জনশুমারিতে তথ্য দিন, উন্নয়নে অংশ নিন

এরশাদুল আলম প্রিন্স
এরশাদুল আলম প্রিন্স এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশিত: ১১:৫৬ এএম, ১৫ জুন ২০২২

আজ থেকে সপ্তাহব্যাপী শুরু হতে যাচ্ছে জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২। সবশেষ জনশুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে। প্রতি ১০ বছর পরপর এমন জনশুমারি হওয়ার কথা।

দেশে প্রথম আদমশুমারি হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নির্দেশনায় ১৯৭৪ সালে। স্বাধীনতার পর এটিই প্রথম জনশুমারি। এর পর ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০১ ও সবশেষ ২০১১ সালে আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কোভিড মহামারির কারণে ২০২১ সালে শুমারি হয়নি। ২০২১ সালের ২ থেকে ৮ জানুয়ারি প্রথম জনশুমারির তারিখ নির্ধারণ করা হয়। করোনার জন্য পিছিয়ে ২৫ থেকে ৩১ অক্টোবর ও পরে ২৫ থেকে ৩১ ডিসেম্বর সময় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ট্যাব কেনাকাটার জটিলতার কারণে আজ ১৫ থেকে আগামী ২১ জুন সময় নির্ধারণ করা হয়।

আদমশুমারি একটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি আরও বেশি প্রয়োজন। আমাদের সম্পদ সীমিত। দেশের আয়তনও কম। সেই সঙ্গে আছে অধিক জনসংখ্যার চাপ। স্বাধীনতার সময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। আজ তা ১৮ কোটি না ২০ কোটি এটি নিয়ে দ্বিমত আছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। একটি দেশের উন্নয়ন আপনা-আপনি হয় না। হ্যা, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় একটি পরিবর্তন তো হয়ই। আজ থেকে ২০ বছর আগের আমার গ্রাম আর আজকের সেই গ্রামের মধ্যে তফাৎ অনেক। পুরনো স্মৃতি মনে পড়লে আজকের সঙ্গে তা মেলানো কঠিন।

সেই শৈশবেই শুনেছিলাম আদম শুমারির কথা। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মানুষ গণনা করা হতো। আদমশুমারি বলতে তখন শুধু বুঝতাম মানুষ গণনা। প্রত্যেক বাড়ির ঘরে ঘরে গিয়ে শুমারিকারীরা মানুষ গণনা করতো। গণনা শেষে ঘরের দরজার চৌকাঠে নম্বর বসিয়ে দিতো চক বা আলকাতরার কালি দিয়ে। কোন কোন বাড়ি শুমারি হয়েছে আর কোন কোন বাড়ি এখনও শুমারি হয়নি তা এখান থেকেই বোঝা যেতো।

এখন সময় বদলেছে। সেই গ্রাম আজ শহর। আমরাতো বলছিই যে, গ্রাম হবে শহর। হয়েছেও তাই। রাজধানীর ভাড়া বাড়ির পার্কিং থেকে গাড়ি চালিয়ে গ্রামের নিজ বাড়ির উঠানো গিয়ে নামা যায়। সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঈর্ষণীয়। শুধু তাই নয়, মানুষের আয়ও বেড়েছে। মানুষ আজ না খেয়ে নাই। স্বাধীনতার পরে হাটিহাটি পা পা করে আমরা এগিয়েছি। রাজনৈতিক বাদানুবাদ আছে, ছিল। কিন্তু এরই মাঝে ধীরে ধীরে আমরা এগিয়েছি। হয়তো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু তাই বলে আমাদের উন্নয়নের যাত্রা থেমে নেই। কতটা এগুতো পারতাম সে প্রশ্ন করাই যায়। ভবিষ্যত কর্ম পরিকল্পানাকে আরও শাণিত করার জন্য এ প্রশ্ন বরং করাই উচিত। কিন্তু কর্ম পরিকল্পনা নেওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন আমার সম্পদ ও সমস্যার একটি খতিয়ান। সেই হিসাব না থাকলে সুষম উন্নয়ন হবে না। হবে না সম্পদের সুষম বন্টন ও সঠিক ব্যবহারও।

আমার কী আছে আর কী নেই সেই হিসাবই যদি না থাকে তবে আমার কী লাগবে সে হিসাব কীভাবে করবো? সহজ কথায় আদম শুমারির এটাই উদ্দেশ্য। একটা সময় শুধু মানুষ গণনা করা হতো। এখন শুমারিতে শুধু মানুষ গণনা করা হয় না। এখন মানুষের পাশাপাশি মানুষের আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হয় যাতে করে এ তথ্য-উপাত্তগুলো কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য সঠিক কর্ম ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়।

সে কারণ এবারের শুমারিতে প্রশ্নের সংখ্যা কিছু বেশি। এগুলো সবেই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। কয়েকটি প্রশ্ন যেমন- বাড়ির উপাদান, ঘরে মোট লোক সংখ্যা, পরিবারের প্রধান পুরুষ না মহিলা, পানীয় জলের মূল উৎস, বাসা টয়লেট, ইন্টারনেট অ্যাক্সেস বা না, ল্যাপটপ/কম্পিউটার বা না, টেলিফোন/মোবাইল ফোন/ স্মার্টফোন, গাড়ি/ জিপ/ভ্যান, মোবাইন নং ইত্যাদি। এছাড়া চাকরি ও কর্ম সংস্থানের তথ্য, সম্পদ বা আয়ের উৎস ইত্যাদি অপরাপর মৌলিক প্রশ্নগুলোতো থাকবেই। এরকম মোট ৪৫টি প্রশ্ন থাকবে।

সংগৃহীত তথ্যগুলো শুধু আদম শুমারির কাজে ব্যবহার করা যাবে। অন্য কোনোভাবে ও উদ্দেশ্যে প্রদেয় তথ্য ব্যবহার করা যাবে না। এটি নাগরিকের তথ্য ও তথ্যের গোপনীয়তার অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

এবারের জনশুমারিতে প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার গণনাকারী, ৬৪ হাজার সুপারভাইজার ও বিবিএস এর ৪ হাজার ৫০০ এর অধিক কর্মচারী নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়াও বিবিএস বহির্ভূত বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রায় ৯০০ জন কর্মচারীও জোনাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

এবারই প্রথম শুমারি হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতি। এ লক্ষ্যে একটি ওয়েবভিত্তিক Integrated Census Management System (ICMS) প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া Geographical Information System (GIS) পদ্ধতি ব্যবহারপূর্বক গণনা এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের কন্ট্রোল ম্যাপ প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব কাজ সঠিকভাবে করার জন্য শুমারিকারীদের আগেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আশা করি, সবকিছু ঠিকভাবেই সম্পন্ন হবে।

ডিজিটাল পদ্ধতিতে শুমারি করার জন্য সরকারকে ট্যাব কিনতে হয়েছে। এই ট্যাব কেনা নিয়ে জটিলতার কারণেও যথা সময়ে শুমারি সম্পন্ন করা যায়নি। জটিলতা শেষে ওয়ালটন ৪৪৮ কোটি টাকা দর প্রস্তাব করে ও তাদের কাছ থেকেই ট্যাবগুলো কেনা হয়। ডিজিটাল পদ্ধতিতে শুমারি হচ্ছে এটি একটি ইতিবাচক দিক। তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এতে সহজ হয়। ব্যয়ও কম হওয়ার কথা। তবে, তথ্য-উপাত্ত যাতে সঠিকভাবে সংগৃহীত হয় ও সংরক্ষিত থাকে সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে উপাত্ত বা Data ভাণ্ডারের যাতে কোনো অপব্যবহার না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

জনশুমারিতে তথ্য প্রদান আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রকে সঠিক কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে তথ্য প্রদান করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ জন্য নাগরিককে কোনো টাকা-পয়সা খরচ করতে হবে না। থানায় বা কোথাও গিয়েও তথ্য দিতে হবে না। তথ্য সংগ্রহকারীরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে। আমাদের শুধু তথ্য দিতে এগিয়ে আসতে হবে। এ বিষয় নেতিবাচক মনোভাব কাম্য নয়। জনশুমারিতে সকল নাগরিকের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক তথ্য দিতে হবে।

তবে সফল শুমারি পরিচালনার জন্য সরকারের কিছু দায়িত্ব ছিল বলে মনে করি। সরকার গণমাধ্যমে আরও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারতো। বেশিরভাগ লোকই জানে না যে আজ থেকে জনশুমারি শুরু হতে যাচ্ছে। যার জন্য শুমারি, যাকে নিয়ে শুমারি- সেই জনগণকে অন্ধকারে রেখে শুধু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শুমারি করা কোনো কাজের কথা নয়। জনগণকে আরও ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করা যেতো বলে মনে করি।

এছাড়া ভরা বর্ষা মৌসুমে শুমারি করা বাস্তবসম্মত হয়নি বলেই মনে করি। এখন দেশজুড়ে পুরো বর্ষা মৌসুম চলছে। এছাড়া দেশের কয়েকটি অঞ্চলে প্রবল বা মৃদু বন্যাও হচ্ছে। ভোটও হচ্ছে কোথাও কোথাও। তথ্য সংগ্রহে এটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বর্ষা মৌসুমে শুমারি করতে গিয়ে সরকারকে অতিরিক্ত ৩২ কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। বর্ষার জন্য সাড়ে চার লাখ ছাতা কিনতে হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। প্রতিটি ছাতা ২৬০ টাকা করে কেনা হয়। ট্যাবের জন্য পানিনিরোধক ব্যাগ কেনায় ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি টাকা। এছাড়া বৃষ্টিতে দুর্গম এলাকায় যেতে স্পিডবোট বা ট্রলারের পেছনেও খরচ আছে। এসবই বর্ষার খরচ।

অতীতেও এদেশে আদম শুমারি হতো। তখন আদম শুমারির উদ্দেশ্য ছিল প্রজা গণনা যাতে প্রজাদের কাছ থেকে ঠিকমতো খাজনা আদায় করা যায়। এছাড়া সেনাবাহিনী ও লস্কর বাহিনীতে লোক নিয়োগ দেয়াও এর উদ্দেশ্য ছিল। শুমারি করলে বোঝা যায় দেশের জনসংখ্যা কমে বা বেড়ে কত দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও জানা যায় শুমারির মাধ্যমে। জন্মমৃত্যুর হার, শিক্ষার হারসহ নানা তথ্য উঠে আসে শুমারি থেকে। শহরে কত লোক বাস করে, গ্রামে কত লোক বাস করে তাও জানা যায়। ভোটার তালিকার বিষয়টি তো রয়েছেই। এছাড়া আগের শুমারির সঙ্গে পরবর্তী শুমারির তুলনামূলক হিসাব করলে আরও অনেক তথ্য বের হয়ে আসে। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তগুলোর প্রবণতাও এ থেকে বোঝা যায়।

কাজেই, শুমারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটি দেশ ‍ও জনগণের স্বার্থে পরিচালিত একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এটিকে সফল করা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। তাই সঠিক তথ্য দিয়ে দেশ গড়ায় আমাদের এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।