পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয়ের ফসল
আজ থেকে কয়েক বছর আগে পদ্মা সেতুর কার্যক্রম শুরু হওয়ার ঠিক প্রাক্কালে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে সেই সময় বিশ্বব্যাংক তাদের সিদ্ধান্তের পক্ষে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে মর্মে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সেতুর কার্যক্রম যখন শুরুই হয়নি এবং কোনো অর্থই খরচ হয়নি সে অবস্থায় দুর্নীতি কীভাবে হতে পারে সেই বিষয়টি সবার বোধগম্য ছিল না। পত্রিকান্তরে যা জানা গিয়েছিল তাহলো বিশ্বব্যাংকের হাতে একটি ডায়েরির পাতা ছিল যে পাতাটি তারা সরকারের কাছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে এ বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল।
একই সাথে সেই সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়টিতে ব্যবস্থা গ্রহণের চাপ দিয়েছিল, যা সেই সময় পত্রিকার মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। এমনকি সেই বিষয়টি সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলার চেষ্টা করা হয়েছিল সেই সময়। বিশ্বব্যাংকের ধারণা ছিল এ ধরনের একটি অনৈতিক চাপ সরকারের ওপর প্রয়োগ করা হলে সরকার তাদের সব শর্ত মেনে নিয়ে তাদের কথা মতো কাজ করবে।
সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- খুব দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি কোনো কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগের স্বীকৃতি প্রদান করেননি। তিনি বিশ্বব্যাংককে বারবার আহ্বান জানিয়েছিলেন তাদের অভিযোগের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করার জন্য। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি সেই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন যদি বিশ্বব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের সেই কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ পরে আদালতের মাধ্যমে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়।
সে অবস্থায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জনগণ আশা করেনি যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দেশে পদ্মা সেতু তৈরি হতে পারে। এ বিষয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা একদিকে যেমন বিশ্বব্যাংকের কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগে নিজেদের পক্ষে নিয়ে এসে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, তেমনিভাবে অনেকেই হাঁসি-ঠাট্টার মাধ্যমে সরকারকে খাটো করার চেষ্টা করেছিল এই বলে যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে কখনোই পদ্মা সেতু তৈরি হবে না।
সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে শুধু একজন ব্যক্তি অত্যন্ত দৃঢ়তার দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে, বাংলাদেশ সরকার অবশ্যই পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে এবং সেটি হবে নিজস্ব অর্থায়নে। পদ্মা সেতুর মতো একটি মেগা প্রকল্প বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরির সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল।
আমাদের দেশের অর্থনীতি গত প্রায় সাড়ে ১৩ বছরে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু এত বড় একটি মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল একথাও ঠিক। এ বিষয়টি অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয় সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে।
সরকার পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে এবং পদ্মা সেতুর কাজ সমাপ্তির পথে। একসময় যারা পদ্মা সেতু নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতো তাদের সামনে আজ পদ্মা সেতু একেবারেই দৃশ্যমান একটি স্থাপনা। সরকার ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হবে, যার অর্থ হলো সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের একটি বাস্তবতা।
পদ্মা সেতু নিয়ে ইতোমধ্যে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। খরস্রোতা পদ্মার বুকে এই সেতু দেশের অর্থনীতিতে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় কী ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা বিভিন্ন লেখনির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মূল বিষয়টি হচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগের একটি নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হতে চলেছে পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে।
আমরা জানি যে, দক্ষিণবঙ্গ থেকে লবণাক্ত পানির মাছ বাংলাদেশসহ দেশের বাইরে পাঠানো হয়। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মাছ চাষিদের জন্য মাছ পরিবহন ব্যয়বহুল ছিল। পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হলে এই সেতু ব্যবহার করে মাছ ও অন্যান্য পণ্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
তাছাড়া এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের সময় অনেক কমে যাবে। এমনকি পদ্মা সেতু ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্যান্য দেশের সাথে আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব থাকবে সেটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর নামকরণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং সরকারের সবাই চেয়েছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে পদ্মা সেতু নামকরণ করা হোক। কিন্তু এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবারো তাঁর মহানুভবতার প্রমাণ রেখেছেন। তিনি জাতির কাছে যে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন তা হলো তিনি কাজে বিশ্বাসী, নামে নয়।
নিজের নামে পদ্মা সেতুর নামকরণ না করে ঐতিহ্যবাহী খরস্রোতা পদ্মা নদীর নামে পদ্মা সেতু নামকরণের সিদ্ধান্ত সব স্তরে প্রশংসিত হয়েছে। এর মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুনরায় একটি বিষয় পরিষ্কার করতে পেরেছেন যে, ভোগে সুখ নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। তাঁর এ সিদ্ধান্ত থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা শিক্ষা নিতে পারেন। পদ্মা নদীর ওপর সেতু ব্যবহার করে বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগ তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে-এটি সবার প্রত্যাশা।
এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন কি খুবই সহজ বিষয় ছিল? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে ‘না’। এটি অত্যন্ত একটি সাহসী পদক্ষেপ ছিল। তবে অন্য কোনো সরকার প্রধান হলে হয়তো এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। শেখ হাসিনার পক্ষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার কারণে তিনি খুব সহজভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে একবার সাহসিকতা নিয়ে এই সেতুর কাজ শুরু করা হলে অর্থের সংকট কখনোই হবে না।
পরে সরকারের যখন নিজস্ব অর্থায়নে সেতুর কার্যক্রম শুরু হলো বড় বড় দাতা সংস্থার অনেকেই সেতুতে অর্থায়ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল। এমনকি বিশ্বব্যাংক অন্যান্য মেগা প্রকল্পে পুনরায় বিনিয়োগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে এবং অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সাথে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
বিশ্বব্যাংকের সে কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া ছিল বিশ্বব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অবশ্যই লজ্জাজনক। পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের মাধ্যমে যা জানা গেছে তা হলো বিভিন্ন অনুঘটক বিশ্বব্যাংককে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছিল সেই সময়। যদি এ ধরনের অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হয় তবে এটি কখনোই তাদের কাছে কাম্য নয়। নিজেদের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে দেশবিরোধী যেকোনো কার্যক্রম অপরাধের শামিল। যদি বিশ্বব্যাংক কোনো নির্দিষ্ট অনুঘটকের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে থাকে, তবে এটিও বিশ্বব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান জন্য দৈন্যতা।
আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলেই সবার বিশ্বাস। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ সহজ হওয়ার মাধ্যমে একদিকে যেমন অন্তর্দেশীয় সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে, ঠিক তেমনিভাবে আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে বলে সবাই প্রত্যাশা করে। যোগাযোগ এবং অর্থনীতির ওপর পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিকে ইতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করবে বলে সবার বিশ্বাস। এই সার্বিক কর্মকাণ্ড সাহসিকতার সাথে পরিচালনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া শেখ হাসিনা যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই সিদ্ধান্তের কারণে খরস্রোতা পদ্মার ওপর আজকের এই সেতু নির্মিত হয়েছে। যতদিন বাংলাদেশের মানুষ এই সেতু ব্যবহার করবে ঠিক ততদিন পর্যন্ত তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। ফলে পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার সুচিন্তিত ও দৃঢ় সিদ্ধান্তের ফসল এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার উপায় নেই।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/ফারুক /এমএস