সড়কে যারা গাড়িঘোড়া চালায় তাদের উন্নত করতে হবে না?
তিনি এখন ফুল। ফুল মানে পুষ্প নয়; বোকাও নয়। এ ফুল হচ্ছে পূর্ণ। তিনি পূর্ণ হয়েছেন। এতদিন হাফ হয়ে থাকায় কেবলই মনে হতো, তার শরীরের অর্ধেক অংশ যেন প্যারালাইজড হয়ে আছে। অর্ধাঙ্গ অবশ থাকার গ্লানি থেকে আজ তিনি মুক্ত।
ফুলমন্ত্রী হতে পারলে সিলেটে হজরত শাহজালালের (রঃ) মাজার জিয়ারতের মানত করেছিলেন তিনি। তাই সিলেট যাওয়াটা এখন তার জন্য ফরজ। দফতরে এসে তিনি তার অতি কাছের একজনকে তলব করলেন। সেই লোক সামনে এসে দাঁড়াতেই কোনো রকম ভূমিকা না করে তিনি বললেন-
: পাটু মিয়া, সিলেট যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিছি। প্রস্তুতি সম্পন্ন কইরা আমারে জানাও।
পাটু মিয়ার পুরো নাম মিয়া মোহাম্মদ আক্কাস পাটোয়ারী। ডিজিটালাইজেসনের ছোঁয়ায় তার নামের মাথা চলে গেছে লেজের জায়গায়। আর লেজটা পেছন থেকে মাথায় প্রতিস্থাপনের সময় টিকিটিকির লেজের মতো আংশিক খসে গিয়ে তা ‘পাটু'তে এসে স্থির হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয়ের আচমকা সিলেট যাওয়ার কথা শুনে পাটু মহাফাঁপরে পড়ল। বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে আজ সন্ধ্যায় স্ত্রীকে নিয়ে ফাইভস্টার হোটেলে তার ডিনার করার কথা। সে ঢোক গিলে বলল-
: স্যার, আজকেই যাবেন!
: হুঁ। আজই যাব।
পাটুর মনে হলো, এ ধরনের জটিল পরিস্থিতি বোঝাবার জন্যই বোধহয় ‘শ্যাম রাখি, না কুল রাখি’ বাগধারাটির উদ্ভব ঘটেছে। কৃষ্ণ প্রেমের দরিয়ায় ঝাঁপ দিয়ে রাধা কূলের ভাবনা ভাবেননি। পাটুর বেলায় এরকম হওয়ার উপায় নেই। তাকে চাকরি ও বউ দুটোই রক্ষা করতে হবে। সে খুব দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। চিন্তার পালে পূবালী হাওয়া ভর করতেই একটা সমাধান সূত্র পাওয়া গেল। সমাধান সূত্রের খসড়া তৈরি শেষে সে চিন্তিত হওয়ার ভান করে বলল-
: স্যার, গাড়ি নিয়ে যাবেন?
পাটুর প্রশ্ন শুনে মন্ত্রী মজা পেলেন। বললেন-
: তুমি কি আমারে হাঁইটা যাইতে কও?
পাটু মাথা নাড়ল। বলল-
: জি না স্যার।
: তাইলে?
এক ধরনের গিরগিটি আছে, নিজের শরীরের রঙ পাল্টাতে পারে। আল্লাহপাক পাটুকে এ ক্ষমতা দেননি। তারপরও সে চেষ্টা করল, যতটা সম্ভব নিজের চেহারা মলিন করার। মলিনতার আবরণে চেহারা আচ্ছাদিত হওয়ার পর সে বলল-
: সড়ক পথে কোথাও যাওয়া ভীষণ ভয়ের ব্যাপার স্যার। লাইফ রিস্ক।
: কেন?
তৈরি করা খসড়া সমাধান সূত্র পাটুর মনের পর্দায় ভেসে উঠল। এখন এগুলো গুছিয়ে বলতে হবে, যাতে হঠাৎ আবির্ভূত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। লম্বা একটা দম ছেড়ে সে বলল-
: স্যার, দুনিয়ার যত লক্কড়-ঝক্কড় বাস জোড়াতালি দিয়া রাস্তায় নামানো হইছে। অনেক ক্ষেত্রে এইগুলার ড্রাইভার পাওয়া না গেলে গ্যারেজের পোলাপান অথবা বাস-টেম্পোর হেলপার-কন্ডাকটর ভাড়া কইরা ড্রাইভারের সিটে বসাইয়া দেওয়া হয়, যারা গরু ও ছাগল ছাড়া আর কিছু চিনে না। যেসব সড়কে গরু-ছাগলের উপদ্রব নাই, সেখানে এ ক্যাটাগরির চালকরা মনের আনন্দে হাইস্পিডে গাড়ি চালাইতে গিয়া এরে ঢুস মারে, ওরে উষ্টা মারে।
প্রতিদিন সড়কপথে সংঘটিত দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র দেখলেই এ সত্য পরিষ্কার বুঝতে পারবেন স্যার। বর্তমানে গাড়ি লইয়া সড়কে যাওয়া মানে আজরাইল (আ.) কে ইশারায় কাছে ডাকা। আজরাইল (আ.) যদি সত্যি সত্যি আপনার কান্ধে হাত রাখে, তাইলে দেশ ও জাতি যে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সেইটা কি আর কারো পক্ষে পূরণ করা সম্ভব?
পাটুর কথা শুনে মন্ত্রী খুশি হলেন। বললেন-
: আমার ব্যাপারে দেখতেছি তোমার অত্যধিক চিন্তা-ভাবনা...
পাটুর মুখে হাসি বিস্তৃত হলো। মনে হচ্ছে, মাছ টোপ গিলেছে। সে গলায় আবেগের বুদ্বুদ তুলে বলল-
: আমি হইলাম আপনের এপিএস। ছায়াসঙ্গী। আমি যদি আপনারে লইয়া না ভাবি, তাইলে কে ভাববে স্যার?
পাটুর ঢেলে দেওয়া তেলে ভিজে জবজবা হয়ে মাথা ঝাঁকানোর সময় মন্ত্রীর চোখের চশমা পিছলে গিয়ে টুপ করে টেবিলে উপর পড়ল। নাকের ডগায় চশমা প্রতিস্থাপন শেষে তিনি পাটুর মতামত জানার উদ্দেশে বললেন-
: তাইলে কি বিমানে যাব?
: বিমানে স্বল্প দূরত্বের জার্নি কইরা সুখ নাই। মনে হবে, লিফটে চইড়া দোতলা থেকে একতলায় নামলাম। এক্ষেত্রে ট্রেন হইল সবচাইতে ফ্যান্টাসস্টিক বাহন। নিরাপদ এই বাহনে সওয়ার হইয়া চা-কফি, বাদাম-চানাচুর খাইতে খাইতে, চারপাশের সিন-সিনারি দেখতে দেখতে যাওয়ার মধ্যে অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে স্যার।
কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে ডানহাতের তালু মাথার মাঝখানে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করা মন্ত্রীর পুরনো অভ্যাস। এ মুহূর্তে তিনি সেটাই করছেন। মসিবত কেটে যাওয়ার দোয়া পড়ে পাটু আস্তে করে বলল-
: স্যার, আগামীকাল সকালে সিলেট যাওয়ার একটা ট্রেন আছে। আমি কি সেই ট্রেনে আপনার যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা কইরা ফেলব?
মন্ত্রীর সম্মতি পাওয়া গেল। পাটু উচ্ছ্বসিত গলায় বলল-
: তাইলে স্যার, এখন আপনার সফরসূচি ফাইনাল কইরা ফেলি?
মন্ত্রী মাথা নাড়লেন। বললেন-
: না-না, এখন না। এখন আর টাইম নাই। ট্রেনে উইঠা ধীরে-সুস্থে বলব।
ট্রেন ছাড়ল কাঁটায়-কাঁটায়। দেশে এ ধরনের ঘটনা বিরল। রেলের উন্নতি দেখে মন্ত্রী অভিভূত হলেন। বিমানবন্দর স্টেশনে নির্ধারিত যাত্রাবিরতি শেষে ট্রেন চলতে শুরু করল। ঝিমুনিভাব আসায় মন্ত্রী ডানদিকে কাত হয়ে ঝিমুচ্ছিলেন, হঠাৎ ক্যার-ক্যার শব্দে ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়ল। মন্ত্রী সোজা হয়ে বললেন-
: কী হইল?
ট্রেনের জানালা দিয়ে যতটা সম্ভব মাথা বের করে পাটু দেখল, রেললাইনের পাশে মানুষের ভিড়। জনতার উপস্থিতি দেখে তার মনে একাধিক সম্ভাবনা উঁকি দিলেও তেলবাজির সুযোগ আছে যেটায়, সেটাকে প্রাধান্য দিয়ে সে বলল-
: স্যার, পাবলিক মনে হয় টের পাইয়া গেছে, আপনি এই ট্রেনে আছেন।
মন্ত্রী পাটুর কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি চোখ পিটপিট করে বললেন-
: আমার ট্রেনে থাকার সঙ্গে লোকজন জড়ো হওয়ার কী সম্পর্ক?
: এইটা বুঝতে স্যার সক্রেটিস হওয়ার দরকার পড়ে না। আপনি আগে হাফমন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানে ফুলমন্ত্রী হইছেন। আপনার মতো করিৎকর্মা একজন মানুষ এখন হাত-পা ছড়াইয়া কাজ করতে পারবে, এ বিষয়টা জনগণ উপলব্ধি কইরা আপনাকে শুভেচ্ছা-স্বাগতম জানানোর উদ্দেশ্যে রেললাইন বেড় দিয়া দাঁড়াইয়া পড়ছে।
মন্ত্রী পাটুর কথার মর্মবাণী বোঝার চেষ্টা করলেন। না, দুইয়ে-দুইয়ে চার মিলছে না। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-
: তোমার ধারণা সত্যি হইলে এইটা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় মুহূর্ত হইত। বিষয়টা সম্ভবত তা নয়। কিছু ধান্দাবাজ ছাড়া বাদবাকি মানুষ আজকাল মন্ত্রী-এমপি লইয়া তেমন আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখায় না। আমার জায়গায় যদি নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা কেউ থাকত, তাইলে তোমার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হইত। তুমি এক কাজ কর, ট্রেন থেকে নেমে প্রকৃত ঘটনা কী, জাইনা আসো।
ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর পাটু এসে বিরস মুখে জানাল-
: স্যার, আপনার ধারণাই সত্য। লোকজন জড়ো হওয়ার কাহিনী ভিন্ন।
: কী রকম?
: একটু আগে একটা ট্রেন সামনের রেলক্রসিংয়ে একটা অটোরিকশারে চিড়া-চ্যাপ্টা কইরা দিয়া গেছে। যাত্রীদের মধ্যে আটজন সঙ্গে সঙ্গে শেষ।
: পুলিশ আসে নাই?
: আসছে। তারা কাজ শুরু করছে।
মন্ত্রী পাটুকে সড়কপথ মন্ত্রীর ফোনে সংযোগ দিতে বললেন। ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়ার পর তিনি হেসে বললেন-
: কী ভাই, খালি সড়কপথ চারলেন-ছয়লেনে উন্নত করলেই চলবে? সড়কে যারা গাড়িঘোড়া চালায়, তাদের উন্নত করতে হবে না?
: ভাই, এই কথা বলতেছেন কেন!
: আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন।
: উত্তর আমারও জানা, আপনেরও জানা। উন্নত করার উদ্দেশ্যে টাইট দিতে গেলেই আমাদের জাতভাইয়েরা নাখোশ হন। বেড়া যদি খেত খায়, তাইলে আপনি সেই খেত কেমনে রক্ষা করবেন? এখন বলেন, ঘটনা কী? হঠাৎ আপনার মনে এই প্রশ্নের উদয় হইল কেন?
: ট্রেনে চইড়া সিলেট যাইতেছি। একটু আগে এখানকার একটা রেলক্রসিংয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে।
: রেলক্রসিং? ভাই, এইটা তো রেলমন্ত্রীর কেস...
প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে গেল ট্রেনের গতি ফিরে পেতে। কুলাউড়া স্টেশনে ট্রেন থামার পর মন্ত্রী টয়লেটে ঢুকলেন। এ সময় হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছাড়ল। ট্রেন কিছু দূর সামনে অগ্রসর হয়েই হঠাৎ পেছনের দিকে চলতে শুরু করল। মন্ত্রী ভয় পেয়ে টয়লেট থেকে ছিটকে বের হয়ে এসে পাটুকে জিজ্ঞেস করলেন-
: ঘটনা কী? ট্রেনের উপর ভূতের আছর হইল নাকি?
: বুঝতেছি না স্যার! অনেকেই ভয় পাইয়া লাফালাফি শুরু কইরা দিছে।
: আমি কী করব, সেইটা কও! লাফ দিব?
: আপনের মনে হয় লাফ দেওয়াটা ঠিক হবে না। পাবলিকের ব্যাপার আলাদা; কিন্তু একজন মন্ত্রী প্রাণ বাঁচাইতে ট্রেন থেইকা লাফ দিছে, এইটা জানাজানি হইলে সরকারের প্রেস্টিজ কানা হয়ে যাবে।
: আমিই যদি না বাঁচি, সরকার দিয়া কী করব। ধুইয়া পানি খাব?
: স্যার, ধৈর্য ধরেন...
আট-দশ মিনিট পর ধৈর্যের ফল মিলল। ট্রেনটা কোঁকাতে-কোঁকাতে ব্রেক কষল। মন্ত্রী কপালের ঘাম মুছে পাটুকে রেলমন্ত্রীর নম্বরে ফোন করতে বললেন। রেলমন্ত্রীর গলার স্বর ভেসে আসতেই মন্ত্রী বললেন-
: কী রে ভাই! আপনার ট্রেন নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গাধার মতো পিছনের দিকে চলে কেন?
: ভাই, হোজ্জা কে!
: হোজ্জারে চিনেন না?
: সারাক্ষণ রাজনীতি লইয়া ব্যস্ত থাকতে হয়। নিরিবিলি জ্ঞানচর্চা করব, সেই সুযোগ কোথায়? কিছু মনে না করলে হোজ্জার সঙ্গে পরিচয়টা আপনেই ঘটাইয়া দেন, সমৃদ্ধ হই।
: আপনাকে সমৃদ্ধ করার পরিবেশে আমি এখন নাই। ট্রেনে সিলেট যাইতেছি; কুলউড়া স্টেশন থেইকা ট্রেন ছাড়ার পর কয়েক কদম আগাইয়াই হঠাৎ পিছন দিকে ছুট মারছে।
: অঃ, এই ঘটনা! বিচলিত হওয়ার কিছু নাই ভাই। এইটা হইল কৌশলগত পশ্চাদপসারণ। আমাদের রেল নবযুগে প্রবেশ করতেছে তো! নবযুগে প্রবেশের আগে ঠিক কতটা পিছাইয়া যাইয়া যাত্রা শুরু করা দরকার, ট্রেন নিজ থেকেই সেটা পরিমাপ করা শুরু করছে। সিলেট লাইনে এর আগেও একাধিকবার এই ধরনের পরিমাপ করার ঘটনা ঘটছে।
সিলেট পৌঁছে মন্ত্রী প্রথমে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহ পরানের (রহ.) মাজার জিয়ারত করলেন। এরপর স্থানীয় একটা সমাবেশে উপস্থিত জনতার সামনে অনেক শক্ত-শক্ত কথা বললেন। এ সময় একজন সাংবাদিক তাকে বলল-
: এক্সকিউজ মি স্যার, আমরা কি একজন মন্ত্রীর কথা শুনছি; না তোতাপাখির কণ্ঠস্বর শুনছি?
সাংবাদিকের প্রশ্নে মন্ত্রী বিরক্ত হলেন। বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করার উপায় নেই। সাংবাদিকরা হচ্ছে এমন এক প্রজাতি, যাদের ছাড়াও যায় না, আবার ধরাও যায় না। মন্ত্রী বিরক্তি হজম করে মৃদু হেসে বললেন-
: আপনার এ রকম মনে হইতেছে কেন ভাই!
: মনে হইতেছে; কারণ, প্রতিটা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর আপনি একই স্টাইলে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এসব কথার কোনো ফলাফল পাওয়া গেছে বলে আমরা শুনিনি।
লেখক: সাংবাদিক. রম্যলেখক।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস