ্নটা করবেন, ‘ও শাহিনুর ভাই, মালাডা কুহানে?’ তখন লাখ লাখ করিমুদ্দীন কে কী করবেন, তার সবটুকু আমরা কল্পনাও করতে পারব না। কিংবা কল্পনা করতে চাইব না। ভয়ে।’ [ঐ]
৪
অস্বীকার করার উপায় নেই এখন সমাজে সব পর্যায়ে ভয় ঢুকে গেছে, যাচ্ছে। কথায় কথায় প্রগতিশীলদের মালাউন, নাস্তিক ,বলে শুক্রবারে জুমার পর বাড়ি গাড়ি ব্যক্তি আক্রান্ত করা হচ্ছে। সর্বশেষ উদাহরণ উত্তরায় রতন সিদ্দিকীর ঘটনায়।
এই ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হচ্ছে এখন ওয়াজের মাধ্যমে আর ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুকে কিছু হলে হিন্দুদের ধরা হয়, মুসলমানদের কদাচ নয়। একটা অজুহাত প্রায়ই দেয় বিটিআরসি, আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু ‘জাগো বিএনপি জাগো’ যখন মিথ্যাচার করে তাদের কিছু করা হয় না, মুসলমান বলে কি? কোরআনে নাস্তিক শব্দ আছে কি না জানি না, অন্তত হাবিবুর রহমানের কোরানসূত্রে আমি তা পাইনি। নাস্তিক সাহসী ছাড়া কেউ হতে পারে না। বরীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর/ ধার্মিকতার করে না আড়মার/ শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো/ শাস্ত মানে না, মানে মানুষের ভালো।”
ওয়াজ করে কারি কারি টাকা যারা উপার্জন করে তারা তো ট্যাক্স দেয় না, ছড়ি ঘোরায় সমাজের ওপর এবং রাষ্ট্র তাকে সমর্থন করে। কথায় কথায় এরা কোরআনের উক্তি উদ্ধৃত করে। কিন্তু সুরা বাকারার ৭৮, ৭৯, ৮০, ৮১ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করে না, যেখানে বলা হয়েছে যারা এ উপায়ে উপার্জন করে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা পথচারীদের থামিয়ে পুরুষাঙ্গ পরীক্ষা করে দেখত সে মুসলমান না ‘মালাউন’। এখনও আমাদের প্রায় প্রতিদিন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে এসব মাদরাসা পড়া মানুষজন, কোট-টাই পরা মানুষজন যাদের মন মাদরাসার তালেব এলেমের মতো, যে আমরা মুসলমান কি না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমরা প্রথমে বাঙালি তারপর মুসলমান। এখন আমাদের বলতে হচ্ছে আমরা মুসলমান, আমরা পাকিস্তানি বাঙালি, ৫০ বছর কী পরিবর্তন!
৫
শেখ হাসিনা যা করেছেন তারপরে তিনি নির্বাচনে জিতবেন না এমন কথা বলা দুরূহ। কিন্তু, ঈশা কোণে মেঘের আনাগোনা ভীত করে আমাদের যারা তাঁর সমর্থক। কারণ, ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে দেখেছি, ভরা যৌবনে থাকার সময় হঠাৎ জীবনের ইতি হয়। আইয়ুব, জিয়া, এরশাদ, খালেদার পরিণতির কথা ভাবুন। সমাজে বিএনপি ভীতি সৃষ্টি করেছিল, এক পর্যায়ে সমাজ তা প্রতিরোধ করে। এখন আবার বিভিন্ন মহল ভীতি সৃষ্টি করছে। শাহরিয়ার কবির সম্প্রতি এক প্রতিবাদ সভায় “আওয়ামী লীগের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা আবার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কী জবাব দেবেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে? আপনাদের বলতে হবে, যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম রক্ষা করিনি। ৬২টি নির্বাচনী এলাকা (সংসদীয় আসন) আছে, যদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সিদ্ধান্ত নেয় যে আওয়ামী লীগকে ভোট দেব না- এসব নির্বাচনী এলাকা থেকে আপনারা নির্বাচিত হতে পারবেন না। আপনাদের স্বার্থে, আওয়ামী লীগের স্বার্থে বলছি, সংখ্যালঘু স্বার্থকে আলাদা করে দেখবেন না।” [প্রথম আলো, ৩.৭.২২]
এসব উদ্বেগ ১৯৯০, ১৯৯৬ বা আরো পরে সিভিল সমাজ থেকে উত্থিত হয়েছে। লীগের নেতারা তাতে কর্ণপাত না করায় ফলাফল কী হয়েছিল তা এখন ইতিহাস। রামেন্দু মজুমদার নির্মূল কমিটির সভায় ঠিকই বলেছিলেন- সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এই যোগসূত্র না ঘটানো গেলে অবস্থার আরো অবনতি হবে।
৬
শেষ পর্যায়ে প্রথম পর্যায়ের বক্তব্য দিয়ে শেষ করব। গত ৭৫ বছরে দেখা যাচ্ছে, অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও বাঙাল হিন্দু মুসলমানের মনোজগত পরিবর্তন হয়নি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ করলেন, শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল করলেন কিন্তু মানুষের মনোজগত বদলানোর চেষ্টা করলেন না। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা এখানে। এদিকটির প্রতি তারা কখনও নজর দেয়নি। এ নিয়ে আমাদের হতাশা থাকতেই পারে।
শেষ জীবনে এসে দেখি, কালো টাকা, ঋণখেলাপিদের দুর্নীতিবাজ, আওয়ামী লীগ বা স্বাধীনতা বিরোধী, মাস্তানদের রমরমা, তাদের জন্য সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ। পেশি শক্তির আস্ফালন রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত । তদন্ত হয় না এসব দুর্নীতির, উদ্ধত আচরণ করে যারা তারাই থাকে রাষ্ট্রে কর্তৃত্ব নিয়ে, আর আমরা যাদের বলা যেতে পারে ভীতু, যারা আইন মানে, সঠিক ধর্ম পালন করে, ট্যাক্স দেয়, পেশি শক্তি নেই তাদের জন্য রয়েছে পদে পদে লাঞ্ছনা। না, শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, মিয়ানমার, রাশিয়া, আমেরিকা সবখানে। ট্রাম্পরা সব সময় জিতে যায়, হেজাবীরা সব সময় জিতে যায়।
মনে পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা-“শুয়োরের বাচ্চারাই সভ্যতার নামে জিতে গেল/ ওদের নিজস্ব রাস্তা, ওরাই দৌড়োবে/ ওদেরই মুখোশ নিয়ে দেশে দেশে চলে যায় অবিমিশ্র দূত/ বিমানের সিঁড়ি থেকে পা পিছলে কোনোদিন/ একজনও পড়ে না। বাঁধানো দাঁতের হাস্যে সভ্যতার নাম রটে খুব।”
লেখক: ইতিহাসবিদ। বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/এএসএম