চীনের আগুয়ান নারীসমাজ ও একজন ‘সুপার উওম্যান’
চায়না মিডিয়া গ্রুপ, সংক্ষেপে সিএমজি। চীনের চারটি সরকারি গণমাধ্যম নিয়ে গঠিত এই গ্রুপ: চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল (সিআরআই), চায়না ন্যাশনাল রেডিও (সিএনআর), চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশন (সিসিটিভি) ও চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক (সিজিটিএন)। আমি কাজ করি চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালের বাংলা বিভাগে (বাংলাদেশের রেডিও-শ্রোতারা একে চেনে চীন আন্তর্জাতিক বেতার বা সিআরআই নামে)। আমাদের বিভাগে চীনা কর্মীর সংখ্যা ১৩। এদের মধ্যে মাত্র একজন পুরুষ। বাকি ১২ জনই নারী। বিভাগের পরিচালক ও উপ-পরিচালকও নারী।
বাংলা বিভাগের লাগোয়া হিন্দি বিভাগ। দুই বিভাগের মাঝে কোনো দেওয়াল নেই। আমরা ওদের দেখি, ওরা আমাদের দেখে; আমরা ওদের কথাবার্তা শুনি, ওরা আমাদের কথাবার্তা শোনে। হিন্দি বিভাগেও চীনা কর্মীর সংখ্যা ১৩। তাদের মধ্যে পুরুষ অবশ্য দুজন। বাকি ১১ জন নারী। হিন্দি বিভাগের পরিচালকের আসনটিও অলঙ্কৃত করে আছেন একজন নারী।
উর্দু বিভাগ একই ফ্লোরে, তবে সেখানে যেতে হলে বাংলা বিভাগ থেকে বের হয়ে কয়েক কদম হাঁটতে হয়। উর্দু বিভাগে চীনা কর্মীর সংখ্যা ৯ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ দুজন ও নারী সাতজন। উর্দু বিভাগের পরিচালকও একজন নারী। সিআরআইয়ের অর্ধশতাধিক ভাষাগত বিভাগ আছে। কর্মীদের জেন্ডার বিবেচনায় নিলে, পরিস্থিতি বলতে গেলে সবখানে কমবেশি একই রকম।
আমাকে মাঝে মধ্যে ব্যাংকে যেতে হয়। সবাইকেই যেতে হয়। একাধিক ব্যাংকের একাধিক ব্রাঞ্চে আমাকে নানান সময় যেতে হয়েছে। সবখানেই নারীকর্মীর সংখ্যা বেশি। গত দশ বছরে একাধিক হাসপাতালে গেছি। নার্সদের অধিকাংশই নারী। তবে ডাক্তারদের মধ্যে নারীর সংখ্যা অর্ধেক না হলেও কাছাকাছি মনে হয়েছে।
আমি নিয়মিত একটা কাঁচাবাজারে যাই। সেখানে একটি খোলা দোকানে হালাল গোশত বিক্রি হয়। অধিকাংশ সময় যিনি আমার কাছে গোশত বিক্রি করেন, তিনি একজন নারী। দোকানে কদাচিৎ তার স্বামীকে দেখা যায়। গোশতের দোকানের পাশে মাছের খোলা দোকান। বড় বড় চৌবাচ্চায় বিভিন্ন ধরনের জিয়ল মাছ। যিনি আমার কাছে মাছ বিক্রি করেন এবং সুন্দর করে মাছ কেটে দেন, তিনি একজন সদাহাস্যময় নারী। তার স্বামীকেও কদাচিৎ দোকানে দেখা যায়। আসলে কাঁচাবাজারজুড়ে যত দোকান আছে, সেগুলোর অধিকাংশই চালান নারীরা। পুরুষদের সংখ্যা হাতেগোনা।
এমন নয় যে, চীনের সব পেশায় নারীদের সংখ্যা বেশি। চীনে নির্মাণশ্রমিকদের অধিকাংশই পুরুষ। বড় বড় যাত্রীবাহী বাস যারা চালান, তাদের অধিকাংশ পুরুষ (যদিও অসংখ্য নারী নিজেদের গাড়ি চালান)। তবে মাঝে মাঝে বিশাল বাসের বিশাল স্টিয়ারিং হাতে নারীদেরও দেখা যায়। বেইজিংয়ে যারা ট্যাক্সি চালান, তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশও নারী।
আমার ছেলে প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। তার স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষকই নারী (প্রিন্সিপালসহ)। চীনের যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি একসময় খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি; চীনা শিক্ষার্থীদের বাংলা পড়িয়েছি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দুজন চীনা শিক্ষকের দুজনই নারী। ধারণা করি, চীনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী-শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি হবে। বস্তুত চীনের সর্বত্রই নারীদের পদচারণা। মাটিতে তো বটেই, মহাকাশেও। এই মুহূর্তে চীনের তিনজন নভোচারী মহাকাশে আছেন। তাদের একজন নারী।
বিজ্ঞানের জগতেও চীনা নারীরা রাখছেন উল্লেখযোগ্য অবদান। ১৯৭২ সালে চীনা বিজ্ঞানী থু ইয়োইয়ো ম্যালেরিয়ার ওষুধ আবিষ্কার করেন এবং এ জন্য ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি চীনের প্রথম নারী যিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী প্রথম চীনাও তিনি। এর আগে ২০১১ সালে, একই অর্জনের জন্য, তিনি লাস্কার পুরস্কার (Lasker Award) লাভ করেন। বলা বাহুল্য, তিনিই প্রথম চীনা যিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হন।
থু ইয়োইয়ো আগের প্রজন্মের নারী বিজ্ঞানী। এই মুহূর্তে চীনে একজন নারী চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর নাম বলতে গেলে সবার মুখে মুখে। নিজ সহকর্মীদের কাছে তিনি পরিচিত ‘সুপার উওম্যান’ নামে। নতুন প্রজন্মের এই বিজ্ঞানীর নাম ওয়াং ছিহুই। কোভিড-১৯ কে পরাজিত করতে পারে— এমন একটি অ্যান্টিবডি ড্রাগ আবিষ্কারের দায়িত্ব পড়েছিল ৩৭ বছর বয়সী এই নারীর ওপর।
তিনি পেশায় একজন ভাইরাসবিদ বা ভাইরলজিস্ট; কাজ করেন চীনের বিজ্ঞান একাডেমির ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোবায়োলজিতে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তার ওপর বর্তায় নতুন অ্যান্টিবডি ড্রাগ আবিষ্কারের কঠিন দায়িত্ব। তিনি তার দল নিয়ে দিনরাত কাজ করতে থাকেন। ল্যাবে চলতে থাকে টানা গবেষণা। প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে তাকে কাজ করতে হয়। কারণ, তখন এমন একটা কথা চাউড় হয়েছিল যে, চীনা বিজ্ঞানীদের পক্ষে এমন একটা ড্রাগ দ্রুত আবিষ্কার করা সম্ভব নয়।
ওয়াং নবিশ বা আনাড়ি ছিলেন না। ভাইরাস নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন অনেক আগে থেকেই। এই ফিল্ডেই তিনি ২০১২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি যোগ দেন ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোবায়োলজিতে, অংশ নেন মিডলইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোমের (এমইআরএস বা মার্স) গবেষণায়। চার বছর পর তিনি জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত থেকে এ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি আলাদা করতে সক্ষম হন। বিশ্বের সেরা বিজ্ঞান জার্নালগুলোতে তার কয়েক ডজন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
অল্প বয়সেই যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জনকারী ওয়াংয়ের জন্যও কোভিড-১৯ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি ড্রাগ আবিষ্কার করা ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। গবেষণাকাজের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়কালে তাকে একবার টানা ১৫ দিন ল্যাবে কাটাতে হয়েছে। তখন কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে চেয়ারেই ঘুমিয়ে নিতেন। খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। সে সময়ের কথা স্মরণ করে ওয়াং বলেন: ‘মাঝে মধ্যে মনে হতো, আমি মরে গেছি।’
মরে না গেলেও প্রচণ্ড কাজের চাপে স্নায়ুবিক বধিরতায় (neurological deafness) আক্রান্ত হন তিনি; সাময়িকভাবে তার বাম কানের শ্রবণক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তাকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দেন যে, যথাযথ চিকিৎসা না-নিলে চিরতরে তার শ্রবণক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাধ্য হয়ে তাকে পাঁচদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়। কিন্তু ততদিনে, আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল তার নেতৃত্বাধীন গবেষক দলটি। কোভিড মহামারি শুরুর মাত্র পাঁচ মাস পরই তিনি ও তার দল ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে যান, আবিষ্কার করেন কোভিড ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবডি ‘জেএস০১৬’। বিশ্বে সেটি ছিল এ ধরনের প্রথম অ্যান্টিবডি ড্রাগ। ২০২০ সালের নভেম্বরে ১৫টি দেশে এই ড্রাগের জরুরি ব্যবহার অনুমোদন করা হয়। সেসব দেশের মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও একাধিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র।
ওয়াং ছিহুইকে তার সহকর্মীরা ডাকেন ‘সুপার উওম্যান’। কিন্তু তিনি নিজেকে একজন সাধারণ মানুষই মনে করেন, যার স্বামী আছে, আছে সাত বছরের একটি ছেলে। স্বামী-সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না বলে তার মনে আক্ষেপ আছে। তবে মানুষের কল্যাণে নিত্যনতুন গবেষণাকাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কোভিডের নতুন ভ্যাক্সিন ও ড্রাগ নিয়ে তিনি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এখন কাজ করছেন নাকে স্প্রে করার উপযোগী অ্যান্টিবডি ড্রাগ নিয়ে। পাশাপাশি ব্যস্ত আছেন কোভিডের এমআরএনএ ভ্যাক্সিন তৈরির কাজে।
বস্তুত চীনে ওয়াং ছিহুইয়ের মতো ব্যস্ততার মধ্যে জীবন কাটছে অনেক নারীর, যারা বিভিন্ন সেক্টরে নিজেদের ভূমিকা রাখছেন। তাদের সবাই হয়তো ‘সুপার উওম্যান’ নন, তবে আজকের আধুনিক চীন গড়ার কারিগর তারাও বটে। ২০১৯ সালে একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, যাতে বিশ্বের এমন ১০০ ধনী নারী শিল্পপতি স্থান পান, যারা একেবারে শূন্য থেকে নিজেদের সম্পদের পরিমাণ অন্তত ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছেন। এ তালিকার ৬১ জনই ছিলেন চীনা নারী। একই বছর চীনের পাঁচজন নারী বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায়ও স্থান পান।
শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে নয়, চীনা নারীদের সরব পদচারণা বাড়ছে রাজনীতিতেও। দেশের বিভিন্ন স্তরের সরকারে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। ২০১৮ সালে চীনের ত্রয়োদশ জাতীয় গণকংগ্রেসে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ২৪.৯ শতাংশ। সেই একই বছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংসদগুলোতে নারী সদস্যের সংখ্যা ছিল মোট সদস্যের ২৪.৩ শতাংশ।
শুধু সংখ্যার দিক দিয়েই তারা এগিয়ে আছেন, তা নয়; চীনা নারীরা কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনা সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও ক্রমবর্ধমান হারে অংশগ্রহণ করছেন। ২০১৭ সালে চীনে সরকারি সংস্থায় নারী-কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ২৬.৫ শতাংশ। চীনের সরকারি সংস্থাগুলোতে নতুন করে যারা নিয়োগ পাচ্ছেন, তাদের ৫২.৪ শতাংশই নারী। ২০১৮ সালে চীনে নারী এটর্নির সংখ্যা ছিল ৪১.৭ শতাংশ; নারী বিচারপতির সংখ্যা ৩৩.৭ শতাংশ; নারী আইনজীবীর সংখ্যা ৩৬.১ শতাংশ। এ হার এখন আরও বেড়েছে বললে ভুল হবে না।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি উন্নত জাতি দেবো।’ চীনের নারীরা শিক্ষা-দীক্ষায়ও অনেক এগিয়েছে। শিক্ষা এখন আর অভিজাত শ্রেণির বিষয় নয়। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের ২৫ শতাংশ ছিল নারী। এখন সেই হার বেড়ে ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষিত মা যদি উন্নত জাতি গঠনের পূর্বশর্ত হয়, তবে বলতেই হবে চীন সে শর্ত শতভাগ পূরণের দিকে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে।
চীনে একটি কথা প্রচলিত আছে: ‘নারীরা অর্ধেক আকাশ বহন করতে পারে।’ ঠিক কাছাকাছি অর্থের একটি কথা বলে গেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও। তিনি বলেছেন: ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ চীন একটি বিশাল ও বৈচিত্র্যময় এবং বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। চীন যেন এই বিশ্বের মধ্যে আরেকটি মিনি বিশ্ব। এই মিনি বিশ্বে যা কিছু গড়ে উঠেছে, যা কিছু অর্জিত হয়েছে, ‘অর্ধেক আকাশ বহনকারী’ নারীদের অবদান তাতে নিদেনপক্ষে অর্ধেক তো বটেই!
লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/এমএস