বোধিদ্রুমতলে মহাজাগরণ ও বৈশাখী পূর্ণিমা

জাফর ওয়াজেদ
জাফর ওয়াজেদ জাফর ওয়াজেদ
প্রকাশিত: ০১:১৫ পিএম, ১৫ মে ২০২২

‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। শত্রুহীন হোক। অহিংসিত হোক । সুখী আত্মা হয়ে কালবরণ করুক। সকল প্রাণী আপন যথালব্ধ সম্পত্তি হতে বঞ্চিত না হোক।’ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম গৌতমবুদ্ধ আড়াইহাজার বছরেরও বেশি সময় আগে এই প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যাঁকে বলেছেন, ‘সাম্যের অবতার’ সেই গৌতম বুদ্ধ প্রচলিত অর্থে দার্শনিক না হলেও দর্শন তিনি ছড়িয়েছিলেন।

বলেছিলেন, ‘যে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে না, তা নিয়ে আলোচনা অর্থহীন।’ দুঃখকে জয় করতে চেয়েছিলেন। খ্র্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৈশাখী পূর্ণিমার শুভ তিথিতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও মহাপরিনির্বাণ ঘটে। এই ত্রিস্মৃতি বিজড়িত দিবসটি বৈশাখী পূর্ণিমা হিসেবে পালন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “ওই নামে একদিন ধন্য হল দেশে দেশান্তরে / তব জন্মভূমি। / সেই নাম আরবার এ দেশের নগরে প্রান্তরে / দান করো তুমি।/ বোধিদ্রুমতলে তব সেদিনের মহাজাগরণ / আবার সার্থক হোক, মুক্ত হোক মোহ-আবরণ-”

বুদ্ধদেব যখন বুদ্ধ হননি, রাজপুত্র সিদ্ধার্থ- তখনই একদিন রাজসম্পদ, স্ত্রী-পুত্র, ভোগ-বিলাস সবকিছু ত্যাগ করে তপস্যা করতে বসেছিলেন সমস্ত মানুষের দুঃখ মোচনের সংকল্প নিয়ে। সে তপস্যার মধ্যে কোনও অধিকার ভেদ ছিল না। মূর্খ-পন্ডিত, ধনী-দরিদ্র, আর্য-অনার্য, ম্লেচ্ছ-ব্রাহ্মণ সবই সমান এবং একাকার তাঁর কাছে। বুদ্ধত্ব লাভের আগে, যখন তিনি রাজকুমার সিদ্ধার্থ, তখন একদিন তাঁর কোলে দেবদত্তের তীক্ষ্ণশরে বিদ্ধ শুভ্রহংস এসে পড়লো। দেবদত্ত সেই হংস ফেরত চাইবার সময় সিদ্ধার্থ বলেছিলেন যে, আশ্রিত এবং আহত ওই হংসের বদলে তিনি গোটা শাক্যরাজ্যই দিয়ে দিতে পারেন। একদিন সবকিছু ত্যাগ করে সেই সিদ্ধার্থই মানুষের মুক্তির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

বুদ্ধত্ব লাভের বিপুল আকাঙ্খা নিয়ে প্রকৃত গুরুর সন্ধানে ঘুরতে থাকেন সিদ্ধার্থ। প্রথমে আঢ়ার কালাম, তারপর রামপুত্র উদ্রক প্রমুখ সেই সময়কার খ্যাতিমান সন্ন্যাসীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এতে তাঁর কিছু আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধিত হলেও মন তৃপ্ত হয় নি। কিন্তু সিদ্ধার্থের মনে তো হতাশার স্থান নেই। তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস, সাধনার সঠিক পথে গেলে সিদ্ধিলাভ একদিন হবেই। তিনি নতুন করে গুরুর সন্ধানে না গিয়ে বিপুল আত্মবিশ্বাসে কঠোর সাধনায় রত হতে বদ্ধ পরিকর হলেন। সেকালের প্রচলিত কঠোরতম চতুরঙ্গ ব্রহ্মাচর্য সাধনা তিনি শুরু করলেন। পরিধানের বস্ত্রখন্ড ফেলে দিয়ে অনাবৃত দেহে গ্রীষ্মের খরতাপে আর শীতের ঠাণ্ডায় অশেষ ক্লেশ সহ্য করলেন।

লোকালয়ের ভিক্ষা ত্যাগ করে গাছ থেকে যে ফলমূল ঝরে পড়ত তাই ছিল আহার। শরীরের আরাম যাতে না হয় সে জন্য কাঁটা ছিল শয্যার উপাদান। যত রকমভাবে শরীরকে কষ্ট দেওয়া সম্ভব, তার মাধ্যমেই তিনি তপস্যা শুরু করলেন। নির্জন তপশ্চর্যার সময় কখনো কখনো এমন হতো যে, তিনি যখন আসন করে বসতেন, হয়তো রাখাল বালক এসে তাঁর নিশ্চল দেহের উপর মূত্রত্যাগ করতো। ধুলো ছড়িয়ে দিতো। এসব দৈনন্দিন অত্যাচার নীরবে সয়ে করুণা বিগলিত চিত্তে তাদের ক্ষমা করতেন। দিনে দিনে অল্পাহার এবং অনাহারে তার শরীর ভেঙ্গে গেল। হাড়-পাঁজরা বেরিয়ে পড়লো। চক্ষু হলো কোটরাগত। সমস্ত শরীর পরিণত হলো চর্মাবৃত্ত কংকালে। অবশেষে তাঁর উত্থান শক্তিও রহিত হলো। এই কঠোর তপশ্চর্যায়ও যখন সিদ্ধিলাভ হলো না, তাঁর মনে হলো সত্যের পথ এটা নয়। এতে শুধু দেহ মনের নিপীড়নই হয়। অবশেষে এক গ্রাম্য বালকের দেওয়া এক বাটি দুধ খেয়ে কিছুটা প্রকৃতিস্থ হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, আহার বিষয়ে অতো কঠোর পন্থা অবলম্বন না করে তিনি মধ্যপন্থা গ্রহণ করবেন। এতে আবার তাঁর সহচর পঞ্চব্রাহ্মণ-কৌন্ডিন্য, ভদ্রজিৎ, বপ্পা, মহানাম এবং অশ্বজিৎ- যাঁরা সিদ্ধার্থের কৃচ্ছসাধনায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর সেবাযত্ন করতেন, তাঁকে পরিত্যাগ করলেন। ভাবলেন, সিদ্ধার্থ পথভ্রষ্ট। তা স্বত্ত্বেও সিদ্ধার্থ মত পরিবর্তন করেন নি। তিনি মধ্যপন্থা অনুসরণ করেই নতুন সাধন পদ্ধতি শুরু করলেন। তাঁর হৃদয় ভরে উঠলো পুলকে, অন্তরে এলো নতুন আলোর স্পর্শ।

অল্পদিনের মধ্যেই ফিরে পেলেন হৃতস্বাস্থ্য। বসন্তের আগমনে যেমন বনে-বনান্তরে নতুনের সমারোহ শুরু হয়, তেমনই তাঁর মনোজগতেও দেখা দিল এক নতুন পরিবর্তন। মনে হলো, উদ্দেশ্য সিদ্ধির সময় যেন আসন্ন। বৈশাখের শুক্লপক্ষের চতুর্দশ তিথির প্রভাতে এক বটবৃক্ষের ছায়ায় তিনি বিভোর হয়ে বসলেন। দেহ হলো নিশ্চল। চোখে ফুটে উঠলো অপূর্ব ধ্যান দৃষ্টি। সিদ্ধার্থের ভাবমগ্ন জ্যোতির্ময় মূর্তি দেখে সেখানে উপস্থিত কুলবধূ সুজাতা ভাবলেন তাঁর আরাধ্য বনদেবতা সশরীরে যেন আবির্ভূত হয়েছেন। সীমাহীন আনন্দে সুজাতা গৃহে গিয়ে স্বর্ণপাত্রে নিয়ে এলেন পায়েসান্ন। ভক্তিভরে পায়েসের স্বর্ণপাত্র তুলে দিলেন সিদ্ধার্থের হাতে। আহারান্তে তিনি স্বর্ণপাত্রকে মৃৎপাত্রের মতো ফেলে দিলেন নিরঞ্জনা নদীর পানিতে। স্রোতের টানে তা ভেসে গেলে তিনি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। ক্রমশ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। বৈশাখি পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হলো চারিদিক।

সিদ্ধার্থের মনে এক অপূর্ব আলোর অনুভূতি জাগলো। তিনি বুদ্ধত্ব লাভের কঠিন সংকল্প নিয়ে অদূরে এক অশ্বত্থ গাছের তলায় আসন গ্রহণ করলেন। তাঁর চোখ ধ্যান নিমীলিত হয়ে এলো। মন ক্রমশ ধ্যানের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে সুখ-দুঃখের অতীত সহানুভূতিযুক্ত শুদ্ধশান্ত ধ্যানে মগ্ন হলেন। তাঁর সমাহিত চিত্ত জাতিস্মর জ্ঞান লাভ করলো। তিনি দর্পণে প্রতিফলিত বস্তুর মতো জন্ম-জন্মান্তরের চিত্র দেখতে পেলেন। রাত্রির প্রথম যামেই আয়ত্ব হলো তাঁর এ বিদ্যা।

দ্বিতীয় যামে তাঁর কাছে উদঘাটিত হলো জন্ম-মৃত্যুর রহস্য। দিব্যদৃষ্টি মেলে প্রত্যক্ষ করলেন জীবজগতের আসা-যাওয়ার খেলা। রাত্রির তৃতীয় যামে অন্তরের সমস্ত রিপুকে নির্মূল করে তাঁর চিত্ত হলো মুক্ত, বন্ধনহীন। এখানেই তাঁর বুদ্ধ জীবনের বিকাশ, সাধনার পরিপূর্ণতা। তিনি হলেন, ‘বুদ্ধ’ অর্থাৎ জ্ঞানের প্রতিমূর্ত।

সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভ করবার পর বারাণসীর সারনাথ নামক স্থানে দেওয়া প্রথম উপদেশে বলেছিলেন যে, ‘মুক্তির জন্য সাধনার দু’টি চরম পথই বর্জন করতে হয়। প্রথম হলো ইন্দ্রিয়পরতা, যা মানুষকে করে দেয় হীন, বর্বর, অশ্লীল এবং অনর্থের ভাগীদার। আর দ্বিতীয় হলো কৃচ্ছ্রতা সাধন বা সাধনার নামে আত্মপীড়ন। যাতে শরীরের ভোগান্তি হয়ে মনে অবসন্নতা আনে। এই দুইয়ের মধ্যপথেই মানুষের চোখ খুলে দেয়। আলো আনে। এবং কামনা বাসনার বহ্নি নিভিয়ে নির্বাণের পথে যেতে তাকে সাহায্য করে। সে কারণেই তিনি বলেছেন মধ্যপন্থার কথা অর্থাৎ ‘মজ্ঝিমা পটিপদা’। এ সবই বুদ্ধের নিজের জীবনচর্চার নির্যাস থেকে নেওয়া।

কোনো মানুষ সর্বজ্ঞ হতে পারে বলে বুদ্ধ বিশ্বাস করতেন না। বলেছেন, ‘এমন কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নেই, যিনি একেবারেই সব জানবেন ও দেখবেন। অর্থাৎ সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা হবেন। স্বাধীন চিন্তাচর্চায় উদ্বুদ্ধ করে তোলার জন্যই ভিক্ষুদের উপদেশ দিয়েছিলেন, “ভিক্ষুগণ! আমি সেতুর মতো অতিক্রম করার জন্য তোমাদের ধর্মোপদেশ দিচ্ছি, ধরে রাখার জন্য নয়। ...যেমন একজন পুরুষ এক বিরাট নদীর তীরে উপস্থিত হলো, যার এপার বিপদসংকূল, ভয়পূর্ণ ও ওপার সুখসমৃদ্ধিপূর্ণ তথা ভয়রহিত। অথচ সেখানে যাওয়ার জন্য কোনো তরীও নেই। নেই কোনো সেতু। ...তখন ...সে তৃণকাষ্ঠ...পত্র সংগ্রহ করে সেতু বেঁধে, তার সাহায্যে দৈহিক পরিশ্রমের দ্বারা স্বস্তিপূর্বক নদী পার হলো। .... এরপর তার মনে হলো- ‘এই সেতু আমার উপকার করলো, এর সাহায্যে .... আমি পার হলাম; অতএব এখন একে আমি কেনই বা মাথায় করে অথবা কাঁধে তুলে ...নিয়ে যাব না’। ...তবে কি ...ঐ পুরুষকে সেতুটির প্রতি কর্তব্য পালনকারী ধরতে হবে? ...না ...ভিক্ষুগণ! ঐ সেতুটি থেকে দুঃখকেই আহরণ করবে।”

অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী, যুক্তি, মুক্তবুদ্ধি, পরমত সহিষ্ণুতা এবং শান্তমন প্রভৃতি যে সব সদ্গুণ আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রধান উপাদান হিসেবে গণ্য, মহামনিষী বুদ্ধ কিন্তু এসব গুণাবলী আড়াইহাজার বছরেরও আগে মানুষকে অর্জন করার জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি যাগযজ্ঞ, মন্ত্রতন্ত্র, জাতিভেদ এবং অস্পৃশ্যতার অভিশাপ থেকে মানবতার মুক্তির কথা ঘোষণা করেছিলেন। মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করার জন্য বুদ্ধ মানুষের শ্রেণী বা জন্মের উপর কোনও গুরুত্ব আরোপ করেন নি। তিনি জোর দিয়েছিলেন মানুষের গুণ এবং সদাচরণের উপর। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংঘের দরোজা সকলের জন্য ছিল উম্মুক্ত ও অবারিত। ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়, বৈশ্য-শূদ্র, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য সকলেই সেখানে স্বাগত। ক্ষৌরকার, উপালি, অস্পৃশ্য সুণীত, চন্ডাল কন্যা, প্রকৃতি, নগরনটী, আম্রপালি সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ সংঘের সম্মানিত সদস্য-সদস্যা।

বুদ্ধের সময় বৈশালী ছিল এথেন্সের মতো একটি শক্তিশালী গণরাজ্য। শক্তিশালী মগধ সাম্রাজ্যের পাশে অবস্থিত বৈশালী গণরাজ্যকে তিনি অজেয় থাকার অভয়বাণী শুনিয়েছিলেন। গৌতমের সময় ভারতবর্ষে যদিও মূলত নিপীড়নমূলক রাজতন্ত্রেরই প্রতিষ্ঠা ঘটে গিয়েছিল, তবু সেই সময়ে বেশ কয়েকটি গণরাজ্যও বিদ্যমান ছিল। সেই গণরাজ্যগুলোতে ‘শাসনের রূপ ছিল যৌথ ব্যবস্থা।

নির্বাচিত হতো একজন সভাপতি- রাজা হিসেবে তাঁর পরিচয় থাকলেও রাজতন্ত্রের রাজা তিনি নন বরং বলা যায় উপজাতি প্রধান। শাসনের বিভিন্ন বিষয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক হতো। সিদ্ধান্ত গ্রহণে একমত না হলে ভোট নেওয়া হতো। ভূমির মালিকানা কখনো ছিল গ্রামের সকলের যৌথভাবে অথবা কখনো উপজাতি প্রধানের। তিনি লোক নিয়োগ করে চাষ করাতেন। ... ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের ব্যাপারে রাজতন্ত্র অপেক্ষা অনেক বেশী উদার ছিল গণরাজ্য। প্রচলিত মতের বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী সহ্য করা হতো। এই গণরাজ্য থেকে উত্থান হয় দুই নেতার- শাক্য উপজাতি থেকে গৌতম বুদ্ধ এবং জ্ঞাতৃক উপজাতি থেকে জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর।

গৌতম বুদ্ধের গণতান্ত্রিক আদর্শে একান্ত আস্থার প্রমাণ বৌদ্ধ সংঘে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও চালু। অধিকাংশের এবং স্বল্পসংখ্যকের মত জানার জন্য ভোট গণনার ব্যবস্থা ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতেই সংঘের অধ্যক্ষ বা সংঘনায়ক নির্বাচিত হতেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার উপর বুদ্ধের গভীর আস্থার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর পরিনির্বাণের পূর্বে কোনও উত্তরসূরি নিযুক্ত করে না যাওয়া। যোগ্য উত্তরসূরি নির্বাচনের দায়িত্ব তিনি সংঘের উপরই ন্যস্ত করেছিলেন। সেকালের সমাজের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরোধিতা স্বত্ত্বেও বুদ্ধ তাঁর সংঘে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর পুরো জীবনের কর্ম ও সাধনাই ছিল; ‘বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়।’

হিংসা, অবিশ্বাস, প্রেমহীনতা এবং লোভ সে আমলে মহামারির মতোই ছড়িয়েছিলো। এই বাতাবরণে বুদ্ধ অহিংসা, বিশ্বাস, ক্ষমা, নির্লোভ এবং প্রেমের বাণী প্রচার করেন। তাঁর দর্শনের সার্বভৌম উদারতাই মানুষকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। বুদ্ধ বলেছেন সেই মূল মন্ত্রের কথা- “অক্কোধেন জিনে কো ধং/ অসাধুং সাধুনা জিনে।”

অর্থাৎ সর্বজীবে দয়া এবং বিশ্বমৈত্রী যে ধর্মের ভিত্তি; জগতে তার প্রাসঙ্গিকতা চিরকালীন। বৌদ্ধ ধর্ম এবং দর্শনে অন্ধ বিশ্বাসের কোনও স্থান নেই। যুক্তি এবং বিচারই এখানে গ্রহণ বা বর্জনের শেষ কথা। সকলের প্রতি তথাগত বুদ্ধের অমর অবদান বিশ্বমৈত্রী। এই বিশ্বমৈত্রী কিন্তু শ্রেণী বা সম্প্রদায়গত নয়। সার্বজনীন মানবধর্মরূপেই স্বীকৃত এই বিশ্বমৈত্রী। বুদ্ধ এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে করুণাঘন অন্তরে যে দর্শন পরিবেশন করেছেন, তাতে বিশ্বমৈত্রীই ব্যাপকতা লাভ করেছে। বিশ্বের সকল প্রাণীর সার্বিক মঙ্গলের জন্য তাঁর পরিবেশিত ধর্মদর্শন বিশ্বের এক অসাধারণ অধ্যায়ের সূচনা করে। বিশ্বমৈত্রীর ভাবনা ছাড়া মানুষের সুখ-শান্তি প্রায় অসম্ভব। আর এর মূলমন্ত্রই হলো, ‘তুমি যেমন সুখে থাক, অপরকেও সুখে থাকতে দাও।’ বুদ্ধ বলেছেনও, “নাই বেরেন বেরানি সম্মান্তীধ কুদাচনং’/ অবেরেন চ সম্মন্তি এস ধম্মো সনন্তনো।’ অর্থাৎ বৈরিতার দ্বারা বৈরিতা, শত্রুতার দ্বারা শত্রুতা কখনো প্রশমিত হয় না, অবৈরিতা ও মৈত্রী দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়। হিংসাকে হিংসা দিয়ে জয় করা যায় না। অহিংসা দিয়েই হিংসাকে জয় করতে হয়। আগুনকে আগুন দিয়ে যেমন নেভানো সম্ভব নয়, তদ্রƒপ অসাধুতাকে সাধুতার প্রভাবে জয় করাই চিরন্তন সত্যধর্ম।

বুদ্ধ যখন তার বাণী ও দর্শন প্রচার শুরু করেন, তখন তা ছিল শুধু সংসারত্যাগীদের জন্য। গৃহীদের জন্য ধর্মপালনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পরবর্তী সময়ে যখন ভিক্ষুসংঘ গড়ে উঠল; তখন বৌদ্ধ দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষ ভিক্ষুদের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে যেতো তাদের সেবা করার মানসে। এভাবেই গৃহীরা ভিক্ষুদের কাছাকাছি আসে। এর পরই নিয়ম হয়, ত্রিশরণ গ্রহণ করলেই বৌদ্ধগৃহী হওয়া যাবে।

বাংলা বর্ষের প্রথম মাস বৈশাখের পূর্ণিমা তিথির উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা নামে অভিহিত। এই পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ সিদ্ধার্থ লুম্বিণীকাননে জন্মগ্রহণ করেন। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতে সিদ্ধার্থ ৩৫ বছর বয়সে বুদ্ধত্ব অর্জন করেন। অবশেষে এই পূর্ণিমা তিথিতেই মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। বুদ্ধের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ঘটনা বিশ্ব বৌদ্ধসম্প্রদায় পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। জীব জগতের প্রতি অপরিসীম সহানুভূতি ও করুণা বুদ্ধের ধর্মবৈশিষ্ট্য। এজন্য তার ধর্মকে ‘মানব ধর্ম’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। মানবের অধোগতি রোধই ছিল তাঁর আরাধ্য।

কলুষমুক্ত জাগতিক পরিবেশ চেয়েছিলেন বুদ্ধ। জগত জীবন ও প্রকৃতি নিয়েই তার চিন্তা ও দর্শনের বিস্তার। সকল বিভ্রান্তিকে জয় করেই শাক্যমুনি গৌতম হয়েছিলেন বুদ্ধ। জ্ঞানের বিস্তারের জন্য তিনি সঙ্ঘও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আড়াইহাজার বছর আগে বুদ্ধ চেয়েছিলেন, বিশ্বশান্তি। প্রতিহিংসা বা বিবাদকে পরিহার করতে বলেছিলেন। কারণ এসব হচ্ছে যুদ্ধের কারণ। যুদ্ধ অপরিহার্য বা ইতিহাসের অপরাজয় বলতে কিছু নেই। মানুষের শক্তি রয়েছে নিজেকে দমন করার। গৌতম বুদ্ধ বলেছেনও তাই-
“যো সহস্সং সহসসেন সঙ্গামে মানুষে জিনে, / একঞ্চ জেয়্যমত্তানং স বে সঙ্গাম জুত্তমো।”
অর্থাৎ যে ব্যক্তি যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষকে জয় করে তার তুলনায় যিনি কেবল নিজেকে জয় করেন, তিনিই সর্বোত্তম সংগ্রামজয়ী। আত্মজয় হচ্ছে শ্রেষ্ঠ জয়। বুদ্ধের মতে, সৃষ্ট জগৎকে খণ্ড খণ্ড করে নানা দেশ, নানা জাতি হিসেবে দেখার নাম মানবতা নয়। সমস্ত পৃথিবী ও প্রাণীলোককে অখণ্ড হিসেবে দেখার নামই মানবতা। বুদ্ধ মানবকল্যাণে, মানবহিত সাধনায় এক বিস্তৃত দিগন্ত রেখে গেছে মানব জাতির জন্য। যা আজো বহমান। বৈশাখীপূর্ণিমার লগ্নে তাই আকাঙ্খা থাকুক যেন বিশ্বশান্তি ও মৈত্রীর সোপান প্রসারিত হয় মানবাত্মা জুড়ে। বুদ্ধ তা-ই চেয়েছিলেন।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

এইচআর/জেআইএম

সমস্ত পৃথিবী ও প্রাণীলোককে অখণ্ড হিসেবে দেখার নামই মানবতা। বুদ্ধ মানবকল্যাণে, মানবহিত সাধনায় এক বিস্তৃত দিগন্ত রেখে গেছে মানব জাতির জন্য। যা আজো বহমান। বৈশাখীপূর্ণিমার লগ্নে তাই আকাঙ্খা থাকুক যেন বিশ্বশান্তি ও মৈত্রীর সোপান প্রসারিত হয় মানবাত্মা জুড়ে। বুদ্ধ তা-ই চেয়েছিলেন।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।