পরিবেশ রক্ষায় বন্ধ করতে হবে তামাক চাষ

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ৩১ মে ২০২২

ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার
জানেন কি বিশ্বে প্রতি বছর আট মিলিয়নেরও বেশি মানুষ তামাক গ্রহণের কারণে মারা যায়। এর মধ্যে সাত মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারা যায় সরাসরি তামাক গ্রহণের ফলে এবং প্রায় ১.২ মিলিয়ন অধূমপায়ীর করুণ মৃত্যু হয় ধূমপায়ীদের ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসার কারণে। জেনে অবাক হবেন ১.৩ বিলিয়ন তামাক ব্যবহারকারীর মধ্যে ৮০ শতাংশ এরও বেশি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের অধিবাসী [১]।

পরিবেশ বিপর্যয়ে তামাকের ভূমিকা এবং মানব স্বাস্থ্যের ওপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৩১ মে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস পালন করে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- তামাক আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি। কথাটি দ্বারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বোঝাতে চেয়েছে যে, তামাক তার জীবনচক্র জুড়ে ধরিত্রীকে দূষিত করে এবং সমগ্র মানবজাতির স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে ।[৩]

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাকের চাষ বেশি হওয়ায় সেখানে পরিস্থিতি বেশি বিপজ্জনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য প্রচারের পরিচালক ডা. রুডিগার ক্রেচ বলেছেন, ‌আপনি প্রতিবার ধূমপানে আক্ষরিক অর্থে এমন সম্পদ পুড়িয়ে দিচ্ছেন যা ইতোধ্যে দুষ্প্রাপ্য, এমন সম্পদ পুড়িয়ে দিচ্ছেন যেখানে আমাদের অস্তিত্ব নির্ভর করে'। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে তামাক চাষের জন্য ৩.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি ধ্বংস হয় [৩]।

তামাক উৎপাদনের জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বে বন উজাড় হচ্ছে। বন উজাড়ের ফলে মাটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং অন্যান্য গাছের জন্য বা ফসলের জন্য মাটি অনুর্বর হয়ে পড়ে। ফলে একদিকে যেমন বন উজাড় হয়ে পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনছে এবং অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, ক্ষরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে অন্যদিকে ফসলি জমি কমে যাওয়ায় খাদ্য শস্যের উৎপাদন হ্রাস হওয়ায় পৃথিবীতে খাদ্য সংকটের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। তামাকের পরিবেশগত প্রভাব এমন দেশগুলোর ওপর পড়ে যারা এটি মোকাবিলায় অক্ষম আর তামাক থেকে প্রাপ্ত মুনাফা নিয়ে যায় উচ্চ আয়ের দেশে অবস্থিত তামাক কোম্পানিগুলো।

উৎপাদিত তামাকের শতকরা ৯০ ভাগ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হয় [৩]। এসব দেশের অনেক কৃষক ও সরকারি কর্মকর্তারা তামাককে একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে দেখেন কারণ এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। কিন্তু তামাকের স্বল্প মেয়াদি নগদ সুবিধা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, কৃষকের ঋণগ্রস্ততা, অসুস্থতা এবং পরিবেশগত ক্ষতির দীর্ঘমেয়াদি কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তামাক যে শুধু পরিবেশ বিপর্যয়ে অবদান রাখছে তাই নয়। তামাকের স্বাস্থ্যঝুঁকিও ব্যাপক। বেশিরভাগ মানুষ জানেন তামাক গ্রহণে ক্যানসার হয় তবে আরও বেশ কিছু জটিল রোগের পেছনেও দায়ী তামাকের ব্যবহার। তামাক ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, রক্তনালী, প্রজনন অঙ্গ, মুখ, ত্বক, চোখ এবং হাড়সহ প্রতিটি অঙ্গের ক্ষতি করতে সক্ষম। ফুসফুস ক্যানসারের প্রায় ৮০ শতাংশ ধূমপানের কারণে হয়।

এছাড়া মুখ, স্বরতন্ত্র, গলা, খাদ্যনালী, কিডনি, সার্ভিক্স, যকৃত, মূত্রাশয়, অগ্নাশয়, পেট ও মলদ্বার ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া তীব্র লিউকোমিয়ার ঝুঁকিও বাড়ায় তামাকের ব্যবহার। এখন পর্যন্ত সিওপিডির প্রধান কারণ ধূমপান। সিওপিডিতে ফুসফুসের ছোট নালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে রোগীর শ্বাসকষ্ট হয়। এর কোনো নিরাময় নেই ওষুধে কিছুটা উপসম হয় মাত্র। দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কাইটিস ধূমপানের ফলে হয়। শ্বাসনালী ফুলে যায় সাথে দীর্ঘস্থায়ী কাশি থাকে। সময়ের সাথে সাথে সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করে নিউমোনিয়া হতে পারে।

আরেকটা ভয়ানক রোগ হলো এমফিসেমা। ফুসফুসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বায়ু থলির দেওয়াল ভেঙে পরিমাণে কম এবং বড় বড় থলি তৈরি হয়। ফলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। রোগীর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয়। প্রায়ই শ্বাস নিতে অক্সিজেন মাস্কের প্রয়োজন পড়ে। এটিও নিরাময় হয় না। তবে ধূমপান ছেড়ে দিলে এবং চিকিৎসা নিলে কিছুটা উপসম হয়। ধূমপান কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমের ক্ষতি করে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। করোনারি হার্র্ট ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপের কারণও ধূমপান।

পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজ (পিএডি) ধূমপানের কারণে হয়। পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজ (পিভিডি) হলে পায়ের ব্যথা এবং ঘা হয়, যা নিরাময় অযোগ্য রোগ আর এটিরও কারণ ধূমপান। তামাক ব্যবহার নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফলে অকাল জন্ম, কম ওজনের শিশু, মৃত শিশু প্রসব, ঠোঁট ফাটা- তালু ফাটা এবং অন্যান্য জন্মগত ত্রুটিসহ বাচ্চা জন্মাতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এরক্টাইল ডিসফাংশনের ঝুঁকি বেশি থাকে। সেই সাথে উর্বরতাও কমতে পারে [৪]।

বাংলাদেশে তামাকের বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৪৬.০ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ এবং ২৫ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক নারী তামাক ব্যবহার করেন। তার মধ্যে সিগারেট সেবন করেন ২৮.৭ শতাংশ পুরুষ এবং ০.২ শতাংশ নারী, ৯.৭ শতাংশ পুরুষ ও ০.৬ শতাংশ নারী বিড়ি সেবন করেন, ১৬.২ শতাংশ পুরুষ ও ২.৮ শতাংশ নারী আসক্ত ধোঁয়াহীন তামাকে। ১৪.৩ শতাংশ পুরুষ ও ২৩.০ শতাংশ নারী পানের সাথে তামাক খান এবং ৩.১ শতাংশ পুরুষ ও ৪.১ শতাংশ নারী ব্যবহার করেন গুল [৫]।

২০১৮ সালে তামাকজনিত রোগের কারণে বাংলাদেশে প্রায় ১২৬,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়, যা ছিল মোট মৃত্যুর১৩.৫ শতাংশ। প্রায় ১.৫ মিলিয়ন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ তামাকের প্রভাবে সরাসরি অক্রান্ত হয়েছিল এবং প্রায় ৬১০০০ শিশু পরোক্ষ অক্রমণের শিকার হয়েছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ দেশে ৩০৫.৬ বিলিয়ন টাকা খরচ হয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর ১২তম তামাক উৎপাদনকারী দেশ। গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৭-২০০৮ সালে তামাক চাষের জন্য মোট ৭২০০০ একর জমি ব্যবহার করা হলেও ২০১৪-২০১৫ সাল নাগাদ তা ১২৭,০০০ একরে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাত বছরে মোট ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে [৬]।

শুধু স্বাস্থ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত বলে নয় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য তামাক সেবন হ্রাস করাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তামাকজাত দ্রব্যের বর্জ্যের পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির জন্য উৎপাদককে দায়ী করার বিদ্যমান স্কিমগুলো বাস্তবায়ন ও শক্তিশালী করাসহ আইন প্রণয়ন বাড়ানো উচিত।

কৃষককে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করে এমন কোনো ফসল চাষে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে সে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। যে কৃষক তামাক চাষ ছেড়ে অন্য ফসল আবাদ করবে তাকে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রণোদনা দানের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ফসলের বাজারজাতকরণের ব্যাপারে সহয়তা প্রদান করলে কৃষক উৎসাহ পাবে। তামাকদ্রব্য প্রস্তুতকারী ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চ করের আওতায় আনতে হবে সেই সাথে নতুন লাইসেন্স প্রদান বন্ধ করে দিতে হবে।

মাদকসেবীদের যেমন নেশাগ্রস্ত হিসেবে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়, ধূমপায়ী এবং তামাক ও গুল গ্রহণকারীদেরও তেমনি নেশাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যানের ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সাথে উন্মুক্ত স্থানে ধূমপায়ীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে- এভাবেই তামাকের হাত থেকে মুক্তির সম্ভাব্য উপায় বাতলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তামাকের মাঠগুলো ভরে উঠবে সবুজ ফসলে। আর একটি শিশুও নিকোটিনের প্রভাবে অসুস্থ হবে না- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সিইও, এমিনেন্স এসোসিয়েট ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট।
Reference: 1. Tobacco. [cited 25 May 2022]. Available: https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/tobacco
2. World No Tobacco Day | UICC. [cited 24 May 2022]. Available: https://www.uicc.org/what-we-do/thematic-areas-work/tobacco-control/world-no-tobacco-day
3. Protect the environment, World No Tobacco Day 2022 will give you one more reason to quit. [cited 24 May 2022]. Available: https://www.who.int/news/item/13-12-2021-protect-the-environment-world-no-tobacco-day-2022-will-give-you-one-more-reason-to-quit
4. Health Risks of Smoking Tobacco. [cited 24 May 2022]. Available: https://www.cancer.org/healthy/stay-away-from-tobacco/health-risks-of-tobacco/health-risks-of-smoking-tobacco.html
5. Bangladesh Bureau of Statistica. Preliminary Report on GATS Bangladesh 2017. Available: http://bbs.portal.gov.bd/sites/default/files/files/bbs.portal.gov.bd/page/57def76a_aa3c_46e3_9f80_53732eb94a83/Preliminary%20Report%20on%20GATS%20Bangladesh%202017.pdf
6. International Journal of Environmental Research and Public Health. The Economic Cost of Tobacco Farming in Bangladesh. 2020.

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

মাদকসেবীদের যেমন নেশাগ্রস্ত হিসেবে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়, ধূমপায়ী এবং তামাক ও গুল গ্রহণকারীদেরও তেমনি নেশাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যানের ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সাথে উন্মুক্ত স্থানে ধূমপায়ীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে- এভাবেই তামাকের হাত থেকে মুক্তির সম্ভাব্য উপায় বাতলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তামাকের মাঠগুলো ভরে উঠবে সবুজ ফসলে। আর একটি শিশুও নিকোটিনের প্রভাবে অসুস্থ হবে না- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।