ইলিশের খোঁজে
এবার দারুণ একটা রমজান কাটালো দেশের মানুষ। রমজানটা এমনিতেই দারুণ। পারলৌকিক জীবনে অনন্ত যাত্রার প্রস্তুতিটা যাতে মানুষের ঠিকঠাকমতন হয় এজন্য স্রষ্টা রমজানে অনেক সুবিধা করে দিয়েছেন। মানুষও তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে রোজা রেখে আর ধর্মীয় অনান্য বিধিবিধানগুলো আরেকটু ভালোভাবে মেনে চলার মধ্যে দিয়ে।
পাশাপাশি ভোজনরসিক বাঙালি রমজানের সান্ধ্যকালীন যেটুকু সময়ে ভোজনাহার সিদ্ধ, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে বাহারি সব ইফতার আর সেহেরির আয়োজনের মাধ্যমে। মাঝে দুটো বছর কোভিডের অত্যাচারে ঘরের ভিতরে সিঁধিয়ে পড়তে হয়েছিল আমাদের আর বাদবাকি বিশ্বের মতই।
বাদবাকি পৃথিবীর খবর জানি না, বাংলাদেশে কোভিড এখন অনেকটাই ব্যাকফুটে। ভোজন রসিক, উৎসবপ্রিয় বাঙালি এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে এই রমজানে পুরো মাত্রায়। নানা ধরনের আয়োজনে সেজেছে বাঙালির ইফতার আর সেহেরির টেবিলগুলো।
ছিল ইফতার পার্টি। কোন কোন দিন একাধিক ইফতারের দাওয়াতেও সামিল হতে হয়েছে অনেককে। সাথে এবারের নতুন সংযোজন সেহেরি কালচার আর সেহেরি পার্টি। এক সময় পুরোনো ঢাকার রেস্টুরেন্টগুলোয় সেহেরির জনপ্রিয়তা ছিল সীমিত পরিসরে। হালের রমজানে তা পুরোনো ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়েছে গোটা ঢাকায় আর ঢাকার গণ্ডি ছাপিয়ে গোটা দেশেই। রমজানে সিলেটে আর চট্টগ্রামেও দেখেছি জমজমাট সেহেরি উৎসব। এমনি বেশ কয়েকটা সেহেরি পার্টিতে এবার যোগ দেয়ার সুযোগ হয়েছে আমারও।
সেহেরির খোঁজে প্রায়ই তখন এদিক ওদিক খোঁজ-খবর নেয়া, সেহেরিটা ভালো কোথায় আর কোথায় বা আছে কিছুটা নতুনত্ব। এমনি সময় খবর পেলাম ইলিশের। সেহেরিতে পাওয়া যাচ্ছে পদ্মার ইলিশ। বাছাই করে ভেজে খেয়ে উপভোগ করা যাবে পদ্মার ধারে বসে খোদ পদ্মার ইলিশ, ভাবতেই জিহ্বাটা জলে টইটুম্বুর। সাথে থাকবে সেই ইলিশের লেজের সুস্বাদু ভর্তাও। ভাবা যায়?
চ্যালেঞ্জ অবশ্য কিছুটা থেকেই যাচ্ছে। যেতে হবে বহুদূর। ঢাকা মহানগরতো বটেই, ঢাকা জেলার গণ্ডি পেরিয়ে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটে। সেখানেই মিলবে পদ্মার দেড়-দু’ কেজি সাইজের ভোমা-ভোমা ইলিশ, সেহেরিতে যা খেয়ে জুড়াবে প্রাণটা।
যেই ভাবা সেই ছোটা। নিজেদের গাড়িতো আছেই, সাথে ভাড়া করা হলো একটা বারো সিটের মাইক্রোবাসও। রাত-বিরাতে ইলিশের খোঁজে আন্তঃজেলা যাত্রায় সঙ্গী পেতে কাটখড় পুড়েনি এতটুকুও। বন্ধু-বান্ধব ছাড়াও সঙ্গী হলো চেম্বার আর এন্ডোস্কোপি রুমের সহকর্মীরা। একদল আগেই চলে গেছে, কারণ খবর পেয়েছি ওখানে অপেক্ষার সারিটা লম্বা হতেই পারে, প্রায়ই নাকি যা হার মানাচ্ছে টিসিবির ট্রাকের লাইনকেও।
হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে মাওয়ার এক্সপ্রেসওয়েতে যাওয়া হয়েছে আগেও, যাওয়া হয়নি রাতে। এ পথে আগে যে যায়নি তার জন্য এ এক অভিজ্ঞতাই বটে। অভিজ্ঞতা তাদের জন্যও যারা আমার মত প্রথমবার এ পথে রাতের যাত্রি। টানা ফ্লাইওভার আর এক্সপ্রেসওয়ে। হার মানাবে উন্নত বিশ্বকেও। শাঁ করে ছুটছে গাড়ি আর তার আলোয় জ্বল জ্বল করছে এক্সপ্রেসওয়ে আর ডিভাইডারে বসানো ক্যাটস আইগুলো। দু’পাশে দ্রুত বদলাচ্ছে দৃশ্যপট। কখনো বালু নদীর বিশাল বিস্তার তো কখনো আলোয় উদ্ভাসিত শিল্পাঞ্চল, আবার কখনোবা আঁধারে ঘুমন্ত গ্রামের জনপদ। এক স্বর্গীয় অনুভূতি, যার বর্ণনা ভাষায় কঠিন। আগামীর উন্নত বাংলাদেশের পথ ধরে আজকেই ছুটতে ছুটতে এক সময় পৌঁছে যাই মাওয়া ঘাটে।
আমার এন্ডোস্কোপি এসিসটেন্ট এরই মধ্যে জুটে গেছে লাইভ কিচেনে শেফকে সাহায্য করায়। শয়ে শয়ে পিস ইলিশ ভাজতে ভাজতে ক্লান্ত শেফও উপভোগ করছেন দক্ষ এন্ডোস্কোপি এসিসটেন্টের অ্যামেচার এসিসটেন্স। বুদ্ধিমানের মত এডভান্স পার্টি পাঠিয়ে রাখায় আমাদের জন্য অপেক্ষার ঘড়িটা খুব একটা দীর্ঘ না হলেও, ঘড়ির কাটা চোখ রাঙাচ্ছে যে কোন সময় মাইকে বিশ্বাসীদের নামাজে আহ্বান জানাবেন ইমাম সাহেব। অতএব সময় সীমিত। এরই মাঝে তাড়াহুড়োয়, হাপুস-হুপুস ইলিশ খেয়ে তৃপ্ত পেটে যখন ঢাকার পথে ফিরতি যাত্রায়, দিগন্তে তখন আলোর রেখা। দৃশ্যপট স্বর্গীয়ই, তবে রাতের চেয়ে তা একেবারেই ভিন্ন।
ইলিশের খোঁজ শেষমেষ পেয়েছি ডিপ ফ্রিজের বরফের আড়ালে তাতে কি? পেয়েছি গরমা-গরম ভাতের সাথে গরমা-গরম ইলিশ ভাজা আর দারুণ লেজ ভর্তা। সাথে চলতি পথের দারুণ যত দৃশ্য আর আগামীর বাংলাদেশের ইঙ্গিত। সার্থক আমার ইলিশের খোঁজে আন্তঃজেলা যাত্রা।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/জেআইএম