কুমিল্লায় নির্বাচন কমিশন পাস করবে তো?
অনেকদিন পর একটি জমজমাট নির্বাচনী লড়াইয়ের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কে জিতবেন, তা ঠিক করবেন ভোটাররা। তবে কুমিল্লায় মেয়র কে হবেন, তারচেয়ে বড় কথা হলো, নির্বাচন কমিশন জিতবে তো?
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের জন্য কুমিল্লা সিটি করপোরেশন একটি অগ্নিপরীক্ষা। দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক কথা, অনেক বৈঠক করলেও তাদের প্রথম মাঠের পরীক্ষা এটি। ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ কথাটি তাদের ক্ষেত্রে বেশি করে প্রযোজ্য হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয়-আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা অর্জন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে এই পরীক্ষায় পাস করতেই হবে।
কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন আগের নির্বাচন কমিশনেরও প্রথম পরীক্ষা ছিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। সে পরীক্ষায় তারা দারুণভাবে পাসও করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের দায় নিয়েই তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন পরে কী করবে জানি না, প্রথম অগ্নিপরীক্ষার শুরুটা তারা ভালোই করেছিল। অন্তত মুখের কথায় তারা বেশ এগিয়েছিল। কিন্তু কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের কাছে বড় ধাক্কা খেয়েছে কমিশনের সব হম্বিতম্বি।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে নির্বাচন কমিশন বাহাউদ্দিন বাহারকে নির্বাচনী এলাকা ছাড়ার অনুরোধ করেছিল। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের অনুরোধ আসলে আদেশ হিসেবেই গণ্য হয়। কিন্তু বাহাউদ্দিন বাহার নির্বাচন কমিশনের অনুরোধ বা আদেশ কোনোটারই তোয়াক্কা করেননি। তিনি বহাল তবিয়তেই নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যকে নির্বাচনী এলাকা ছাড়াতে না পারায় নির্বাচন কমিশনকে অসহায় মনে হচ্ছে।
বাহাউদ্দিন বাহারের এলাকা না ছাড়া নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা কি না, এ প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বাহাউদ্দিন বাহারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত আপনি (বাহাউদ্দিন)। এই ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতা হয়ে আপনি নিজেই ব্যর্থ হলেন।’ একই প্রশ্নের জবাবে আরেক নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, ‘উনি (বাহাউদ্দিন) আইন মানেন না, আইনপ্রণেতা। আপনারা আমাদের ব্যর্থ বলেন কেন? একজন সম্মানিত লোককে টেনেহিঁচড়ে নামানো কমিশনের কাজ নয়।’
বাহাউদ্দিন বাহার এলাকা না ছাড়ায় নির্বাচন কমিশনের ইজ্জত গেছে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে রাশেদা সুলতানা বলেছেন, ‘যিনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেন, তার ইজ্জত কী? উনি চলে গেলে ভালো করতেন।’ কমিশনাররা যাই বলুন, এ ঘটনায় কমিশনকে অসহায় মনে হয়েছে। যে নির্দেশ আপনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না, তেমন নির্দেশ দিতে গেলেন কেন। একজন স্থানীয় এমপির কাছেই যদি নির্বাচন কমিশন এতটা অসহায় থাকে, তাহলে জাতীয় নির্বাচনে বাঘা বাঘা মন্ত্রী-এমপিদের কমিশন কীভাবে সামলাবে?
সবার জন্য সমতল মাঠ নিশ্চিত করা এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে আচরণবিধি মানানো কমিশনের প্রাথমিক দায়িত্ব। সেটাই যদি না পারেন, তাহলে আর মুখে বড় বড় কথা বলে লাভ কী। বাহাউদ্দিন বাহারকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে না পারলেও নির্বাচন স্থগিত করে দেওয়ার ক্ষমতা তো কমিশনের হাতে ছিল। কিন্তু কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে এই ক্ষমতা তারা প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
নির্বাচনী পরীক্ষা শুরুর আগেই স্থানীয় এমপির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ নির্বাচন কমিশনকে হাস্যকর করে তুলেছে। তারপরও নির্বাচন কমিশন ‘একটি সুন্দর নির্বাচন’ উপহার দেওয়ার চেষ্টা করছে। আইনশৃঙ্খলার সব প্রস্তুতি তো নেওয়া হয়েছেই, প্রথমবারের মতো কেন্দ্রে কেন্দ্রে সিসিটিভি লাগানো হয়েছে। ইভিএম’এর মাধ্যমে ভোটগ্রহণের জন্য প্রস্তুত কমিশন।
এক বাহাউদ্দিন বাহার নির্বাচন কমিশনকে এক ঝটকায় ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে দিয়েছেন। নির্বাচনের মাঠে তাই প্রার্থীদের চেয়ে বেশি আলোচনা বাহাউদ্দিন বাহারকে ঘিরেই। মেয়র প্রার্থী পাঁচজন হলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ মনোনীত আরফানুল হক রিফাত এবং দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনের মাঠে নেমে আজীবনের জন্য বহিষ্কার হওয়া বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কুর মধ্যেই।
কুমিল্লার মাঠের রাজনীতির হিসাবটা বড্ড জটিল। জাতীয় নির্বাচনের ফলের হিসাবে কুমিল্লা শহরের আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবেই বিবেচিত হওয়ার কথা। ১৯৭৩ সালের পর আওয়ামী লীগ এই আসনটি পুনরুদ্ধার করেছে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাহাউদ্দিন বাহারের হাত ধরে। তারপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনেও বাহাউদ্দিন বাহার জয় ধরে রেখেছেন। ’৭৩ থেকে ২০০৮ এর মাঝের নির্বাচনগুলোতে দুবার জাতীয় পার্টি এবং বাকি সবকটি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয় পেয়েছেন। কিন্তু তারপরও মাঠের বাস্তবতায় কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবেই বিবেচিত হতে পারতো। হতে পারেনি আওয়ামী লীগের দুই হেভিওয়েট নেতা আফজল খান আর বাহাউদ্দিন বাহারের চিরকালীন দ্বন্দ্বের কারণে।
একসময় কুমিল্লায় বিএনপির মূল নেতা ছিলেন আকবর হোসেন। তিনি মজা করে বলতেন, আমার দুই কর্মী বাহার আর আফজল যতদিন আছে; আমার জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। পারেওনি। আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বের সুবাদে বারবার জয় পেয়েছেন আকবর হোসেন। সেই একই সমীকরণে সিটি করপোরেশনে বারবার জয় পেয়েছেন আকবর হোসেনের মামাতো ভাই মনিরুল হক সাক্কু। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রথম দুটি নির্বাচনেই মেয়র হয়েছেন মনিরুল হক সাক্কু। এর আগে পৌরসভারও শেষ মেয়র ছিলেন সাক্কু। সে হিসেবে কুমিল্লা সিটিতে সাক্কুর তৃতীয় মেয়াদ চলছে।
এক যুগ ধরে বাংলাদেশে যখন নৌকার অপ্রতিরোধ্য জয়জয়কার, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মানেই নিশ্চিত জয়; তখনও কুমিল্লায় ছিল উল্টোচিত্র। ২০১২ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন আফজল খান।
২০১৭ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন তার কন্যা আনজুম সুলতানা সীমা। কিন্তু দুবারই স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারের আনুকূল্য পান বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু। গত এক যুগ কুমিল্লা শহরের সংসদীয় আসন আওয়ামী লীগের হলেও সিটি করপোরেশন ছিল বিএনপির দখলে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আর বিএনপির মেয়র মিলেমিশেই কাজ করছিলেন।
বিএনপি নেতা হলেও সাক্কু বিনা হয়রানিতে দায়িত্ব পালন করেছেন। কুমিল্লায় এতদিন বিএনপি নেতা সাক্কু বাহারের লোক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তবে এবার চিত্র পাল্টে গেছে। দুবার আফজল খান ও তার কন্যাকে মনোনয়ন দিয়ে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ এবার বাহার শিবিরের লোক আরফানুল হক রিফাতকে মনোনয়ন দিয়েছে। শুরুতে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন, রিফাত নির্বাচন করলে হয়তো সাক্কু মাঠে থাকবেন না। কিন্তু যিনি নিজের দলের সিদ্ধান্তই মানেননি, তিনি অন্য দলের সমীকরণ বিবেচনায় নেবেন কেন।
বিএনপি থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কৃত মনিরুল হক সাক্কু প্রবলভাবেই আছেন নির্বাচনের মাঠে। মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রিফাত আর সাক্কুর মধ্যে হলেও মূল লড়াই কিন্তু সাক্কুর সাথে বাহারের। আরফানুল হক রিফাত হেরে গেলে সেটা তার চেয়ে বেশি বাহাউদ্দিন বাহারের পরাজয় হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই বাহাউদ্দিন বাহার নিজের স্বার্থেই তার দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত সঙ্গী রিফাতকে পাশ করাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। সেজন্য তিনি নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞারও তোয়াক্কা করছেন না।
এতদিন সুসম্পর্ক থাকলেও এখন বাহার এবং রিফাত সাক্কুর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছেন। সাক্কুও তার জবাব দিচ্ছেন। এই পাল্টাপাল্টিতে সাক্কু একটা সত্যি কথা বলে দিয়েছেন, সীমা মনোনয়ন পেলে তো রিফাত আমার পেছনে থাকতো। এটাই কুমিল্লার বাস্তবতা। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোট ১৪ জন মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু রিফাত মনোনয়ন পাওয়ার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনেক চেষ্টা করেও মনোনয়নবঞ্চিত ১৩ জনকে মাঠে নামাতে পারেননি। রিফাতও তাদের কাছে আনার চেষ্টা করেননি। মুখে যাই বলুন, মনোনয়নবঞ্চিত ১৩ জনই রিফাতের পরাজয় চাইবেন।
সাক্কু এবং রিফাত দুজনেরই এন্টি ইনকামবেন্সি সমস্যা রয়েছে। সাক্কু টানা তিন দফায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা শাসন করছেন। টানা ক্ষমতায় থাকলে অজনপ্রিয় হওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা সাক্কুকে বিপাকে ফেলতে পারে। বিরোধী দলের মেয়র হলে উন্নয়নকাজ হবে না, এই ধারণাও তার বিপক্ষে যাবে। আগের দুবার ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের আশীর্বাদ পেলেও এবার তা তো পাচ্ছেনই না, উল্টো তিনিই তার মূল প্রতিপক্ষ।
আরফানুল হক রিফাতের ব্যক্তিগত কোনো এন্টি ইনকামবেন্সি সমস্যা না থাকলেও আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় ক্ষমতায় থাকার বিরুদ্ধে যাওয়া জনমত স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিফাতের বিপক্ষে যাবে। দলের মনোয়নের সুবিধা যেমন তিনি পাবেন, দলের অপকর্মের দায়ও তাকে নিতে হবে। ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত আরফানুল হক রিফাত। ১৯৮২ সালে প্রতিকূল সময়ে ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সফিক-জাহাঙ্গীর পরিষদে বহিঃক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হওয়া রিফাত ছাত্রশিবিরের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে দলের জন্য ত্যাগও স্বীকার করেছেন। তবে আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় দফা ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগও আছে মাঠে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের করা তালিকায় কুমিল্লার শীর্ষ মাদক কারবারি হিসেবে নাম থাকার খবর ভোটের মাঠে শুরুতেই তাকে বিপাকে ফেলেছিল। এখন অবশ্য সে বদনাম অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন।
এখন অপেক্ষা সাক্কু আবারও জয় পাবেন নাকি আফজল খান পরিবার থেকে মনোনয়ন ছিনিয়ে আনা রিফাতের জয়ে কুমিল্লায় আরও একচ্ছত্র হবে বাহাউদ্দিন বাহারের আধিপত্য, তা দেখার। তবে আমার কৌতূহল নির্বাচন কমিশনের পারফরম্যান্স নিয়ে। জাতীয় রাজনীতিতে বাহার, রিফাত বা সাক্কু তেমন বড় ফ্যাক্টর নন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাদের প্রথম পরীক্ষায় পাস করতে পারে কি না, সেটা দেখার জন্যই বসে আছেন সবাই।
১৪ জুন, ২০২২
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/এমএস/ফারুক