কমছে শুধু মানুষের মূল্য

জব্বার হোসেন
জব্বার হোসেন জব্বার হোসেন , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৫৮ এএম, ০২ জুন ২০২২

লাভ আর লসের হিসাবে খুব সহজ। এই হিসাব বুঝবার জন্য বিবিএ, এমবিএ, এমফিল, পিএইচডি, পোস্টডক্টরেট কিছুই প্রয়োজন নেই। লাভ হবে তখনই যখন কারো না কারো লস হবে। আর লস তখনই হবে যখন কেউ না কেউ লাভ করবে। দুটো পাল্লা কখনো সমান অবস্থায় থাকতে পারে না। দিন শেষে ভরের হিসেব। একটি উঠবে তো অন্যটি নামবে, একটি নামবে তো অন্যটি উঠবে। পদার্থবিদ্যার সূত্র। হিসেবের সূত্রও তাই। পুঁজির হিসেব খুব ভয়ঙ্কর। পুঁজির কাছে ব্যক্তি আর বস্তুও কোন পার্থক্য নেই। পুঁজি দেখে শুধু মুনাফা, বিক্রয়মূল্য।

সমাজে ব্যক্তির চেয়ে বস্তুর গুরুত্ব বাড়ছে। মূল্য বাড়ছে। পাবার আকাঙ্কা, হাহাকারও বাড়ছে। বাড়ছে লকলকে জিহ্বা। মানুষের চেয়ে তার চেয়ার বড়। লোকটির চেয়ে তার কয়েকগুণ বড় গাড়ি প্রয়োজন। ডুপ্লেক্স, ট্রিপ্লেক্স প্রয়োজন।

এখন প্রেম করতেও দামী ফোনসেট লাগে। ট্রিট লাগে, ট্রিপ লাগে লাক্সারি রিসোর্টে। সুপারশপ ছাড়া বাজার হয় না। প্রয়োজন একটা, কিনে দশটা। শপিংসেন্টার, মলে দৌড়াও। তা না হলে মন ভরে না। মানুষ হয়ে উঠছে শপাহলিক। একে মন ভরছে না, দশ লাগছে। অর্গাজম হচ্ছে না, আরও পুরুষ প্রয়োজন। বয়ফ্রেন্ড একটা নয়, আরো আরো আরো চাই। পুরুষদেরও তাই। স্ত্রী তো আছেনই, কিন্তু গার্লফ্রেন্ড চাই। একজন নয়, অবশ্যই একাধিক। অনেক সিম, অনেক সম্পর্ক। নারী-পুরুষ প্রায় সবারই।

ব্র্যান্ড ছাড়া ব্যক্তি মূল্য বোঝাবে কী করে তার? চড়তে হবে অডি, মার্সিডিজ, পরতে হবে গুচি, ভারসাজি, হাতে রাডো বা রয়েল ক্রাউন। অন্তর্বাসও হওয়া চাই মিনিমাম ক্যালভিন ক্লাইন। হাতে ল্যাটেস্ট আই ফোন ফরটিন। তা না হলে ব্যক্তি বড়ই মূল্যহীন অসহায়। পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু ডলার, সোনা, তেল, গ্যাস। বাজার, রাজনীতি। ভাল লাগা মন্দ লাগা। এমনকি যৌনতাও। যেখানে মুনাফার লাভ বেশি, সেখানেই তার হাত। পুঁজির হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না মানুষের গোপনাঙ্গও। এমনকি রতিপ্রক্রিয়ার সময়ও নিয়ন্ত্রণ করছে পুঁজি। ভায়াগ্রা খাও। ইডিগ্রা খাও। নিডিগ্রা খাও।

ব্যক্তি হয়ে যাচ্ছে বস্তুর চেয়ে ছোট। ক্ষুদ্র থেকে আরও ক্ষুদ্র। পুঁজি তাকে আরও ভোগবাদি করে তুলেছে। পাশের বাড়ির মেয়েটির সঙ্গে এখন আর প্রেম করলে হয় না। এখন মডেল, নায়িকা দরকার হয়। তারাও ওয়ার্কপারমিট নিয়ে বিনোদন করতে এদেশে-সেদেশে যায়। বড় পদের পুরুষেরা আর টাকাওয়ালারা কেউ কেউ হানি ট্র্যাপ হয়। ভিডিও হলেই বা কী? এখানেও টাকার খেলা। রাজনীতি। এই রাজনীতির পুরোটাই পুঁজি আর ক্ষমতার।

ক্ষমতা ধরে রাখতে হবে যে কোন মূল্যে। পুঁজিই তার মূল কারণ। তা না হলে এত অনিয়ম, এত দুর্নীতি, এত লুটপাট হচ্ছে কী করে ‘আদর্শ’ বলে যদি কিছু থাকে। আদর্শ এমন মিউজিয়ামের বিষয়। আদর্শ নামে দারুণ এক মিউজিয়াম হতে পারে এ দেশে। হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট। বড় বড় কর্মকর্তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে যাবেন টিম নিয়ে, অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, মিউজিয়াম দেখবেন। হতে পারে, আশ্চর্য নয় এদেশে। অন্তত অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে।

পুঁজির কাছে সব পণ্য, সকলই দ্রব্য-সামগ্রী। তাই মানুষের শ্রমমূল্য যত কমবে লাভ হবে ততবেশি। মুনাফাভোগীদের অঙ্ক বাড়বে মানুষের শ্রমমূল্য যত নামবে হিমাঙ্কের নিচে। মানবিকতা যত হারাবে, ততই উৎকট উন্নতি সহজ হবে। সহজ হবে উন্নতি বোঝাতে। বড় বড় স্থাপনা দেখে মানুষ মনে করবে উন্নতি। কিন্তু অগ্রগতি শূন্য, মানবিকতা শূন্য এই উন্নতি কারো কাজে লাগবে না, কেবল পুঁজি আর ভোগবাদিতা ছাড়া।

মানবিক মানুষ যদি সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে না পারে তবে এই ব্যর্থতা আত্মঘাতি। মূল্যবোধহীন মানুষের চেয়ে সস্তা, মূল্যহীন আর কিছু নেই। তখন সকল চেতনার বাণীই অর্থহীনতায় ভুগবে। প্রকৃত মানুষ তৈরি না হলে ‘এই চেতনাই’ বা ধারণ করবে কে? মূক ও বধির?

লেখক: সম্পাদক, আজসারাবেলা,সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/এএসএম

ব্যক্তি হয়ে যাচ্ছে বস্তুর চেয়ে ছোট। ক্ষুদ্র থেকে আরও ক্ষুদ্র। পুঁজি তাকে আরও ভোগবাদি করে তুলেছে। পাশের বাড়ির মেয়েটির সঙ্গে এখন আর প্রেম করলে হয় না। এখন মডেল, নায়িকা দরকার হয়। তারাও ওয়ার্কপারমিট নিয়ে বিনোদন করতে এদেশে-সেদেশে যায়। বড় পদের পুরুষেরা আর টাকাওয়ালারা কেউ কেউ হানি ট্র্যাপ হয়। ভিডিও হলেই বা কী? এখানেও টাকার খেলা

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।