‘পড়াশোনা শিকেয় উঠুক, মেয়েটি আমার শান্তিতে ঘুমাক’
গভীর রাতেও দু’চোখের পাতা এক করতে পারছেন না গৃহবধূ শামছুন নাহার। বিছানায় তার পাশে ঘুমাচ্ছে ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে। ঘুমের মধ্যে মেয়েটি বার কয়েক কেঁপে ওঠে। সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পড়াশোনা করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমাতে গেছে।
কারণ কয়েকদিন পরই মিডটার্ম পরীক্ষা শুরু হবে। সৃজনশীল পদ্ধতির পড়াশোনা ও লম্বা সিলেবাসের কারণে মেয়েটিকে পরীক্ষাভীতি পেয়ে বসেছে। মেয়ের দুশ্চিন্তায় মেয়ের মায়েরও তথৈবচ অবস্থা।
মহামারি করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণের কারণে গত দুই বছর একেতো চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে অধিকাংশ সময় অনলাইনে পড়াশোনায় কেটেছে। সৃজনশীল পদ্ধতির পড়াশোনা বলতে গেলে শেখাই হয়নি।
সম্প্রতি করোনার সংক্রমণ কমে আসায় স্কুল খুলেছে বটে তবে ক্লাসে পড়াশোনা বিশেষ করে সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষার্থীদের না পড়াশোনা করিয়ে ক্লাস টেস্ট ও মিডটার্ম পরীক্ষার লম্বা সিলেবাস বেঁধে দেওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা চোখে-মুখে সর্ষে ফুল দেখছে।
গৃহবধূ শামসুন্নাহারের মেয়ে রাজধানীর ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী। খুব শখ করে মেয়েকে খ্যাতনামা এ স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। ভর্তির সময় সিনিয়র অনেকেই বলেছিলেন খুব শখ করে যে মেয়েকে দিয়েছেন দিনকে দিন টের পাবেন। তখন বিশ্বাস না করলেও এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
করোনা শেষে খ্যাতনামা এ স্কুলে পড়াশোনা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সৃজনশীল পদ্ধতির পড়াশোনা না করিয়ে চাবুক মেরে ঘোড়াকে দাবড়ানোর মতো শিক্ষকরা অমুক অধ্যায় থেকে অমুক অধ্যায় পর্যন্ত সিলেবাস বেঁধে দিয়ে পরীক্ষা নেবেন- এই মর্মে নির্দেশনা দিচ্ছেন।
ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া ওই শিক্ষার্থী জানায়, অধিকাংশ বিষয়ে শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ান না। শিক্ষার্থীরা কেউ একবারের বেশি দুবার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে শিক্ষকরা কটূক্তি ও গালমন্দ করেন। পরীক্ষাভীতির কারণে শিক্ষার্থীদের স্কুলভীতি পেয়ে বসেছে।
একসময় শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়ার জন্য কান্নকাটি করলেও বর্তমানে সৃজনশীলসহ শিক্ষা পদ্ধতির জটিলতার কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে না যেতে পারলেই যেন বাঁচে। কারণ যতক্ষণ তারা ক্লাসে থাকে ততক্ষণই জটিল পড়াশোনায় ডুবে থাকতে হয় বিধায় আনন্দ নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে না। পড়াশোনার চাপে স্কুল ও বাসায় শিক্ষার্থীরা মনমরা হয়ে থাকে। অভিভাবকরা বলছেন, প্রধান প্রধান বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, সমাজ ও বিজ্ঞান ইত্যাদি) তো বটেই, ক্লাসে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের আইসিটি ও চারুকলা, সেলাই ফোঁড় এবং কারুকার্যের প্রাকটিক্যাল খাতা জমা দিতে বলা হয়।
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, স্কুলের শ্রেণিকক্ষের পাঠদানের বদলে শিক্ষা এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। স্কুলের শিক্ষকসহ স্কুলের আশপাশে একাধিক কোচিং সেন্টারে প্রাইভেট টিউশনির মহোৎসব চলছে। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা এমনকি রাত অবধি স্কুল শুরুর আগে ও পরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে একশ্রেণির অভিভাবকদের দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে চোখ রাখলেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের করুণ আর্তনাদের উত্তাপ চোখে পড়ে।
কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা কি এ সবের খোঁজ-খবর রাখেন নাকি জেনেও তথাকথিত শিক্ষাবাণিজ্যকে উৎসাহিত করেন।
প্রশ্ন জাগে বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে তখন আধুনিকায়ন তথা সৃজনশীল পদ্ধতির পড়াশোনার নামে কি প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি নাকি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো বইয়ের পাহাড়ের নিচে চাপা দিচ্ছেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ অভিভাবক সীমিত আয়ের ওপর নির্ভরশীল। দ্রব্যেমূল্যের ঊর্ধ্বতির লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার ছুটে চলায় সংসারের নিত্যদিনের খরচ জোগাতে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে পড়াশোনা করাতে গিয়ে স্কুলের বেতন-ভাতা, বাসা ও প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে পড়াশোনা করাতে গিয়ে সন্তানপ্রতি ৭-৮ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে।
অধিকাংশ অভিভাবকের কথা টাকা-পয়সা খরচ করেও যদি শিশুটিকে আনন্দ নিয়ে স্কুলে যেতে দেখতেন, হাসিখুশি ও খেলাধুলা করতে দেখতেন এবং রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখতেন তাহলে আফসোস থাকতো না। কিন্তু এত টাকা খরচ করার পরও যখন মেয়েটিকে ঘুমের মধ্যে আতঙ্কে কেঁপে উঠতে দেখেন তখন সোজাসাপ্টা বলতে ইচ্ছে হয়, পড়াশোনা শিকেয় উঠুক, মেয়েটি আমার শান্তিতে ঘুমাক।
লেখক: প্ল্যানিং এডিটর, জাগো নিউজ।
এইচআর/ফারুক/এমএস