পদ্মা সেতু : সক্ষমতা এবং সাহসের প্রতীক

ড. হারুন রশীদ
ড. হারুন রশীদ ড. হারুন রশীদ , ডেপুটি এডিটর (জাগো নিউজ)
প্রকাশিত: ০৯:৩৭ এএম, ০১ জুন ২০২২

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্পই নয়, অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও দৃঢ় সংকল্প নেতৃত্বের সাহসের প্রতীক যেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৫ জুন দেশের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন। সত্যি বলতে কি ২৫ জুন সেতু উদ্বোধনের পর বাংলাদেশ প্রবেশ করবে অন্য এক অধ্যায়ে। যেখানে পদ্মার উচ্ছ্বাসে কেঁপে উঠবে দেশ।

কবি সুকান্তের ভাষায়-
হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
সে কোলাহলে রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ
জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।

সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়ঃ
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।

সত্যি মাথা নোয়ায়নি বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এতে দেশে এক অভূতপূর্ব জনজাগরণের সৃষ্টি হয়। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এক অভিনব দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটে। সবাই ‘যার হাতে যা আছে’ তাই নিয়ে পদ্মা সেতুর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

অন্যদিকে মালয়েশিয়াসহ অনেক দাতা গোষ্ঠীও এগিয়ে আসে। সরকার সব পথই খোলা রাখে। এমনকি বিশ্বব্যাংক যেসব কারণ দেখিয়ে ঋণ চুক্তি বাতিল করে সেগুলোও প্রতিকারের চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন গলেনি বিশ্বব্যাংকের। অবশেষে এতদিন পর কানাডার আদালতের রায়ে সবকিছু মিথ্যা ও গালগল্প হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায় চুক্তি বাতিলের বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তটি যে ভুল ছিল সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

অনেক জল ঘোলা করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হয়েছে। পদ্মা সেতুতে ‘মানুষের মাথা লাগবে’ বলে গুজবের ডালপালাও গজিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো বাধাই স্বপ্নকে আটকে রাখতে পারেনি। মানুষ আসলে তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। পদ্মা সেতু যেন এই সত্যটিকে আরও বেশি করে উদ্ভাসিত করছে। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু (ডাঙার অংশ ধরলে পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটার) এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এরই মধ্যে পদ্মা সেতুর নাম ‘পদ্মা সেতু’ নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানো হয়। প্রথম স্প্যান থেকে শুরু করে ৩৯তম স্প্যান বসানো পর্যন্ত সময় লেগেছে তিন বছরের ওপর। পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হয় পদ্মা সেতুর কাঠামো। সেতুর উপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন।

সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করেছিল। একই পথ অনুসরণ করেছিল অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও। পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্ভাব্য দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয় কানাডার একটি আদালতেও। ইতোমধ্যে সে মামলার রায়ে আদালত একে নিছকই ‘অনুমান ও গুজব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং কানাডার সেই কোম্পানির অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তাকে অব্যাহতিও দেন। দুর্নীতির অভিযোগটি কেবল কিছু ব্যক্তি, সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও। এ কারণে চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয় সরকারকে।

তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরে যেতে হয়। একজন সচিব ও একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল এবং তাদের কিছুদিন কারাবাসও করতে হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ পেতে কানাডার একটি কোম্পানি ঘুস দিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ব্যাপারে দুই দফা তদন্ত করেও অভিযোগের সত্যতা পায়নি। সরকারও পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি বা দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়নি বলে জোর দাবি জানালেও কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেনি বিশ্বব্যাংক।

এটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক বিরাট দুঃসংবাদ। সরকারও বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। কারণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন তৎকালীন মহাজোট সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। সেজন্য ক্ষমতায় এসেই পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। বিএনপি সরকারের সময় যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সেই বিশ্বব্যাংককে আবার বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ সরকার। সঙ্গত কারণেই ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে এককভাবে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার (নয় হাজার ৬০০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে মাশুল গুনতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। যদিও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে। নানামুখী অসুবিধা ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও পড়তে হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের আচরণ ছিল স্পষ্টতই অপেশাদারি। এর পেছনে দেশে বিদেশে অনেকেই কলকাঠি নেড়েছেন এমন অভিযোগও আছে। স্বপ্নের এই সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। বাংলাদেশ যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে তার প্রমাণ পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতা ও দৃঢ় সংকল্প নেতৃত্বের সাহসের প্রতীক হয়ে থাকবে এটাই আমাদের বিশ্বাস। দেশের সর্ববৃহৎ এ নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমরা প্রমাণ করেছি, আমরা পারি। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, বড় সিদ্ধান্তের বিষয়। এর সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত ছিল। এমন বৃহৎ ও খরস্রোতা একটা নদীর ওপর এত বড় সেতু নির্মাণ করে আমরা বিশ্বের সামনে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম। আমরা বাঙালি জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা যদি সৎ ও অবিচল থাকি তবে আমার যা চাই, তাই করতে পারি।’ বাংলাদেশ যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে তার প্রমাণ পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন জাগরণ নিয়ে আসবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এ সেতুটি। যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঘটবে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। মানুষের যাতায়াত থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহনে সময় বাঁচবে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে নিশ্চিত করেই। পদ্মা পাড়ের কিছু মানুষ তাদের প্রাক্তন পেশা হারালেও বৃহত্তর অর্থে কর্মসংস্থান বাড়বে। যাতায়াত সহজ ও সময় কম লাগায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর একটি সেতুবন্ধ রচিত হবে। বাড়বে বিনিয়োগ। দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পের প্রসার হবে। জিডিপিতেও বড় অবদান রাখবে পদ্মা সেতু।

আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল দেশপ্রেম। দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়েই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আপামর জনতা। ৩০ লাখ প্রাণ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন ভূখণ্ড, লাল সবুজের পতাকা আর জাতীয় সংগীত- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ দেশপ্রেম থাকলে, সত্য আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প থাকলে পদ্মা সেতুর মতো স্থাপনা সৃষ্টি করা কোনো ব্যাপার নয়। আমরা মহাকাশে বঙ্গবন্ধুর নামে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছি। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা। আমরা যেন বীর শহীদদের সর্বোচ্চ ত্যাগ ও আত্মদানের কথা কখনো ভুলে না যাই। তবেই বাংলাদেশ অবাক করা সব সাফল্য বয়ে আনবে। সাফল্যের সেই আনন্দ উচ্ছ্বাসে কাঁপবে দেশ।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন জাগরণ নিয়ে আসবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এ সেতু। যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঘটবে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। মানুষের যাতায়াত থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহনে সময় বাঁচবে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে নিশ্চিত করেই।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।