দি ফাদার
প্রথম দেখেছিলাম নব্বইয়ের দশকে। তাই পুরোপুরি মনে নেই কাহিনি বা সংলাপ। ১৩-১৪ বছরের কিশোর তখন আমি। তবে মনে আছে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বাবা-মেয়ের রসায়ন নিয়ে এক অসমান্য আবেদন সৃষ্টিকারী গল্প ছিল সেটি। সেই থেকে একটি গানের রেশ আজও কানে বাজে। নিজে নিজে সেই সুরের টান ধরেছি অনেকবার। যখন ফিতার যুগ ছিল তখন হেমন্তের ক্যাসেট কিনে কতোবার যে শুনেছি সেই গান তার ইয়ত্তা নেই। ইন্দ্রজালের যুগ আসায় নেট থেকে ডাউনলোড করেও শুনেছি অনেকবার। ‘আয় খুকু আয়’।
পাঁচদিন পর আমার একমাত্র সন্তান (কন্যা) পৃথিবীর বুকে এক বছরে পা রাখবে। (যদিও এই জন্মতারিখ নিয়ে আমার দ্বিমত আছে। মেডিকেল সাইয়েন্স অনুযায়ী মাতৃগর্ভে ভ্রুণ সৃষ্টির দিন থেকেই প্রাণীর জন্ম প্রক্রিয়া শুরু। সে অনুযায়ী প্রচলিত জন্মতারিখ লেখা বা গণনা সঠিক নয়)। বিশ্বাস করতাম আমি আগাগোড়া একটা আসক্তিহীন মানুষ। স্বদম্ভে আমি ঘোষণা দিতাম- ‘পৃথিবীর কোনো কিছুতে আমার আসক্তি নেই’। কিন্তু বাবা হওয়ার পর প্রথম যখন আমার মেয়েকে দেখলাম আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। বিস্ময়ে আমার চোখে জল এসে গেলো। সেই থেকে আমার আবেগের শুরু। যতদনি যায় বুঝতে পারছি আমি খুব আসক্ত হয়ে পড়ছি।
প্রতিদিন আমি আমার মেয়ের দিকে নীরবে অপলক তাকিয়ে থাকি। প্রায় সময় আমার মনের অজান্তে জল এসে ভরাট হয় চোখের কোণে। প্রতিদিন সে বেড়ে উঠছে। চার-পাঁচটা শব্দে তার কথা ফুটছে। আমার কাছে তার সবচেয়ে মধুর শব্দ ‘পাপা’ মানে বাবা। নিজে নিজে দাঁড়াতে শিখছে সে এখন। দু-এক কদম এগিয়ে পড়ে যায়, আবার প্রচেষ্টা চালায় উঠে দাঁড়ানোর। ওর প্রত্যেকটা কর্মকাণ্ড আমি সুনিপুণ চোখে দেখি। কোনো কারণে যখন ও কাঁদে আমি সহ্য করতে পারি না। অনেক সময় আমার চোখেও জল এসে যায়। আমার কেন জানি ভয় হয়। আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে বলেছি, ‘আমার আকষ্মিক মৃত্যুতে আমার একটা চোখ ও একটা কিডনি বিক্রি করে (যদি সম্ভব হয়) আমার কন্যার জন্য অর্থায়ন করতে। আর দেহটা যেন কোনো সরকারি মেডিকেলে দান করা হয় চিকিৎসা গবষেণায়। তবে শর্তস্বরূপ অন্য একটা চোখ ও কিডনি জ্ঞানপিপাষু কোনো ব্যক্তিকে দান করতে (যদি পাওয়া যায়)।
আমার ‘দি ফাদার’ হয়ে উঠা শুরু যেভাবেঃ
আমি নিজস্ব ভাব ধারার। মেয়ের নাম রাখা নিয়ে হলো বিতর্ক প্রতিযোগিতা। আমি চেয়েছি কিছু বাংলা বা ইংরেজি নাম রাখতে। কিন্তু পরিবারের প্রতিবাদের মুখে রাখতে হলো আরবি নাম। আমার স্ত্রীকে আমার বলা আছে- কখনও যেন আমার মেয়ের জন্য খেলনা হিসেবে কোনো পুতুল কিনে নেওয়া না হয়। যেন তাকে কখনও পুতুলের বিয়ে দেওয়া টাইপের কোনো খেলা খেলতে দেওয়া না হয়। কখনও ভুলেও যেন তাকে বউ সাজিয়ে বউ বউ টাইপের খেলা তার সাথে খেলা না হয়। ওকে যেন লিপিস্টিক ও চুড়ি পরার প্রতি আকৃষ্ট করা না হয়। কারণ আমি ওর মধ্যে কারও বউ হতে হবে ওই সনাতনী মানসকিতা জন্ম দিতে চাই না। আমি তাকে ভবিষ্যতে কারও বউ বা কামনার বস্তু নয় একজন মহীয়ষী হতে হবে এরকম মনোবাসনা নিয়ে বড় করতে চাই। অধিকন্তু তার খেলনা হিসেবে আমি বিভিন্ন প্রাণী বা যন্ত্রযানের খেলনা কিনে দেই। যাতে তার মধ্যে প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা এবং বিজ্ঞানের প্রতি আর্কষণ শুরুতেই তৈরি হয়। আমার স্ত্রীকে আমি জানিয়েছি, ‘আমি আমার মেয়েকে সব ধর্ম সম্পর্কে শেখাতে চাই।’ ও সঠিকটা বেছে নেবে (?)। আমি আমার সন্তানকে ভুত আর জীনের গল্প শোনাতে চাই না। আমি তাকে বিভিন্ন মনীষী, বিখ্যাত ব্যক্তি আর বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের বাস্তব গল্প বলতে চাই। আমি ওকে গান শোনাই সুস্থ মনোবিকাশের জন্য। সেদিন রাতে সামান্য তর্ক হলো আমার স্ত্রীর সাথে। সে বলছিল, ‘আমার মেয়েকেও কান ফোঁড়াতে হবে আগামীতে’। বাধ সাধলাম আমি। বললাম, ‘আমার মেয়েকে আমি কখনও পশুর মতো অলংকারের শিকলে বন্দি দেখতে চাই না। ওটা নারীর জন্য প্রহসন মনে করি আমি। আমি বিশ্বাস করি নারীর অংলকার আর সাজসজ্জার প্রতি আসক্তি নারীকে জ্ঞান, বিজ্ঞান, সমাজ আর মানবতাবিমুখ করে তোলে। নারী হয়ে ওঠে উচ্চাকাঙ্ক্ষী। অধিকন্তু নারীকে করে তোলে পণ্য। জন্মের পর থকেইে মেয়ের চিন্তা-চেতনার বিকাশের জন্য আমি বাসার বিভিন্ন দেওয়াল সাজিয়েছি বাঁধাই করা ছবিতে (চে গুয়েভারার ছবি, লিওনার্দোর অপ্রকাশতি ছবি, 10 Most Popular Leaders of the World-2015 ছবি)। আমার মেয়ের জন্মের আগে থেকে এখনও বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার ও প্রখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী ডাউনলোড করা, বই (স্টিভ জবসের ওপর বই, ড. আবুল কালাম আজাদের লেখা বই, প্রফেসর হানটিংটনের বই, অভিজিত রায়ের বই ইত্যাদি) কেনা এবং চলচিত্র সংরক্ষণে রাখছি। এ তালিকায় গত ১৯ জানুয়ারি যোগ হলো বাংলা চলচিত্র জগতের সব দিক দিয়ে সেরা অন্যতম ভালো চলচ্চিত্র ‘দি ফাদার’। এই সুবাদে দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ হলো চলচ্চিত্রটি।
১৯৭৯ সালে নির্মিত কাজী হায়াৎ পরিচালিত বাবা-মেয়ের দুটো প্রধান চরিত্রের সেরা ডায়ালগ, হৃদয়গ্রাহী আবেদন আর অভিনয়ের চলচিত্র এটি। প্রধান চরিত্র বাবার চরিত্রে অভিনয় করা ২২ বছর বাংলাদেশে অবস্থানকারী আমেরিকান বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা জন নেপিয়ার এডামসের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি এই চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রের শুরুতে ৮ মিনিটের সময় অভিনেতা বুলবুল আহমেদের প্রতি বাবা জন নেপিয়ারের বেদনাহত বিষ্ময়শুলভ জিজ্ঞাসা ‘কেন (সবুজ), মেয়েকে আদর করে চুমু খাওয়া যায় না! মেয়ের সঙ্গে নাচা যায় না!’ আমার ভয়টাও ওখানে। আমার এখনই ভাবতে মন খারাপ করে এতো আদরের, এতো শখের একটা মেয়েকে আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের কাছে রেখে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখতে পারবো তো! মেয়ে যতো বড় হচ্ছ, ভয় ততো বাসা বাঁধছে মনে।
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের একটা কথা মনে পড়ে খুব, ‘মেয়েদের জীবনটা বড় বিচিত্রের। জীবনের মাঝামাঝি এসে নতুন লোকের সাথে নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়।’ স্বার্থপরের মতো ভাবি মেয়েকে আমি বিয়ে দেবো না। সারা জীবন আমার কাছে রেখে দেবো যতো দিন বাঁচি। একটা সময় শুনেছি বাঙালি ছেলেরা তাদের মায়ের প্রতি বাবার ভালোবাসাকে ভাগ হতে দিতে চায় না। আমারও কেন জানি মনে হয় আমিও আমার মেয়ের ভালোবাসা ভাগ করতে দিতে চাই না। আমি আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে একটা দিনের জন্যও হারাতে চাই না। প্রয়োজনে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মেয়ে জামাইসহ কাছেই রেখে দেবো। এই সমাজের প্রচলিত বদ্ধ নিয়ম মানতে পারবো না। মেয়ে একদনি বড় হবে। শিশু থেকে কিশোরী হবে। তারপর যুবতী হবে। তার জগতে বিচরণ করবো তো? তাকে এখনকার মতো জড়িয়ে ধরতে, চুমু খেতে পারবো তো? ও আমার কোমরের ওপর পা তুলে দিয়ে, গলা জড়িয়ে গা ঠেসে শুয়ে থাকতে পারবে তো? এখনকার মতো বুকের মধ্যে আগলে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, পিঠ চাপড়ে ওকে ঘুম পাড়াতে পারবো তো? নাকি ‘দি ফাদার’ চলচ্চিত্রের জন নেপিয়ারের মতো তথাকথিত বাঙালি মনোভাবের কাছে হার মানতে হবে বাবার মমত্বকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে? আমি আমার সন্তানের সারা জীবনের আশ্রয় হতে চাই। আমি তার সব বয়সে একই রকম বাবা হয়ে থাকতে চাই। একই রকম দায়িত্ব পালন করতে চাই যেমনটি এখন আছি। তার ঘুমানো, তার খাওয়া, তার খেলাধুলা, তার দুষ্টুমী, তার গোসল করা, টয়লেট সারানো, ঠান্ডার ভয়ে হাত-পায়ের তালুতে রসুনসহ গরম করা সরিষার তেল মাখানো, গান শোনা ইত্যাদি সবকিছুতে আমি তার সাথে জড়িয়ে থাকতে চাই। আমাদের সমাজ তা ভালো চোখে দেখবে তো?
লেখক: কলাম লেখক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম