শ্রীলঙ্কার ভূ-রাজনৈতিক হিসাবে কী ভুল ছিল?

শাকিল বিন মুশতাক
শাকিল বিন মুশতাক শাকিল বিন মুশতাক , সাংবাদিক-কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ১৯ মে ২০২২

শ্রীলঙ্কার বর্তমান দশায় চীনের ভূমিকা কি তা নিয়ে বেশ ক’দিন ধরেই আলোচনা চলছে। অপরিণামদর্শী বৈদেশিক ঋণসহায়তা গ্রহণ, প্রকল্প গ্রহণে দূরদর্শিতার অভাব এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষের মত শুনতে না চাওয়াসহ নানা কারণের সম্মিলিত ফসল হলো একদা সমৃদ্ধশালী দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রায় পতনোন্মুখ পরিস্থিতি।

মূলত তিনটি বিষয় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা আমলে নিচ্ছেন- এখন শ্রীলঙ্কার আর্থিক সমস্যায় বাংলাদেশের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া, ভারতের বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা এবং চীনের মুখে কুলুপ এঁটে রাখা। এই তিন বিষয়ের পরম্পরা জানার আগে একটু প্রেক্ষাপট ঘুরে আসা যাক।

মোটাদাগে শ্রীলঙ্কার অর্থ কষ্টের শুরু করোনা-পরবর্তী সময় থেকে। পর্যটনের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল দ্বীপরাষ্ট্রটি বড় একটি সময় এই খাতে আয় হারিয়েছে। অন্যদিকে গলার কাঁটা হতে পারে জেনেও গভীর সমুদ্রবন্দর হাম্বানটোটার নির্মাণ করা হয়েছে, প্রায় জঙ্গলের ভেতর বিমানবন্দর তৈরি করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক চমক দেখাতে গিয়ে রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর যোগফল কোনোভাবেই আর্থিক নিরাপত্তার পক্ষে যায় না।

শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলীয় হাম্বানটোটায় ১১০ কোটি ডলারের বিনিময়ে গভীর সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নের জন্য চীনের সাথে ২০১৭ সালে একটি চুক্তি করে দেশটির সরকার। চীনা সামরিক বাহিনী বন্দরটি ব্যবহার করতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে চুক্তিটি কয়েক মাস বিলম্বের পর স্বাক্ষর হয়। সরকার সে সময় নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যে শুধু বাণিজ্যিক কাজেই চীন বন্দরটি ব্যবহার করা হবে, মূলত এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে পণ্যবাহী জাহাজ চলবে এই বন্দর দিয়ে। এই চুক্তি থেকে পাওয়া অর্থ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সাহায্য করবে বলেও সেসময় জানায় কলম্বো।

চুক্তি অনুযায়ী, রাষ্ট্র মালিকানাধীন একটি চীনা কোম্পানি ৯৯ বছরের জন্য বন্দর এবং তার সংলগ্ন ১৫,০০০ একর জমি শিল্পাঞ্চল তৈরির জন্য ইজারা নেবে। এই পরিকল্পনার ফলে হাজার হাজার গ্রামবাসীকে উচ্ছেদ করতে হয়। ভারত মহাসাগরের এই হাম্বানটোটা বন্দরটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে।

নতুন সিল্ক রোড নামে পরিচিতি পাওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন এবং ইউরোপের মধ্যকার বন্দর ও রাস্তাগুলোর মধ্যে সংযোগ দেওয়া হবে। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কায় ২৬ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে দেশটির অবকাঠামো খাতে চীন কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।

এই বন্দরের কাজ শুরু হয় অবশ্য বেশ আগে। চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে ৩০৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ২০০৭ সালে শুরু হয় হাম্বানটোটা বন্দরের নির্মাণকাজ। ঋণের শর্ত হিসেবে বন্দর নির্মাণকাজ পায় চীনের আরেকটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, চায়না হারবার এবং স্বাভাবিকভাবেই চীনা নির্মাণশ্রমিক এবং প্রকৌশলীদের আধিক্য থাকে প্রকল্পজুড়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, এই শর্তের বাইরেও হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণে সহায়তার পেছনে প্রথম থেকেই চীনের সামরিক স্বার্থও কাজ করেছে।

প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে জড়িত শ্রীলঙ্কান কূটনৈতিকদের মতে, শুরু থেকেই চীনের অলিখিত শর্ত ছিল এ বন্দর ব্যবহারকারী সব জাহাজের এবং বন্দর পরিচালনার কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ করবে চীন। এই বন্দরের কাজ পাইয়ে দেওয়া রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপাকসেকে ২০১৫ এর নির্বাচনে বিজয়ী করার জন্য অকাতরে টাকা ঢালে চীন। রাজাপাকসের নির্বাচনী প্রচারণা তহবিলে চায়না হারবার কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ৭৬ লাখ ডলার জমা হয়েছে বলে জানা যায় শ্রীলঙ্কা সরকারের এক অপ্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে।

২০০৭ সালে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর ২০১০ সালে এসে তড়িঘড়ি করেই উদ্বোধন করা হয় হাম্বানটোটা বন্দর। কিন্তু শুরু থেকেই বন্দরটি জাহাজ আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। ২০১২ সালে এসে শ্রীলঙ্কা সরকার বন্দরটি সম্প্রসারণের জন্য আবার চীনের কাছে ঋণ চায়, এবার চীন ৭৫৭ মিলিয়ন ডলার দেয় উচ্চ সুদে।

চীনের এই ঋণ রাজাপাকসের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। শেষপর্যন্ত ২০১৫ সালের নির্বাচনে রাজাপাকসে পরাজিত হন। কিন্তু নতুন সরকার এসেও পড়ে বিপাকে, চীনের এই বিশাল ঋণ শোধের দায় উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের ঘাড়ে এসে পড়ে। আগের সরকারের রেখে যাওয়া ৪৪ বিলিয়ন ডলারের রাষ্ট্রীয় দেনা শোধ করতে গিয়ে আবারও চীন থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় শ্রীলঙ্কা সরকার।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে শ্রীলঙ্কার কাছে চীনের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৬ সাল থেকে শ্রীলঙ্কা সরকারের প্রতিনিধিরা চীন সরকারের সাথে আলোচনা শুরু করেন এই বিপুল দেন শোধ করার উপায় খুঁজতে, বিশেষ করে হাম্বানটোটা বন্দরের ব্যাপারে। কিন্তু এবার আলোচনায় বসে চীন সুর বদলায়, সরাসরি দাবি জানায় বন্দর নির্মাণের জন্য নেওয়া ঋণ মওকুফের বদলে চীনকে লিখে দিতে হবে বন্দরটির সিংহভাগ অংশ। দেনার দায়ে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা সরকারের এই দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তারা শুধু ঠিক করতে পেরেছিল চীনের কোন সরকারি প্রতিষ্ঠান এই বন্দরটি পাবে- চায়না হারবার নাকি চায়না মার্চেন্ট পোর্ট।

চায়না মার্চেন্ট পোর্ট শেষ পর্যন্ত বন্দর পরিচালনার কাজটি পায় এবং এবার তারা দাবি করে বন্দর সংলগ্ন আরও ১৫,০০০ একর জমি তাদের লিখে দিতে হবে, যেখানে নির্মিত হবে একটি শিল্পাঞ্চল। দাবির স্বপক্ষে তাদের যুক্তি ছিল যে, এই বন্দরের জন্য নেওয়া ১.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করার জন্য কেবল বন্দরের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট নয়। নিরূপায় শ্রীলঙ্কা সরকার দাবি মেনে নিয়ে ২০১৭ এর জুলাইতে চুক্তি স্বাক্ষর করে, চুক্তিটি কার্যকর হয় একই বছরের ডিসেম্বরে।

তবে কলম্বো এই উদ্যোগের নেতিবাচক দিকটি কখনোই অনুধাবন করেনি তা নয়। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা নৌবন্দর চীনকে ইজারা দেওয়া ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছিলেন দ্বীপদেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। ২০১৯ সালে ভারতশক্তি ডট ইন ও স্ট্র্যাটেজিক নিউজ ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরে ভারতকেই বেছে নেন প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে।

মাইথ্রিপালা সিরিসেনার সরকার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিয়েছিল। গোতাবায়া এই চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা করার কথা বলেন। তিনি এও বলেন, বিনিয়োগের জন্য ক্ষুদ্র অঙ্কের ঋণের বদলে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পোতাশ্রয় দিয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়, বরং এটা শ্রীলঙ্কার নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত ছিল। যে সময় গোতাবায়া এসব বলছিলেন ঠিক তার আগের বছরই অর্থাৎ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জিম্বাবুয়ের কেনেথ কউণ্ডা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেয় চীন। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় চীন এটি নিয়ে নেয়।

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে জানিয়েছেন, সামনে আরও ভয়াবহ দিন আসছে। বিক্রমাসিংহে বলেছেন, অবিলম্বে ৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার চাই। না হলে ওষুধসহ অত্যন্ত জরুরি জিনিসের আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে। তো এমন পরিস্থিতিতে চীনের অবস্থান কি? এশিয়ানেট নিউজের এক প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বলা হয়ছে, বেইজিং শ্রীলঙ্কাকে বেল আউট করতে এগিয়ে আসবে না বরং কলম্বো অন্য কোথাও থেকে কিছু পেলে চীন তা থেকে নিজের বকেয়া আদায়ের চেষ্টা করবে।

বেইজিংয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেছেন, চীনা পক্ষ দ্বীপরাষ্ট্রটির ঘটনাপ্রবাহ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বেইজিং দেশটিতে কর্মরত তার নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে। সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির জ্যেষ্ঠ সহকারী অধ্যাপক ড. ধনঞ্জয় ত্রিপাঠী বলেন, ‘যেহেতু শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে, তাই চীন দ্বীপরাষ্ট্রটিতে তার অর্থনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করছে। ওই খেলাপিতে চীনেরও শেয়ার রয়েছে। দেশটিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও করেছে চীন। হাম্বানটোটার মতো বন্দর লিজ নিয়েছে এবং শ্রীলঙ্কা যদি টাকা না পায় সেক্ষেত্রে চীনও তার অর্থ হারাবে।

এক্ষেত্রে বেইজিং স্মার্ট আচরণ করছে। তারা চায় শ্রীলঙ্কা যে কোনো জায়গা থেকে তহবিল পাক, যাতে তারা তাদের অংশ বুঝে নিতে পারে। কথা হচ্ছিল যে, চীন হয়তো আড়াই বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে। এটা নিশ্চিত, যে কোনো কঠোর শর্ত ছাড়া সেটা পাওয়া যাবে না।’ অন্যদিকে মোট ৪ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল পাঠিয়েছে ভারত। ভারত ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য করেছে।

বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ উভয়ই শ্রীলঙ্কাকে উপহার হিসেবে মোট ২০ কোটি টাকার ওষুধ দিয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ কারেন্সি অদলবদল ব্যবস্থার মাধ্যমে ২০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা করেছে। শ্রীলঙ্কার সুবিধার্তে এ সহায়তা ফেরত দেওয়ার সময়সীমাও বাড়িয়েছে।

তুলণামূলক এসব চিত্রে চীনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাচ্ছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ‘শিক্ষিত’ দেশ শ্রীলঙ্কা তার ভূ-রাজনৈতিক পদক্ষেপে ভুল করেছিল কি না সেটি এখন বেশি করেই উচ্চারিত হচ্ছে। হয়তো দিল্লি-বেইজিং প্রক্সি লড়াইয়ে চীনের প্রতি এতটা না ঝুঁকলেই বরং কলম্বোর জন্য ভালো হতো।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

তুলণামূলক এসব চিত্রে চীনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাচ্ছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ‘শিক্ষিত’ দেশ শ্রীলঙ্কা তার ভূ-রাজনৈতিক পদক্ষেপে ভুল করেছিল কি না সেটি এখন বেশি করেই উচ্চারিত হচ্ছে। হয়তো দিল্লি-বেইজিং প্রক্সি লড়াইয়ে চীনের প্রতি এতটা না ঝুঁকলেই বরং কলম্বোর জন্য ভালো হতো

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।