হাওরে কৃষকের কান্না কেন থামছে না?
‘বন্যার জলে ফসল নিলে কেউ কাঁদে কেউ হাসে/সুনামগঞ্জবাসী কাঁদে, পরে পূর্ণ গ্রাসে/.../চৈত্র মাসে বৃষ্টিজলে নিলো বোরো ধান/ভেবে মরি, হায় কী করি বাঁচে কি না প্রাণ?’— বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের এই এক গানেই বানের জলে হাওরের মানুষের ভোগান্তি এবং দুঃখ-কষ্ট ফুটে উঠেছে। ২০১৭ সালের পর বর্তমানে হাওর অঞ্চলের কৃষকের অবস্থা অত্যন্ত অবর্ণনীয়। চৈত্রর পর বৈশাখে যে কৃষকের চোখেমুখে আনন্দ ভাসতে থাকার কথা, থাকে ফসল ঘরে তোলার ব্যস্ততা। কিন্তু ভাগ্য এতোটাই বৈরি যে শত পরিশ্রম করেও শেষ মুহূর্তে এবার আর কৃষক আনন্দের জলে ভাসেনি। আগের মতোই এবার ভেসেছে দুঃখের জলে, সন্তানের ন্যায় যত্ন করা ফসল ডুবেছে পাহাড়ি ঢলে। একের পর এক বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে কৃষকের সোনার ধান আর মুখের হাসি। এ সবের একমাত্র কারণ বাঁধ নির্মানের দুর্নীতি, অবহেলা আর দায়িত্বশীলদের গাফিলতি।
হাওরের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্র্য থেকে হাওরের সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভিন্নতা রয়েছে। বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় পানি নিচে ডুবে থাকে জমিগুলো। নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে পানি কিছুটা কমতে শুরু করলে জলাবদ্ধতা সহ্য করেই কৃষক রোপণ করেন বোরো ধান। তারপর দু'আড়াই মাস চলে হাড়ভাঙা খাটুনি। বৈশাখের শুরুতে, আরো স্পষ্ট করে বললে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে উঠতে শুরু করে ধান। কৃষকেরা সাধারণত এই সময়ে পাকা ধান কেটে মাড়াই করেন, অতঃপর শুকিয়ে গোলায় তুলেন।
অন্যদিকে প্রায় প্রতিবছর ভারতের মেঘালয় রাজ্য ও আসামের চেরাপুঞ্জিতেও এই সময়েই প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সেই ঢলের পানি নেমে আসে ভাটির দিকে, ঢুকতে শুরু করে বাংলাদেশের সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন হাওরে। উজানের পাহাড়ি এই ঢলের পানি থাকে কয়েক মাস। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা তো এক নিমিষেই হয়ে যায়। অক্লান্ত পরিশ্রম করা ফসলের বিনষ্ট তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া করার কিছু থাকে না কৃষকের।
প্রতি বছর হাওরে বাঁধ নির্মাণের জন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয় বাঁধ নির্মাণের লক্ষ্যে। যথাসময়ে দেওয়া হয় পর্যাপ্ত বরাদ্দ। কাজও হয় চোখে পরার মতো। অথচ প্রয়োজনের সময় ঢলের চাপে ফাটল ধরে ভেঙ্গে যায় তাসের ঘরের আদলে। যেমন ২০১৭ সালের পরে এ পর্যন্ত ৫ বছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৭০ কোটি টাকা; যার একক বছর হিসেবে গেল বছরেই শুধুমাত্র সুনামগঞ্জ জেলার জন্য ১২১ কোটি টাকা ছাড় হয়েছে বাঁধ নির্মাণে। প্রশ্ন হলো— পানির চাপ পরলে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ের বাঁধ কেন ভেঙ্গে যায়? কেন অকার্যকরী হয়ে পরে দুর্যোগ মোকাবিলার সমস্ত রাস্তা! এর কারণ হাওরের প্রায় কোন বাঁধই যথাযথ নিয়ম মেনে করা হয় না। এর সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা এটাকে ব্যবসায়ে পরিণত করেছেন। তারা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন এটার জন্য। সমানে চলে সরকারি টাকার হরিলুট। ফলে বাঁধ নির্মাণের প্রতিটি ধাপেই হয় সাগর চুরির দুর্নীতি। এরপর নামকাওয়াস্তে তৈরি হয় বাঁধ। নড়বড়ে নামমাত্র সেই বাঁধ ভাঙবে না তো ভাঙ্গবে কি!
অভিযোগ আছে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠনে বড় ধরনের অনিয়ম। এমনকি সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি করা হয় না, নেওয়া হয় না প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ। আবার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও নানা জটিলতা দেখিয়ে কৃত্রিমভাবে কাজের বিলম্ব ঘটানো হয়। একদিকে বরাদ্দকৃত অর্থের লুটপাট এবং অন্যদিকে শেষ সময়ে যখন তাড়াহুড়ো করে বাঁধ নির্মাণ হয় তখন অন্তত ৩৫ ভাগের মতো মাটি বাঁধের একেবারেই কাছ থেকে তোলা হয়। নির্মাণে ব্যবহার করা হয় বালু মাটি। পরিণামে ঢলের সময় পানির চাপে দ্রুত ভেঙে পড়তে সহায়ক হয়। এমনকি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয় মাটি বসানোর কাজ ঠিকঠাক না করেই। ঝুঁকিপূর্ণ অংশে ব্যবহার করা হয় না বাঁশ, বস্তা অথবা চাটাইয়ের। টেকসই বাঁধ নির্মাণ করতে বজায় রাখা হয় না উপর্যুপরি ঢালের ব্যবস্থা।
হাওরে বাঁধ যেমন দুর্নীতিতে ফুলেফাঁপা, পাশাপাশি এটাও সত্য ঐ অঞ্চলের নদীতে নাব্যতা হ্রাস পাওয়াও দায়ী। ঢলের সাথে সাথে পাহাড়ি বালু ও পলি চলে আসে নদীগুলোতে। এ কারণে অধিকাংশ নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। কোন কোন জায়গায় এতটাই পলির আধিক্য যে সৃষ্টি হয়েছে চর। চর পরলে পানির প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ— মেঘনা নদীর ভৈরবের কাছাকাছি নাব্যতা বিঘ্নিত হওয়ায় পানি ভাটায় যাচ্ছে ধীর গতিতে।
কোন কোন এলাকায় আবার মৎসজীবী বা জলমহালদের মাছ ধরার স্বার্থে নাব্যতা সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা আছে, আছে নদী দখলের অভিযোগ। নদী দখল হবেই না কেন? পানির অভাবে সারা বছর যখন শুকনো মরুভূমি হয়ে পরে থাকে তখন আপনা-আপনি দখল হয়। তাহলে পানি নাই কেন? একটু গভীরে প্রবেশ করলেই বোঝা সম্ভব যে আমাদের নদীগুলোর বর্তমান যে হাল বিগত পঞ্চাশ বছর আগেও কি একেই অবস্থায় ছিলো কি না। এটা হয়তো বিতর্কিত বিষয়; কিন্তু অনুমান করা সম্ভব যে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি ভারতের টিপাইমুখী বাঁধ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলার উপর বহমান নদীর নাব্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নদীর তলদেশে নাব্যতাই যদি এভাবে মরে যায়, চর জাগে; তখন যতো বড় উঁচু এবং শক্তিশালী বাঁধ দেওয়া হোক না কেন পানি যাবে কই! বরং নিশ্চিত যে নদীর উপকূলীয় অঞ্চল প্লাবিত করবে। সামান্য ইঁদুরের গর্ত পেলে বাঁধ ভেঙেচুরে প্লাবিত হবে হাওর বা নিম্নাঞ্চল।
এই মৌসুমে হাওরে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৭ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। বাকি ধান জমিতেই, পানির নিচে। অথচ কৃষি বিভাগ দাবি করেছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ধান নাকি কাটা শেষ। অত্যন্ত হাস্যকর বিষয় যে কৃষি বিভাগের এই পরিসংখ্যান গায়েবি-কাল্পনিক এবং আজগুবি। এ ধরনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করার অবশ্য বিশেষ কারণও আছে। কারণটা হচ্ছে ক্ষতি যতো কম দেখানো যায়, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ততো বেশি প্রচার করা সম্ভব। একেই সঙ্গে বাঁধ নির্মাণের দুর্নীতিতে জড়িতদের প্রতি স্থানীয় কৃষকদের চাপা ক্ষোভের প্রশমিত করা। আড়াল করার চেষ্টা করা বাঁধ নির্মাণের নানা অনিয়মের।
এটা সুস্পষ্ট যে এই প্রশাসন দিয়ে হাওরের দুর্যোগ প্রশমন সম্ভব নয়। বাঁধ নির্মাণের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে গেলে দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালদের প্রথমে সরাতে হবে। দায়িত্ব দিতে হবে সৎ ব্যক্তিদের। বাঁধ নির্মাণের মাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। টেকসই বাঁধ নির্মাণের বাঁধের ভেতরে ব্যবহার করা যেতে পারে কংক্রিটের ব্লক অথবা দেয়াল। রাখতে হবে পর্যাপ্ত ঢাল এবং বনায়ন ব্যবস্থা। পরামর্শ ও সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে স্থানীয় কৃষক এবং হাওর রক্ষার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির। বাঁধের মাঝে স্লুইসগেট রাখা জরুরি।
নিয়মিত নদীর তলদেশ ড্রেজিং করার সাথে সাথে খেয়াল রাখতে হবে ফসল উঠে গেলে হাওর স্বাভাবিক করতে স্লুইসগেটগুলো ছাড়া কেউ বাঁধের ক্ষতি না করে। হাওরে খাপ খায় এমন ধানের উদ্ভাবন এবং চাষাবাদ সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বোপরি নিজেদের ক্ষতি নিজেরা না করতে হাওরের মুষ্টিমেয় দুর্নীতিবাজ লোকদের থাকা চাই নৈতিক মূল্যবোধ।
মেঘালয় ও আসামে যে বৃষ্টিপাত হয় সেই পানি সংশ্লিষ্ট ছোট-বড় নদীগুলো হয়ে হাওরে নেমে আসে। কাজেই হাওরের দুর্ভোগ ঠেকানো বা ফসল রক্ষা করা একটু কষ্টসাধ্য; কিন্তু অসম্ভব নয়। সীমান্তের ওপারে প্রতি বছর ঠিক কতটুকু বৃষ্টিপাত হয় সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রাসঙ্গিক। হাওর পাড়ের কৃষকের দুর্ভোগ লাঘব হোক।
লেখক: প্রাবন্ধিক।
এইচআর/এমএস