‘পাগলের সুখ মনে মনে, দিনের বেলা তারা গোনে’
বহুল প্রচারিত একটি প্রবাদ আছে, ‘পাগলের সুখ মনে মনে, দিনের বেলা তারা গোনে।' সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি নেতাদের উল্লাস দেখে প্রবাদটি বার বার মনে পড়ছে। অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা সরকারের পতন দেখে বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা আনন্দে নৃত্য শুরু করে দিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম তো বরাবরের মত হুঙ্কার দিয়ে বলেই দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের অবস্থা শ্রীলঙ্কার চেয়ে খারাপ হবে। সেখানে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সব। আর এরা (আওয়ামী লীগ) ঝাঁপিয়ে পড়বে বঙ্গোপসাগরে।
বর্তমান সরকারের এক যুগেরও বেশি সময়ের শাসনামলে মির্জা সাহেবদের আশা বারবার হতাশায় পরিণত হয়েছে। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির পার্টি অফিস গুলোতে মিষ্টি বিতরণ হয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল পূর্ববর্তী কংগ্রেস সরকারের সাথে যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারের ভালো সম্পর্ক ছিল সেহেতু বিজেপি এসে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাদের কোলে তুলে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে। এবং খালেদা জিয়া তো নিজেই মিথ্যা অপপ্রচার রটালো তাকে নাকি বিজেপির তৎকালীন সভাপতি অমিত শাহ ফোন করে খোঁজ-খবর নিয়েছে। ঘটনাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল।
অমিত শাহের অফিস থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়। যদিও একটি দেশের ক্ষমতায় কারা থাকবেন, সেটা নির্ধারণ করেন সে দেশের জনগণ। সেনা গর্ভে জন্মে নেয়া বিএনপি সেটা বারবার ভুলে যান। আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে বিজেপি সরকারের সুমধুর সম্পর্কে দ্রুতই বিএনপির রণে ভঙ্গ হয়। আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখলের পরও বিএনপির মধ্যে চাপা উল্লাস দেখা গেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন র্যাবের কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিল, তখন তো বিএনপি নেতারা বলতে শুরু করলো আওয়ামী লীগ সরকারে পতন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আবার বর্তমানে শ্রীলঙ্কার গণবিক্ষোভ দেখে উল্লাস নৃত্য শুরু করে দিয়েছে।
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি আর বাংলাদেশের পরিস্থিতি এক নয়। শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ পর্যালোচনা করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শ্রীলঙ্কা সরকার বিগত ১৫ বছরে বিদেশি ঋণ সুবিধা নিয়ে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল ও উচ্চাভিলাষী প্রকল্প গ্রহণ করেছে যা পরবর্তীতে অলাভজনক প্রমাণিত হয়েছে।
একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে দরকার নিরবছিন্ন বিদ্যুৎ। কিন্তু প্রতিবছর ৮ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও ২০১৪ সালের পর এক মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারেনি। যার কারণে দিনের অধিকাংশ সময় জনগণকে বিদ্যুৎ বিহীন থাকতে হচ্ছে। জনগণকে খুশি করতে মূল্য সংযোগ কর (ভ্যাট) হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ এবং ২ শতাংশ ‘নেশন উন্নয়ন কর’ বিলুপ্ত করার কারণে ২৫ শতাংশ রাজস্ব আহরণ কমে গেছে। যার ফলে দেশ পরিচালনা করতে অধিক বৈদেশিক ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার বড় উৎস হলো পর্যটন শিল্প। জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ১০ শতাংশ। করোনা মহামারির কারণে এ খাতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসে। কৃষি খাতে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালুর কারণে খাদ্য উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। বেড়ে যায় খাদ্য পণ্যের দাম। আমদানি করতে হয় বিপুল সংখ্যক খাদ্য পণ্য, যার কারণে এ খাতেও ব্যাপক সংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের কখনোই শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি হবে না। কারণ অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই শ্রীলঙ্কার চেয়ে কয়েক গুণ ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার ঋণের হার জিডিপির ১১৯ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশে বৈদশিক ঋণের হার জিডিপির মাত্র ১৩ শতাংশ। আইএমএফের হিসাবে এই হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই অর্থনীতির জন্য বিপদ বলে ধরা হয়। শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬৫০ মার্কিন ডলার।
অন্যদিকে বাংলাদেশে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২৯২.১১ ডলার। শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয় ৮.৫ বিলিয়ন ডলার, সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার হলেও হাতে আছে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার ,বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪.৪৪ বিলিয়ন ডলার। যা শ্রীলঙ্কার চেয়ে এখনও ২২ গুণ বেশি।‘অর্গানিক কৃষি’ চালুর কারণে শ্রীলঙ্কায় যেখানে খাদ্য ঘাটতির পরিস্থিতি দেখা গেছে সেখানে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে রপ্তানিকারক দেশের পর্যায়ে চলে গেছে।
শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সীমাহীন দুর্নীতি, অদূরদর্শী অর্থনৈতিক সিন্ধান্ত, অপরিকল্পিত বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ও ভুল খাদ্য নীতির কারণে রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রায় শূন্য হয়ে পড়েছে। বিদ্যুতের কারণে শিল্প কারখানা বন্ধ, রাস্তাঘাট অন্ধকার। কাগজের অভাবে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল। মুদ্রার অবমূল্যায়নে ১ ডলার গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০ শ্রীলঙ্কান রুপিতে।
এমন পরিস্থিতিতে ১ টি ডিম ৩৪ টাকা, ১ কাপ চা ২৯ টাকা, ১ কেজি চাল ২৫১ টাকা,১ কেজি চিনি ২৭৪ টাকা, ১ লিটার পেট্রোল ৩৫০ টাকা গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ১ লিটার কেরোসিন কিনতে গিয়ে লাইন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে বয়স্ক ব্যক্তিদের মৃত্যুবরণের মত পরিস্থিতিও ঘটেছে। সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা হয়ে উঠে দুর্বিষহ। সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকেই তৈরি হয় গণবিক্ষোভ। যার কারণে সরকারকে পদত্যাগ করে পালাতে বাধ্য হয়েছে। বৈশ্বিক করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশেও দ্রব্যমূল্যের দাম কিছুটা বাড়লেও তা কোন মতেই জনগণের ক্রয় ক্ষমতায় বাইরে যায়নি। সরকারের কঠোর মনিটরিংয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি মেগাপ্রকল্প দেশের অর্থনীতি ও জনগণের সার্বিক উন্নতির কথা বিবেচনা করেই নেয়া হয়েছে। পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী ট্যানেল, মেট্রোরেল, ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল ও মাতারবাড়ি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দরে এলএমজি টার্মিনাল, ঢাকা বিমানবন্দর থার্ড টার্মিনাল নির্মাণসহ মেগাপ্রকল্প গুলো চালুর পর বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারাই বদলে যাবে। আগামী মাসেই পদ্মাসেতু চালু হয়ে যাচ্ছে। শুধু এই সেতু চালুর কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, গত এক দশকে (২০১০-২০২০) উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে দারুণ নজির সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল অর্থনৈতিক দেশ গুলোর একটি বলে পরিচিতি পেয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে সঠিক নেতৃত্বের কারণে।
শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও করোনাকালে নিম্নমুখী প্রবণতার শিকার হয়েছিল, কিন্তু সরকারের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার কারণে দ্রুততম সময়েই তা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যার জন্য করোনা মোকাবেলায় বিশ্বের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান গুলো থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে স্বীকৃতি।
এক শ্রেণির স্ব-ঘোষিত বিশেষজ্ঞরা শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের অপপ্রচারের জবাবে জনগণকে আশস্ত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। অনেকে বাংলাদেশের আকাশে শ্রীলঙ্কার ছায়া দেখছেন, আবার কেউ কেউ উল্লেখ করছেন দেশ শ্রীলঙ্কার পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তাদের সমালোচনার জবাবে তিনি আরো বলেন, পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে আমাদের অন্য মেগা প্রকল্পগুলো গৃহীত হয়েছে। আর শুধু ঋণ নয়, বিদেশি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে। বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি ঋণ নিচ্ছে। তবে তা যাতে বোঝা হয়ে না ওঠে সেদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। আমাদের মূল লক্ষ্য অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সম্পদ বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করা। ২০২২ এবং ২০২৩ হবে বাংলাদেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের এক মাইলফলক বছর।’
ঘর পুড়লে যারা আলু খাওয়ার ধান্ধায় আছেন, তাদের স্বপ্ন অতীতের মত দিবাস্বপ্নেই পরিণত হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে উন্নয়নের মহাসড়কে। বাংলাদেশ এখন এশিয়ার এমার্জিং টাইগার। উন্নয়নশীল দেশের স্বপ্নপূরণ করে ভিশন- ২০৪১ উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস