বাণিজ্যিক জোটের দৃষ্টি সন্ত্রাস প্রতিরোধে
ব্রিকসের ইলাবোরেশন যদি ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার আদ্যাক্ষরের রূপ হয়, তাতে কারও আপত্তি থাকার কারণ নেই। বরং এটাই ভাবতে হবে যে কোন উদ্দেশ্যে এই বাণিজ্যিক জোটটি এবার সন্ত্রাসবিরোধী নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হলো? চির বৈরী চীনের সঙ্গে একই বাণিজ্যিক জোটে ভারতও শামিল। এবং আমরা লক্ষ্য করছি, বৈরিতা পরিহার করার জন্য এই যে সম্মেলন, তা হোক ভার্চুয়াল, তারপরও সম্পর্ক পারস্পরিক চেতনায় নতুন কিছু যোগ করবে। এটা আমার বিশ্বাস। কেবল বিরোধিতা তো কোনো সমস্যার নাড়ি কেটে তাকে স্বাভাবিক করে দিতে পারে না। বরং পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতাই এক নতুন ডাইমেনশনে নিয়ে আসবে।
এই জোটের দেশগুলো আকারে বড়, যদিও চীন ও রাশিয়া বাদে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী নয় বাকি সদস্য দেশগুলো। কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে বা জনশক্তির দিক থেকেও চীনের পরই ভারতের অবস্থান। ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলো ধরলে এ দুটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এশিয়ায় এবং সীমান্ত প্রতিবেশি। আবার বিশ্ব অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র ধীরে ধীরে হলেও গড়িয়ে আসছে এশিয়ার কেন্দ্রে। অর্থাৎ আগামী পৃথিবীর অর্থনৈতিক শক্তির কেন্দ্র আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে থাকছে না, বরং উদীয়মান এশিয়ার কেন্দ্রে এসে ভর করবে, সেই আলামত আমরা লক্ষ্য করছি।
রাশিয়া আগে থেকেই শক্তিশালী, চীন নবাগত শক্তিশালী, ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি অতোটা শক্তি অর্জন করতে না পারলেও তার উত্থান দৃশ্য আমরা দেখছি। তার মানে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সম্মিলিত অর্থনৈতিক শক্তি নতুনমাত্রায় পৌঁছাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর সঙ্গে যোগ করতে পারি আমরা জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই দারুস সালাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ উদীয়মান এশিয়ান দেশগুলোকে।
সব মিলিয়ে চিন্তা করলে বিশ্ব অর্থনীতির রাজনৈতিক সুতোটি এশিয়ার হাতেই এসে জড়ো হচ্ছে। এবং আমরা যখন এই খবর পাই যে, শিখন্ডি খ্যাত ইসরায়েলও তাদের রিজার্ভ চীনা টাকা ইউয়ানে রেখেছে। আলামত হিসেবে এটা উল্লেখ করা ভালো। ভবিষ্যতে ইসরায়েলের নীতি-আদর্শ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ বলতে পারে না। এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও যে এশিয়ান অর্থ-ব্যবস্থায় অবদান রাখবে না, তাই বা কে বলবে? তারা যে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দৃঢ়তা দেখাচ্ছে তা তো বাইডেনের ফোন কল-এ সাড়া না দিয়েই প্রমাণ করেছে। বাইডেন যে নাখোশ হয়েছেন, সেটাও বোঝা যায় সৌদি আরব সফর তিনি বাতিল করে। এ গুলো হচ্ছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির উপরিকাঠামোর রাজনৈতিক প্রবাহ, ওই প্রবাহের ডিপ স্ট্রাকচারে কেমনতর চোরাস্রোত কতোটা কারেন্ট সৃষ্টি করছে, তার খোঁজ কজন রাখেন?
বাণিজ্যিক জোট এবার যৌথ ঘোষণায় কি বলেছে, তা জানা যাক-
‘ব্রিকসের যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, ‘যখন, যেখানে এবং যারাই করুক’, সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন নেতারা। এতে বলা হয়, ‘সন্ত্রাসবাদ, সন্ত্রাসবাদের সহায়ক উগ্রপন্থা এবং মৌলবাদ থেকে সৃষ্ট ঝুঁকির বিষয়টি আমরা স্বীকার করছি। এ লক্ষ্যে সন্ত্রাসীদের আন্তসীমান্ত যাতায়াত, সন্ত্রাসে অর্থায়নের নেটওয়ার্ক ও নিরাপদ আস্তানাসহ সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’
সদস্য দেশগুলোর বাইরে এবার ব্রিকস সম্মেলনে অতিথি দেশ হিসেবে অংশ নিয়েছে আলজেরিয়া, আর্জেন্টিনা, কম্বোডিয়া, মিশর, ইথিওপিয়া, ফিজি, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কাজাখস্তান, সেনেগাল, উজবেকিস্তান, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড।
ব্রিকসের এই ভার্চুয়াল সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন ব্রিকস সদস্য দেশগুলো একে অন্যের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ বোঝা উচতি। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করতে পরস্পরকে সমর্থন দেয়া উচিত। স্পর্শকাতর বিষয়ের ‘রাজনীতিকর’ উচিত নয়।
অর্থনৈতিক জোটের অ-অর্থনীতি বিষয়ক বক্তব্য আমাদের চমকিত করছে। বাণিজ্যই যেখানে প্রধান হয়ে ওঠার কথা সেখানে সন্ত্রাস, সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন, আস্তানা প্রদান ইত্যাদি বিষয় কেন প্রাধান্য পেলো এবং এর পেছনকার কারণ অনুসন্ধান জরুরি। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও আন্তঃসীমান্ত যাতায়াতে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা প্রতিরোধে কেন ব্রিকস নেতারা দলবদ্ধ হলেন, সেটা বুঝে দেখা দরকার।
আমরা তো দেখছি, বৈশ্বিক রাজনীতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোয়াডের এক সদস্য দেশ, ব্রিকসের এক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্পর্শকাতর মন্তব্য করছে। বিশেষ করে চীনের আচরণকে কর্তৃত্ববাদী ও আগ্রাসী বলে চিহ্নিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ওই মন্তব্য তাইওয়ানের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এবং চীনকে চাপের মধ্যে ফেলতে।
দক্ষিণ চীন সাগরের চারপাশের দেশগুলোর স্বার্থ উদ্ধারের স্বপ্রণোদিত হয়ে দায়িত্ব নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোয়াডে আছে ভারত। তাইওয়ান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ যথাযথ নয়, বরং ভয়াবহ রকম হুমকির। চীনের সঙ্গে ভারতের কেবল রাজনৈতিক ও সীমান্তবিরোধই নয়, আরও বহু বিষয়ে তারা পরস্পরেরবিরোধী। কিন্তু এই ব্রিকসের সদস্য হিসেব চীন ও ভারতের রয়েছে জোটীয় সম্পর্ক। এই জোট বাণিজ্যিক সম্পর্কের। চীনের সঙ্গে ভারতের রয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ১৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। পরস্পরের মধ্যে এই বাণিজ্য লেনদেনের পরও এ-দুটি দেশের সামরিক ও সীমান্ত বিরোধ কখনোই মীমাংসা হয়নি।
কিছুদিন আগে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা কমিটির বিধির আওতায় পাকিস্তানি নাগরিক আবদুল রহমান মক্কিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ঘোষণার যৌথ প্রস্তাব দেয় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে প্রস্তাবটি আটকে দেয় চীন। ব্রিকস সম্মেলনে দেয়া ভাষণে নরেন্দ্র মোদী মূলত সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। ( প্রথম আলো/ ০৬/২৬/২২)
কোয়াড সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মিলে পাকিস্তানি নাগরিক আবদুল রহমান মক্কিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ঘোষণার যৌথ প্রস্তাব দেয় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা কমিটিকে। ওই প্রস্তাবে চীন বিরোধিতা করে। ফলে ভেস্তে যায় ওই প্রস্তাব। সেটাই নরেন্দ্র মোদী উল্লেখ করেছেন পরোক্ষে সন্ত্রাস সম্পর্কিত বিষয়ে বক্তৃতায়। বাণিজ্যিক জোট ব্রিকসের এক সদস্য দেশ কোয়াড জোটের দুই সদস্যের উত্থাপিত প্রস্তাব ভেটো দিয়ে পাকিস্তানি নাগরিক মক্কিকে বাঁচায়।
পাকিস্তান কোয়াডেরও নয়, ব্রিকসেরও সদস্য নয়। তারপরও চীন মক্কিকে বাঁচাতে এগিয়েছে। এর কারণ হতে পারে প্রকাশ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেছে চীন। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সুদূর অতীত থেকেই ভালো, যাকে সুসম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত করাই ভালো। স্ট্রাটেজিক দিক থেকে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানি রাজনীতিকদের গাটছড়া ঐতিহাসিকও বলা চলে। সেই সম্পর্কের সুতো ধরেই চীন দাঁড়িয়েছে মক্কির পক্ষে।
এ ঘটনা থেকেই বোঝা যায় বিশ্ব রাজনীতি কোন পথে চলছে। চীন ও রাশিয়া একটি অর্থনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কাজ করছে। বিষয়টি দানা বেঁধে উঠছে। রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় রাশিয়ার সঙ্গে ভারতও ওই আগামী ব্যবস্থায় শামিল হতে পারে, সেই আলামতও স্পষ্ট। মার্কিনি নিষেধ সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে অতিরিক্ত অপরিশোধিত তেল কিনছে। এর আগেই রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এম ৪০০ কিনে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সন্দেহের তালিকায় গেছে, হয়েছে সমালোচিতও। কিন্তু তাতে ভারত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। দ্বিতীয়ত, রাশিয়াও যে এশিয়া ও ইউরোপের মিলিত দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী তা বলার প্রয়োজন পড়ে না। উভয় দেশ ইউক্রেন যুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে আজ।
ব্রিকস ঘোষণার পুরোটাই সন্ত্রাস নিয়ে রচিত। নানা বিষয়ে পরস্পরকে দোষারোপকারী দেশগুলো আবার বাণিজ্যের লক্ষ্যে ঐক্যে মিলেছে। তার মানে তারা নিজেদের যৌথ-স্বার্থে অভিন্ন মত প্রকাশে দ্বিধান্বিত নয়। কিন্তু ইনডিভিজুয়াল স্বার্থে পরস্পরবিরোধী। ব্রিকস সম্মেলনে মোদী আঙুল তুলেছেন চীনের দিকে। কারণ চীন তথাকথিত সন্ত্রাসী বলে চিত্রিত পাকিস্তানি মক্কিকে রক্ষা করেছে অপবাদ থেকে। এই যে স্বার্থ ও বিরোধ-এর ক্রসকারেন্টগুলো, এগুলোই আমাদের আসল সমস্যা সমাধানে পৌঁছাতে দেয় না।
চীনের অর্থনৈতিক শক্তির উত্থান ও সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার চেষ্টাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে না। তা না করুক, তাতে চীনের কিছু আসে যায় না। তাইওয়ানের আকাশসীমা জলসীমা প্রায়শই লঙ্ঘন করে চীনা সামরিক বিমান ও নৌযান। এর প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের যুদ্ধ বিমানবাহী জাহাজ পাঠিয়েছে, যাতে চীন ভয় পায়। কিন্তু চীন বলেছে, যে স্থিতাবস্থা চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে, তা ভেঙে তাইওয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সে সামরিক অভিযান চালিয়ে ওই দ্বীপ দখল করে নেবে। তারা মনে করে এবং বলে আসছে যে তাইওয়ান চীনের মূল ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। চীন তাইওয়ানকে পুনরেত্রীকরণে বিশ্বাস করে।
দক্ষিণ চীন সাগরে যে পরিমাণ সম্পদ ( মৎস্য, মিনেরালস) রয়েছে, তার মালিকানা ও ভোগ-দখলের জন্যই আজই যুক্তরাষ্ট্র-চীন কনফ্লিক্ট। সে তাই চীনকে ঘেরাও করে ফেলার জন্য বাণিজ্য জোট করে প্রথমেই নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে চায় ইন্দো-প্যাসিফিকের ছোট উদীয়মান রাষ্ট্রগুলোকে। দক্ষিণ চীন সাগরের তাদের যে পরিমাণ সম্পদ আছে, তাদের অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই ওয়াদা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাহানামাত্র।
এটা যে টোপ, শক্তিশালীর টোপ সেটা ছোট এশিয়ান দেশগুলো খুব ভালো করেই বোঝে। কিন্তু গরিবের সমস্যা-সংকট অনেক। তারা সত্য সাহস করে বলতে পারে না। তারা বায়ে ঘুরলে ডানের রোষে পড়ে আর ডানে ঘুরলে বায়ের রোষের খড়্গ নেমে আসবে। ফলে বাণিজ্যিক জোটের সম্মিলিত যৌথ ঘোষণায় প্রাধান্য পেয়েছে সন্ত্রাসবাদ। বাণিজ্যের সম্প্রসারণের সঙ্গে সন্ত্রাস প্রতিবন্ধক, তাতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু বিরোধী পক্ষের সবই সন্ত্রাসবাদের আওতায়, এটা বলা ঠিক নয়।
মূল লক্ষ্য যে চীন সেটা না বললেও বোঝা যায়। তবে এ যুগে, সন্ত্রাস দমন নয়, সন্ত্রাসী বলে চিহ্ন দেওয়াটাই অপরাধ। যারা স্বাধীনতা চায়, তার জন্য অস্ত্র তুলে নিলেই সেই সংগঠন ও তাদের নেতারা সন্ত্রাসী বলে চিত্রিত হয়। ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকেও সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করেছিল পাকিস্তান ও তার গুরু যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি আজকের চীনও ছিল ওই সময় পাকিস্তানি সামরিক সরকারের পক্ষে।
এজন্যই কোনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী চিহ্ন না দিয়ে যে কারণে তারা অস্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে, সেই সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণের বিষয়ের সমাধানই এর রেমেডি। সেই পথেই বিশ্বনেতাদের হাঁটতে হবে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম