যুবশক্তির ওপরে কতটা নির্ভর করছে চীন?
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনৈতিক শক্তি চীন। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় বিশ্বের বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও একের পর এক চমক সৃষ্টি করছে দেশটি। অলিম্পিক আয়োজন থেকে শুরু করে মহাকাশে নভোচারী প্রেরণ, মহাকাশ স্টেশন স্থাপন আর মঙ্গলগ্রহে মহাকাশযান অবতরণ কোনোটাতেই পিছিয়ে নেই তারা।
চীনের এই এগিয়ে চলার রহস্য নিয়ে বিশ্বের কৌতূহলেরও শেষ নেই। প্রশ্ন হলো উন্নয়নের এই ধারাবাহিক অর্জনের পেছনে চীনের জনগোষ্ঠীর কোন অংশের অবদান সবচেয়ে বেশি? চীনের বর্তমান নীতি ও পরিকল্পনার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, দেশটির সব পরিকল্পনায় এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে যুবসমাজ।
দীর্ঘদিন চীনে ছিল এক সন্তান নীতি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে তিন সন্তান নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ দেশের যুবশক্তির অংশ যদি কমে যায় আর প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অংশ বেড়ে যায় তাহলে সেটি একটি দেশের অর্থনীতির ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ভবিষ্যতে দেশের যুবশক্তি যেন কমে না যায় এবং জনসংখ্যার একটা বেশি অংশ যেন থাকে যুব সম্প্রদায় সেজন্যই তিন সন্তান নীতি গ্রহণ করেছে চীন।
৪ মে ছিল চীনের যুব দিবস। ১০ মে পালিত হলো চীনের কমিউনিস্ট পার্টির যুবলীগ (কমিউনিস্ট ইয়ুথ লীগ অব চায়না) প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকী। এই শততম বার্ষিকী দারুণ জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হয়েছে। বেইজিংয়ের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চীনের পার্লামেন্ট ভবন গ্রেট হল অব পিপলে এই উপলক্ষে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং যিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকও, এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং তার বক্তব্যে বলেন, চীনা স্বপ্ন বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তরুণদের ওপর। তরুণদের হাত ধরেই ভবিষ্যৎ জয় করবে চীন।
কমিউনিস্ট ইয়ুথ লিগ অব চায়নার সদস্যদের প্রতি সি চিনপিং বলেন, তাদের উৎসাহের কারণেই চীনা জাতির মহান পুনর্জাগরণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসেছে বহু তরুণ ও যুবক। কমিউনিস্ট পার্টির যুবলীগের সদস্য হলেন ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরা। উদ্বোধনী ভাষণে সি চিনপিং বলেন, ‘কমিউনিস্ট ইয়ুথ লীগের সদস্য, আমার তরুণ বন্ধুরা। আকাশ সমান স্বপ্ন লালন করতে পারে একমাত্র তরুণরাই। তারাই পারে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে। একটি জাতি কেবল তখনই প্রয়োজনীয় উন্নয়ন করতে পারে যখন তাদের তরুণদের মধ্যে উচ্চাশা ও তারুণ্যে ভরপুর কর্মশক্তি থাকে। আজকের এই বিশাল জমায়েতের একটাই কারণ, চীনের কমিউনিস্ট ইয়ুথ লীগের ১০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। তাদের উৎসাহের কারণেই চীনা জাতির মহান পুনর্জাগরণের যে স্বপ্ন আমরা লালন করি তা বাস্তবায়নে এখন বহু তরুণ ও যুবক সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসেছে। আজকের এই দিনে সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে উষ্ণ অভিনন্দন।’
চীনা প্রেসিডেন্টের এ ভাষণে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, চীন এবং অবশ্যই কমিউনিস্ট পার্টিনির্ভর করছে যুবশক্তির ওপর। এ বছর শীতকালীন অলিম্পিক আসরের যে থিমসন তাতেও কিন্তু এই আশার বাণী প্রচারিত হয়েছে। ‘টুগেদার ফর এ শেয়ারড ফিউচার’। বিশ্বের প্রতি চীনের মূল আহ্বান হলো একসাথে অভিন্ন ভবিষ্যতের দিকে।
অতি সম্প্রতি চীনের স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বিশ্বকে ‘এশিয়ান মুহূর্ত’- এ বৈশ্বিক শাসনের সাথে এশীয় কণ্ঠস্বর আরও বেশি করে শোনার আহ্বান জানিয়েছেন। ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে কম্বোডিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রাক সোখোনের সঙ্গে বৈঠকে ওয়াং এ মন্তব্য করেন।
বিশ্ব নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে উল্লেখ করে ওয়াং বলেন, চীনা পক্ষ মানবজাতির জন্য একটি অংশীদারত্বমূলক অভিন্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি সম্প্রদায় গড়ে তোলার লক্ষ্যে আরও ন্যায়সঙ্গত বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভকে এগিয়ে নিচ্ছে।
ওয়াং বলেন, চীন এ অঞ্চলে দুটি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে এবং আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন সমুন্নত রাখতে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) সাথে কাজ করতে প্রস্তুত।
আগামী মাস থেকে, চীন, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ড ধারাবাহিকভাবে ব্রিকস নেতাদের সভা, সহযোগিতার বিষয়ে পূর্ব এশীয় নেতাদের বৈঠক, জি-২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন এবং এপিইসি অর্থনৈতিক নেতাদের বৈঠকের আয়োজন করবে। ওয়াং বলেন, এটি হরো বিশ্ব শাসনের জন্য ‘এশীয় মুহূর্ত’ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আশা করে যে এশিয়া এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
একটা বিষয় এখানে পরিষ্কার যে, চীন যদি বিশ্ব উন্নয়নে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখতে চায় তাহলে অবশ্যই তরুণদের গড়ে তুলতে হবে তার উপযুক্ত করে। সিপিসির (চীনের কমিউনিস্ট পার্টি) ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব আসবে তরুণদের মধ্য থেকেই। আর এজন্যই যুব উন্নয়নে এমন গুরুত্ব দিচ্ছে চীন।
১৯২২ সালের ৫ মে গঠন করা হয় কমিউনিস্ট ইয়ুথ লিগ অব চায়না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশ গঠনে সিপিসির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তরুণদের এই সংগঠন। চীনা বিপ্লবেও ছিল ইয়ুথলীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নব্বই দশকে এবং নতুন শতকে চীনের তাকলাগানো ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলোও মূলত এগিয়েছিল তরুণদের হাত ধরেই। মহাকাশ মিশনেও চোখে পড়ছে তরুণদের নেতৃত্ব। রোবোটিকস, সাইবার অগ্রযাত্রা থেকে শুরু করে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কৃষিবিপ্লবেও এখন নেতৃত্ব চীনের যুবসমাজের হাতেই।
যুবদিবস এবং কমিউনিস্ট ইয়ুথলীগের শতবর্ষ উদযাপনে তাই পুরো চীনেই ছিল উৎসবের আমেজ। জাতির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি যে তারাই একথা বুঝতে দেরি হয়নি চীনা নেতৃবৃন্দের। তাই সময়োচিতভাবেই যুবলীগের প্রতি এই গুরুত্ব ও মনোযোগ দিচ্ছেন সি চিনপিং।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম