দোহানো দুধ কি পুনরায় বাটে ঢোকানো যায়?
গাভীর বাট থেকে দোহানো দুধ কি পুনরায় বাটে ঢোকানো যায়? প্রকৃতি সে ব্যবস্থা রাখেনি। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতাও এমন ব্যবস্থা করতে পারেনি বা করেনি। এ-জন্যে একবার দুধ দোহানো হলে তাকে ফেরৎ দেয়া যায় না। অর্থ-বিত্ত পাচার হয়ে যাওয়ার পর তা ফিরিয়ে আনা যায় না। টাকার ধর্ম হচ্ছে, যেখানে সে বেশি সিকিউর্ড সেখানেই তার সুখবাস।
বাংলাদেশের চেয়ে কানাডা, আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলোতে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থবিত্ত বেশি নিরাপদ বলেই তো যুগের পর যুগ ধরে মানিলন্ডারিংয়ের হোতারা ওই সব নিরাপদ আশ্রয়ে গেছে/যায়। অতীতে সবচেয়ে নিরাপদ ছিলো সুইস ব্যাংকগুলো। তারা লুটপাটকারীদের অর্থ নিরাপদে রাখার জন্য এমন একটি আইন করেছে যে সে কাউকে তথ্য দিতে বাধ্য নয়। ফলে অর্থ পাচারিরা সুইৎজারল্যান্ডেই নিজেদের অসৎ উপার্জনের বিত্ত গচ্ছিত রাখতো।
এখন পৃথিবীর ধনী দেশগুলো এ-দেশের লুটেরা, দুর্নীতিবাজদের জন্য ওপেন মার্কেটে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় সেকন্ড হোম নামের একটি প্রকল্পের আওতায় এ-দেশের শত শত ধনবান বিনিয়োগের মাধ্যমে গেছেন তাদের কথিত দ্বিতীয় বাড়িতে। সেটা ছিল সরকার বিরোধী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, ঘুসখোর আমলা-কামলা, দুর্নীতিবাজদের মানিলন্ডারিংয়ের সূচিমুখ। সরকারের দমনপীড়নমূলক শাসনের হাত থেকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার লক্ষ্য যেমন ছিল তেমনি আত্মরক্ষার পথ হিসেবেও কেউ কেউ সে দেশে গেছে। কিন্তু এখন আমেরিকা, কানাডা হচ্ছে দুর্নীতিবাজ লুটেরা রাজনীতিক, ঘুসখোর আমলা, ব্যাংকারসহ সব ধরনের লুটেরাদের অভয়ারণ্য।
গত ১৫ বছরে মাত্র ১১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে অনুন্নত বাংলাদেশ থেকে। তিন হাজার কোটি টাকা থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকাও পাচার হয়ে গেছে প্রতি বছর। এটা লিস্ট ডেভেলপড বাংলাদেশের অগ্রগতিকে কেবল ডিরেইলডই করেনি, আমাদের দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও আর্থিক ব্যাকবোনকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের গোলকে নস্যাৎ করে দেবার পথে বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে।
সরকার প্রতি অর্থবছরই লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যাংক ও অর্থবিষয়ক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে এবং জাতীয় বন্ড থেকেও ঋণ নিয়ে চলছে। বর্তমান সংসদে উপস্থাপিত বাজেট প্রস্তাবেও কোন কোন পথে বাজেটের ঘাটতি মোকবিলা করা হবে তার তালিকা দেয়া হয়েছে। এবং সেই অর্থের অনর্থ (সুদ) সব মিলিয়ে ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বৃহদাংশই দেশি ও বৈদেশিক ঋণের সুদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনভাতা দিতেই ব্যয় হয়ে যাবে।
এর মানে হচ্ছে, সরকারের হাতে আয়ের উৎসে টান পড়েছে। রেমিটেন্সের মাধ্যমে আয়ের ঘাটতি তার একটি। কেন রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে না প্রবাসী শ্রমজীবী মানুষেরা? এ-প্রশ্নের তলানিতে আছে এর উত্তর। রেমিটেন্স দাতারা আজ আর ভরসা রাখতে পারছে না তাদের কষ্টার্জিত টাকা নিরাপদ নয়, তার নিজের দেশে। এরপরই আছে রফতানি বাণিজ্যের অধিপতিরাও দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের ভয়ে ইভেয়েসিংয়ের মাধ্যমে আয়ের একটি অংশ বিদেশেই রাখছে। এভাবে কমে যাচ্ছে বৈদেশিক আয়।
বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ যদিও নষ্ট হয়নি, তবে তার পরিমাণ এমন নয় যে আমাদের অর্থনৈতিক চাহিদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একারণেই অর্থমন্ত্রী ভেবেছেন পাচার হওয়া টাকা যদি দেশে ফেরানো যায়, তাহলে একটা ভালো ফল পাবো আমরা। তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন ইন্দোনেশিয়া থেকে।
২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়া ৩০০ মিলিয়ন ডলার ফেরৎ এনেছে এভাবে। ওই দেশের অর্থ-পাচারিরা ম্যাকাও, হংকং, সিঙ্গাপুরে চোরাই পথে বিনিয়োগ করেছিল। ইন্দোনেশিয়া যা পেরেছে তা আমাদের অর্থ পাচারিরা বুঝবে, এমন সাদামাটা নয় তাদের লুটেরা হৃদয়। আমাদের ধারণা, গাভি দোহানোর পর যেমন সেই দুধ বাটে ফেরানো বা ঢোকানো যায় না, তেমনি মানি লন্ডারগণও ফিরে আসবেন না টাকা নিয়ে। টাকার ধর্ম হচ্ছে যেখানে সে নিরাপদ, সেখানেই তার সুখ। এ-কথা তো অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের।
দুই.
মুখ ফসকেও যদি এমন কোনো কথা বেরিয়ে যায়, যা একটি ধর্মগোষ্ঠীর মনে আঘাত দেয়, তাহলে সেটাও ওই গাভির বাটের মতোই ফেরানো যায় না। হাজার বার ক্ষমা চাইলেও আঘাত পাওয়া ধার্মিকদের হৃদয়ে তার কালো দাগ থেকে যায়। ভাঙা মাটির সানকি জোড়া দেয়া যায়, তারপরও সেই দাগ কিন্তু মোছা যায় না। এজন্য অন্ধবিশ্বাসী না হয়ে, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান-ভক্তি রেখে কথা বলাই শ্রেয়। কিংবা চুপ থাকা আরো ভালো।
দিল্লির বিজেপির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা মুসলমানদের মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) ও বিবি আয়শা সম্পর্কে কটূক্তি করে টুইট করেছিলেন। আর জিন্দাল নামের আরেক বিজেপি নেতা সেটা সামাজিক মাধ্যমে দিয়ে ভাইরাল করেছে। এরই জেরে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের মুসলমানদের মধ্যে যেমন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি তারা মিছিল করে, মিটিং করে নূপুরের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
মধ্যপ্রাচ্যরে দেশগুলো- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতারসহ সব দেশই এর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ওর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রি (ওআইসি) এর নিন্দা জানিয়েছে। ভারতীয় দূতাবাসের প্রধানদের ডেকে কড়া ভাষায় কেবল প্রতিবাদই জানানো হয়নি, আরো কিছু কথা তারা বলেছেন, যাতে ভারতের মোদি সরকারের হৃদকম্প শুরু হয়েছে।
পত্রিকার নিউজে বলা হয়েছে, নূপুর শর্মা তার কটূক্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং ক্ষমাও চেয়েছে, তার টুইট শেয়ার করার অপরাধে বিজেপির আরেক নেতা জিন্দালকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। নূপুর শর্মাকে বাদ দেয়া হয়েছে তার কাজ থেকে।
সব মিলিয়ে ভারতের বিজেপি মোদি সরকারের অবস্থা নাকাল হবার জোগাড়। এর মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে শুরু করেছে। যদি সে সব দেশ তাদের ভারতীয় শ্রমিকদের বাদ দিয়ে দেয়, দেশে পাঠিয়ে দিতে থাকে, তাহলে কি পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে ভারত, তা সহজেই বোঝা উচিৎ জিন্দাল বা নূপুর শর্মার মতো উগ্রচন্ড মানুষদের।
ধর্মান্ধতা যে নিজেকে পৃথিবীর চলমান জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, সেটা কি তারা জানেন? না মানেন? হ্যা, মতপ্রকাশের অধিকার সবারই আছে, কিন্তু এমন মত প্রকাশ করা অন্যায় ও অপরাধ যা অন্য একজনকে আঘাত করে। কি এমন প্রয়োজন ছিল যে অন্য ধর্মের নবী ও তার স্ত্রী সম্পর্কে কটূক্তি করতে হবে? নূপুর শর্মার নিশ্চয়ই অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল। তিনি ইউরোপে পড়াশোনো করা একজন মধ্যবয়সী মানুষ, সেই উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক আবহাওয়া-স্নাত নূপুর শর্মা কেন এমন ধর্মান্ধের মতো আচরণ করতে গেলেন, তার কারণ খুঁজে দেখার ভারত সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। এর পেছনে কি কারণ লুকিয়ে আছে তা খুঁজে দেখতে হবে।
বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরাও প্রতিবাদে মিছিল মিটিং করছে। মসজিদে মসজিদে গত শুক্রবার নূপুর ও জিন্দালের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন তারা। যদি আরো কোনো সামাজিক উত্তাল অবস্থার সৃষ্টি হয়, হতে কতক্ষণ? তাহলে তা সামাল দেয়া সত্যই দুরুহ হয়ে উঠবে।
এসব বিবেচনা করেই কথা বলতে হয়, কথা বলতে হবে। মুখ দিয়ে একবার কথা বেরিয়ে গেলে তাকে আর ফেরানো যায় না। যেমন গাভীর বাট থেকে দুধ দোহানোর পর সেই দুধ বাটে ফেরৎ দেয়া যায় না।
প্রকৃতির এই শিক্ষাই আমাদের অন্যের প্রতি অবমাননা থেকে রক্ষা করতে পারে।
০৬-১৩-২২
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস