বাংলাদেশের মতোই বেলুচ শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও একই আচরণ পাকিস্তানের

ফারাজী আজমল হোসেন
ফারাজী আজমল হোসেন ফারাজী আজমল হোসেন
প্রকাশিত: ০৩:৩৬ পিএম, ০৭ মে ২০২২

৫০ বছর আগে বাংলাদেশে করা ভুলগুলোরই পুনরাবৃত্তি করছে পাকিস্তান। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) বাঙালি ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যার মাধ্যমে শেষ করে দিতে চেয়েছিল বাঙালির ভবিষ্যত। ৫০ বছর পর সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি চলছে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে। বেলুচ শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালাচ্ছে পাকিস্তানি সেনা। পাকিস্তানি সেনার হিংসার বলি হয়েছেন বহু বেলুচ শিক্ষার্থী। ঘটনা এতোটাই উদ্বেগজনক যে পাকিস্তানের বিচারপতিরাও উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে হিংসা বন্ধের নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছেন।

বেলুচ শিক্ষার্থীদের দুর্দশার কথা মাথায় রেখে পাকিস্তানের অধিকার রক্ষা আন্দোলনের নেতা ও আইনজীবী ইমান জায়নাব হাজির ইসলামাবাদ হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। ২৮ এপ্রিল সেই মামলায় ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন অবিলম্বে বেলুচ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের। সেইসঙ্গে বেলুচ শিক্ষার্থীদের যাতে কোনও বিদ্বেষের শিকার হতে না হয় সেটিও নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয় আদালত। কিন্তু তার নির্দেশকে আমলই নিচ্ছেনা পাকিস্তানি সেনা।

বিচারপতি মিনাল্লাহ বেলুচ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের কারণে পাকিস্তান সরকারের ওপর বহুদিন ধরেই ক্ষিপ্ত। এর আগেও তিনি রাষ্ট্রপতি আসিফ আলভীকে পাকিস্তানের মাটিতে বেলুচ শিক্ষার্থীদের ওপর জাতিগত বিদ্বেষ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ তিনি অবগত, পাকিস্তান জুড়ে চলছে বেলুচ নিধন। লঙ্ঘিত হচ্ছে বালুচদের বেঁচে থাকার অধিকার।

সাতচল্লিশে স্বাধীনতা লাভ করলেও কখনই পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি সুদৃঢ় হয়নি। কারণ পাকিস্তানের পাঞ্জাবি সেনারা (পাঞ্জাব রেজিমেন্ট) চিরকালই ব্যস্ত ছিল নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে। পাকিস্তানে বসবাসকারী অন্যান্যদের চিরকাল দাবিয়ে রাখাই পাঞ্জাবি সেনার অন্যতম কৌশল। আর এই কারণেই পাকিস্তানে পাঞ্জাবের বাইরে সিন্ধু, বেলুচিস্তান অথবা খাইবার পাখতুনখাওয়ার বাসিন্দারা কখনই নিজেদের পাকিস্তানি নাগরিক বলে ভাবতে পারেনি। এমনকী, মুলতান অঞ্চলের সরাইকি জাতিগোষ্ঠীও পাকিস্তানি পাঞ্জাবীদের আধিপত্যে অখুশি।

নাগরিকদের অসন্তোষের কথা জানা থাকলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যাবলয়ে পাশতুন, বেলুচ, সিন্ধু প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর পড়ুয়াদের ওপর নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে চলছে হয়রানিও। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেও শিক্ষা হয়নি পাকিস্তানের। একই ভুল তারা এখনও করে চলেছে।

শত অত্যাচারের পরও বাংলা ভাষার স্বীকৃতি কিন্তু কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নিয়েছিলো বাঙালীরা। এখন দেখার বিষয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার হজম করে পাশতুন, সিন্ধু, বেলুচরাও তাদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারেন কিনা। জাতিগত বিদ্বেষ ১৯৫২ সালের বাঙালি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল। সেই অসন্তোষই ২৪ বছরের মধ্যে দ্বিজাতি ত্বত্বকে ধূলিস্যাত করে দিয়ে মাতৃভাষার সম্ভ্রম রক্ষায় জন্ম নেয় এক নতুন দেশ।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ। আসলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বা সেনাকর্তারা মাঝ্যে মধ্যেই ভুলে যান যে, শুধু মুসলিমরাই পাকিস্তানের নাগরিক নন। অন্য জাতি বা ধর্মের মানুষদেরও পাকিস্তানে বসবাসের অধিকার রয়েছে। তাই তথাকথিত আল্লাহর নিজের দেশ ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তানে সুন্নি মুসলিম থেকে শুরু করে অন্যরা শান্তিতে বসবাস করতে পারেন না। ভাষা ও জাতিসত্তার বিষয়টি সারা বিশ্বে ধর্মের ওপর বিরাজ করছে। ইউরোপ তার জ্বলন্তু উদাহরণ। এটা আজও বুঝে উঠতে পারেনি পাকিস্তান।

মেধাবী বেলুচ শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীদের পাঞ্জাব, সিন্ধ এবং ইসলামাবাদ থেকে অপহরণ করা হচ্ছে। আর এই অপহরণ আর অন্তর্ধানই হয়ে উঠেছে বেলুচদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বৈরীতার মূল কারণ। পাঞ্জাবের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেসের ছাত্র বেবগার ইমদার এবং ড. দিদার বেলুচকে গায়ের জোড়ে সেনাবাহিনীর তুলে নিয়ে যাওয়াই প্রমাণ করে বেলুচদের ওপর পাকিস্তানি সেনার অত্যাচারের আসল স্বরূপ। এই ঘটনাই স্মরণ করিয়ে দেয় একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর রাতের বিভীষিকা। এক রাতে ১ হাজার ১১১ জন বাঙালী শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনা। এর দুদিন পরেই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে জন্ম নেয় বাংলাদেশ।

পাকিস্তান সেনার জোরপূর্বক অন্তর্ধান বিষয়ক তদন্ত কমিশন (সিওআইইডি)-এর প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ২০১১ সাল থেকে অন্তত ৭ হাজার বেলুচ, সিন্ধু, পাশতুন, শিয়া, আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের ছাত্র-যুবককে গায়ের জোরে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয়। ২০১৯ সালেই নিখোঁজ হয়েছেন অন্তত ৭০০ ছাত্র-যুবক।

পাকিস্তানে সেনাবাহিনীই সববিষয়ে শেষ কথা বলে। আল্লাহর পরে সর্বশক্তিমান বলে নিজেদেরই মনে করে পাকিস্তান সেনা। তাই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির নির্দেশও অমান্য করার সাহস দেখাতে পারে তারা। প্রধানমন্ত্রী, শীর্ষস্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, এমনকী দেশের সংবিধানও পাকিস্তান সেনার কাছে তুচ্ছ। নইলে আদালতের অগণিত নির্দেশিকা তারা অমান্য করার সাহস দেখাতো না।

আদালত ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নির্দেশ অমান্য করার পরম্পরা তৈরি হয়েছে পাকিস্তানি সেনার মধ্যে। আর তার থেকেই ভবিষ্যতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়ছে। বেলুচ নারীর আত্মঘাতী বোমা হামলা প্রমাণ করে, তারা পাকিস্তানি সেনার ওপর কতোটা ক্ষিপ্ত। ডুরান্ড লাইন মানতে নারাজ পাশতুনরাও ক্ষিপ্ত সেনাবাহিনীর ওপর। পাঞ্জাবী ছাড়া অন্য কোনও ভাষা বা সংস্কৃতিকে মর্যাদা না দেয়ায় প্রায় সমস্ত জাতিগোষ্ঠীরই ক্ষোভ বাড়ছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সৈন্যরা যা করেছে তা গত ৭০ বছর ধরে বেলুচিস্তানের সঙ্গে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন অঞ্চলটির 'মুকুটহীন রাজা' বলে খ্যাত 'দ্য খান অব খালত' এইচ এইচ আমির আহমেদ সুলেমান দাউদ। সেখানে অবস্থা কতটা ভয়ংকর তার বর্ণনা বিগত বছরগুলোতে দিয়ে আসছে এই অঞ্চল থেকে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাওয়া বেলুচিস্তানের অধিবাসীরা।

কখনও সেনাবাহিনীর অত্যাচার, আর সেনা বাহিনী দিয়ে সম্ভব না হলে পাকিস্তান সেনা বাহিনী পালিত জঙ্গি গোষ্ঠী দিয়ে অত্যাচার। অগণিত গুম-খুন এবং হত্যার ইতিহাস এখানে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। ভাইয়ের সামনে বোনকে উলঙ্গ করে রাখা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিথ্যা জবানবন্দী আদায়ের জন্য।

বেলুচিস্তানের এই রাজা বাংলাদেশে সফরকালে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানে দুই ধরণের সৈন্য আছে। এক ইউনিফর্ম পরা সৈন্য এবং আরেকটি ইউনিফর্ম ছাড়া সৈন্য। পাকিস্তানি সৈন্য সরাসরি হত্যা করতে না পারলে এই ইউনিফর্ম ছাড়া সৈন্যদের প্রেরণ করে। পৃথিবী তাদের বিভিন্ন নামে চেনে। কখনও তারা লস্কর-ই-ওমর, কখনও তাহরিকে পাকিস্তান। কিন্তু বেলুচিস্তানের তাদের সবার কাজ একটি। আর তা হল, শোষণ।

ডন পত্রিকার একটি কলামে বলা হয়, বেলুচিস্তান থেকে কোন সাংবাদিকের জীবিত ফেরত আসাটাই এক ধরণের বিজয়। আর সেটাই প্রমাণ করে পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের বাক স্বাধীনতার প্রকৃত চিত্র।

এদিকে একই রকম অত্যাচার চলছে পাকিস্তানের সিন্ধু অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর। সেখানে বাধ নির্মাণ থেকে শুরু করে সিন্ধুর একটি দ্বীপ কেন্দ্রীয় সরকারের দখলে নেয়া সহ যাচ্ছে তাই আচরণ করে আসছে পাকিস্তান। এই অঞ্চলেও পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে চলছে অত্যাচার নিপীড়ন।

পাকিস্তান অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ১৯৭০ সালে এই দুই অঞ্চলের মানুষের ভরসা ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে উপর। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই অঞ্চলগুলোর ওপর নতুন করে চলে অত্যাচার।

পাকিস্তানের ভবিষ্যত অন্ধকার। এজন্য অবশ্যই দায়ী পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে তারা শিক্ষা নেয়নি। বাঙালিদের তারা নিম্নশ্রেণীর এবং নিকৃষ্ট জাতি ভেবেছিল।

বাঙালির অস্তিত্ব মুছে ফেলার নৃশংস চেষ্টা চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা। একইরকম ভাবে আজও পাশতুন, বেলুচ, সিন্ধুদের ওপরও চালিয়ে যাচ্ছে বর্বরতা। ভবিষ্যতে এরজন্যও চরম মূল্য দিতে হবে পাকিস্তানকে। কারণ তারা নিজেদের জাতিগত গোষ্ঠীর অধিকারের প্রতি মোটেও সংবেদনশীল নয়।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

বাঙালির অস্তিত্ব মুছে ফেলার নৃশংস চেষ্টা চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা। একইরকম ভাবে আজও পাশতুন, বেলুচ, সিন্ধুদের ওপরও চালিয়ে যাচ্ছে বর্বরতা। ভবিষ্যতে এরজন্যও চরম মূল্য দিতে হবে পাকিস্তানকে। কারণ তারা নিজেদের জাতিগত গোষ্ঠীর অধিকারের প্রতি মোটেও সংবেদনশীল নয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।