এত টাকা কীভাবে পাচার করলো পি কে হালদার?
পণ্যমূল্যের হাহাকার, জেলা-উপজেলায় টনকে টন ভোজ্যতেল উদ্ধার, যখন প্রতিদিনের খবরের শিরোনাম, তখনই উঠে এলো নতুন শিরোনাম। পি কে হালদার। অতি চতুর এই অর্থ পাচারকারী ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন। বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের তথ্যের ভিত্তিতে ভারতের গোয়েন্দারা তাকে সঙ্গীসহ ধরে ফেলেছে।
ভারতে ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার, ভুয়া কোম্পানি খোলা এবং হাওয়ালায় কোটি কোটি টাকা বাংলাদেশে পাচার করা নিয়ে ভারতে মামলা হবে। ২০১৩ সালে ভারত-বাংলাদেশ বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী পি কে হালদারকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে আরও তিন থেকে ছয় মাস লাগতে পারে।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আটজন ইডি অফিসার পালা করে জেরা করছেন পি কে হালদারদের। কখনও একা, কখনও দুজনকে একসঙ্গে বসিয়ে অথবা মিলিতভাবে। কিন্তু কীভাবে ভারতে ভুয়া সব পরিচয়পত্র করিয়েছিলেন পি কে হালদার তার হদিস এখনও মেলেনি। হাজার হাজার কোটি টাকা কীভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়েছিল তারও তথ্য মেলেনি। পি কে হালদারের সঙ্গে যাদের জেরা চলছে এদের মধ্যে আছেন স্বপন মৈত্র ওরফে মিস্ত্রি, উত্তম মৈত্র ওরফে মিস্ত্রি, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার, আমানা সুলতানা ওরফে শর্মি হালদার ও প্রাণেশ হালদার। ইডির সন্দেহ ধৃত নারী পি কে হালদারের স্ত্রী সুস্মিতা সাহা হতে পারেন।
ইডি সূত্রে ভারতের গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে, জেরায় ভারত, বাংলাদেশ ও কানাডার পাসপোর্ট থাকার কথা কবুল করেছেন পি কে হালদার। এটাও জানিয়েছেন যে, ইন্টারপোলের রেড কর্নার অ্যালার্ট জারি হওয়ার এক ঘণ্টা আগে তিনি বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে আসেন। তারপর ভারতীয় পাসপোর্টের সাহায্যে কানাডা যান। ফিরে এসে শিবশঙ্কর নামের আড়ালে অশোকনগরে জাঁকিয়ে বসেন। তার আধার, ভোটার, প্যান সব কার্ড শিবশঙ্কর নামে। জেরায় পি কে হালদার নাকি কবুল করেছেন তার বাংলাদেশে বিপুল সম্পদের কথা।
এর মধ্যে সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে দুইশ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হোটেল, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিঘার পর বিঘা জমি, ময়মনসিংহে চার একর জমি, ঢাকার পূর্বাচলে ষাট বিঘা জমি, ১১তলা একটি মার্কেট প্লাজা, রাঙ্গামাটিতে তিনশো কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মিত রিসোর্ট, কয়েকটি ফ্ল্যাট যার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকে একশ কোটি টাকা থাকার কথা নাকি জেরায় জানিয়েছেন পি কে হালদার। এক ইডি আধিকারিকের কথায় জেরায় বারবার উঠে এসেছে অমিতাভ অধিকারী ও অতসী মিস্ত্রির নাম। ইডি বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনকে সবটাই জানাচ্ছে।
ভারতীয় পাসপোর্টে কানাডায় গেছেন তিনি- তার মানে সে শিবশঙ্কর নাম ব্যবহার করে কানাডা গেছেন। তাহলে তার কানাডিয়ান পাসপোর্ট তো অবশ্যই শিবশঙ্কর নামেই। বাংলাদেশ সরকারের উচিত বিষয়টি অনতিবিলম্বের কানাডা সরকারকে জানানো- নাম ও নাগরিকত্ব জালিয়াতি কানাডা পছন্দ করবে না। বলা হচ্ছে, ‘হাওয়ালার কোটি কোটি টাকা কীভাবে বাংলাদেশ গিয়েছিল তারও তথ্য মেলেনি’ অথবা ‘হাওয়ালায় কোটি কোটি টাকা বাংলাদেশে পাচার করা নিয়ে ভারতে মামলা হবে’ - এর মানে কি? সে তো হাজার হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করেছে হুন্ডির (হাওয়ালা) মাধ্যমে - ভারত থেকে বাংলাদেশে কোনো টাকা পাচার করেনি। তাহলে উল্টো কথা কেন বলা হচ্ছে?
পশ্চিমবঙ্গে পি কে হালদারের ২৪টি বহুতল ভবনের কথা ভারতের মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। কানাডায় রযেছে বিপুল সম্পদ। ভারতে গোয়েন্দাদের জেরার মুখে বাংলাদেশে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের কথা স্বীকার করেছে। সব মিলিয়ে সে মোট কত টাকা চুরি করেছে। আর কতো টাকা বিদেশে পাচার করেছে? এটা এখন বড় প্রশ্ন।
পি কে হালদার ভারতেও ভাই প্রীতিশ হালদারকে সঙ্গে নিয়ে ভুয়া কোম্পানি গড়ে তুলেছিলেন। প্রশান্ত ওরফে পি কে ছাড়াও ইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছেন সুকুমার মৃধা, তার মেয়ে অনিন্দিতা, দুই ভাগনে স্বপন ও তপন মৈত্র এবং মৃধার জামাইও। এই সুকুমার মৃধাই নাটেরগুরু। পি কে হালদারের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠানো, সম্পত্তি দেখাশোনা, মাছের ঘেরের ব্যবসা সব দেখতেন এই সুকুমার মৃধা এবং তার মেয়ে জামাই, ভাগনেরা। কান টানলে মাথা আসার মতো মৃধা পরিবারকে জেরা এবং গ্রেফতারের পরই পি কে হালদারের হদিস মেলে।
ভারতের গণমাধ্যমে সাংবাদিকরা তাদের বিবরণে লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগরের ১৫ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ড সংলগ্ন বিল্ডিং মোড়। এখানে প্রাসাদোপম বাংলো দেখলে চোখ কপালে ওঠে। অশোকনগরে এইরকম চার চারটি বাংলো। বিঘার পর বিঘা জমি, মাছের বেড়ি। এসবই পি কে হালদারের। খাতা-কলমে বাংলাদেশে তার আইনজীবী, অশোকনগরে মাছ ব্যবসায়ী সুকুমার মৃধার নামে এই সম্পত্তি। আড়ালে রহস্যের মেঘনাদ এই পি কে হালদার।
বিল্ডিং মোড়ের কাছে একটি কচুরির দোকানে কচুরি ভাজতে ভাজতে ভাজতে পঞ্চানন ঘোষ বললেন, বড় বড় গাড়ি ঢুকতো বাংলোয়। ভাবিনি এত বড় প্রতারক লুকিয়ে আছে এখানে। বস্তুত, অশোকনগরে এলে কারও সঙ্গেই মেলামেশা করতেন না পি কে হালদার। আসতেন সুকুমার মৃধা কিংবা তার পরিবারের সদস্যরা। বাংলাদেশের মোস্ট ওয়ান্টেড একজন ক্রিমিনাল যে এখানে বাসা বেঁধেছেন তা বোঝেননি অশোকনগরের মানুষ। অশোকনগরে দেদারছে সম্পত্তি করা ছাড়াও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়, রাজারহাট নিউ টাউনে, দিল্লি, মুম্বাইতে প্রচুর বেআইনি সম্পত্তি করেছেন এই পি কে হালদার। সারদার সুদীপ্ত সেন কিংবা রোজ ভ্যালির গৌতম কুণ্ডু লজ্জা পাবেন পি কে হালদারকে দেখে।
ভারতের সাংবাদিকরা আরও লিখেছেন, বাংলাদেশে প্রতারণা ফাঁস হওয়ার পর কিছুদিন কানাডায় আত্মগোপন করেন। তারপর পাসপোর্ট জাল করেন কবলার মারফত। ভারতে কীভাবে তিনি আধার, ভোটার আর প্যান পেলেন সেটাই রহস্যের। অশোকনগরে চাঁদা বিলোতেন সুকুমার মৃধার মারফত দেদারছে। অশোকনগরের সংহতি পার্ক বা মিলিনিয়াম সায়েন্স পার্কে কোনো অনুষ্ঠান হলে পি কে হালদারের বকলমে সুকুমার মৃধা হয়ে যেতেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। অশোকনগরে বাংলাদেশের বিশেষ করে বরিশালের মানুষজন বেশি, তাই কি পি কে হালদার এখানেই ঝাঁকে মিশে যেতে চেয়েছিলেন? ইডি’র জেরায় নিশ্চয়ই উঠে আসবে সেই কথা।
সুকুমার মৃধা কিংবা পি কে হালদারের বাংলো বাড়িগুলো সিল করে দিয়েছে, সেখানে এখন পুলিশ প্রহরা। নিঃসন্তান পি কে হালদারের সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন সুকুমার মৃধার ভাগনে ধৃত স্বপন মৈত্র ও তপন ওরফে উত্তম মৈত্র। এদের বাড়িতেও পুলিশ পাহারা। কোনো রকমে কথা বলা সম্ভব হলো স্বপনের স্ত্রী পূর্ণিমা এবং উত্তমের স্ত্রী রচনার সঙ্গে। দুজনেই স্বীকার করলেন ডুয়েল সিটিজেনশিপ আছে তাদের। অর্থাৎ একইসঙ্গে ভারতীয় নাগরিক ও বাংলাদেশের নাগরিক তারা। রচনা-পূর্ণিমার বাড়িতে অশোকনগরে থাকলেই খেতে আসতেন পি কে হালদার। কাকু চিতল মাছের মুইঠায়া খুব ভালো খেতেন। জানালেন দুজনই।
স্বস্তির বিষয় এই আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারির নায়ক ধরা পড়েছে। বিধান রায়, তরুণকান্তি ঘোষ এ স্মৃতিধন্য অশোকনগরের মানুষ বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এতবড় একজন প্রতারক লুকিয়েছিল একদা ব্রিটিশদের এয়ারবেস এই শহরে।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস