ঢাকার রাস্তা দেখে আমাদেরও লজ্জা লাগে

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:২৩ এএম, ১১ এপ্রিল ২০২২

কয়েকদিন আগে এটিএন নিউজের এক টক শো’তে রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন প্রতিদিন রাজধানীর রাস্তায় নতুন নতুন গাড়ি নামা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। আমি মজা করে তাকে বলেছিলাম, মানুষ নতুন নতুন গাড়ি কিনছে, তাতে বুঝি আপনার হিংসা হচ্ছে। হাসতে হাসতে মোবাশ্বের ভাই বলেছিলেন, হিংসা নয়, আমার ভয় হয়। আসলেই ঢাকার রাস্তার অবস্থা যা হচ্ছে, তাতে নতুন গাড়ি কেনাটা আনন্দের নয়, আতঙ্কেরই হবে। গাড়ি তো আপনি কিনবেন চলাচলের জন্য। কিন্তু ঢাকায় এখন আর চলাচলের উপায় নেই।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সে অনুষ্ঠান দেখেছিলেন কি না জানি না। কিন্তু আমি মোবাশ্বের ভাইয়ের সাথে যে মজাটা করেছিলাম, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সে মজাটা করেছেন গোটা জাতির সাথে। যানজট নিয়ে বিএনপি সাংসদ হারুনুর রশিদের সমালোচনার জবাবে তিনি সংসদে বলেছেন, ‘মানুষের জীবনমানের উন্নতি হওয়ার কারণেই সড়কে যানজট বাড়ছে। আওয়ামী লীগ আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে উপজেলা পর্যায়েও যানজট হবে।’

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের বক্তব্য শুনে রীতিমতো ভয় পেয়েছি। এমনিতেই এখন ঢাকা স্থবির। আওয়ামী লীগ আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে যদি গোটা দেশই অচল হয়ে যায়, তাহলে তো মানুষ চাইবে না আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক। শুধু গাড়ি বাড়াকে যদি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী উন্নয়নের সূচক মনে করেন, তাহলে মানতে হবে উন্নয়ন সম্পর্কে তার ভালো ধারণা নেই। উন্নয়ন মানে অগ্রগতি, কিন্তু যানজট মানে তো স্থবিরতা।

উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো যানজট। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিইটের গবেষণা বলছে, এখন যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে বছর শেষে যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতি হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ কেমন উন্নয়ন মাননীয় মন্ত্রী?

 

বিশ্বের উন্নত সব দেশেই অনেক গাড়ি আছে। কিন্তু তাদের রাস্তা তো এমন অচল নয়। উন্নয়নের সাথে যানজটের কোনো সম্পর্ক নেই, বিরোধও নেই। যানজটকে উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। পরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই কৃতিত্ব। রাস্তায় নতুন নতুন গাড়ি নামানোর আগে রাস্তা বাগাতে হবে, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, মানুষকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে, হাঁটার জন্য ফুটপাত রাখতে হবে।

অন্য কিছু না করে খালি গাড়ির সংখ্যা দিয়ে উন্নয়ন মাপলে হবে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘ঢাকার মতিঝিলে আমার অফিস ছিল। গুলশানে আসতাম, ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগতো। এখন আমার অনেক বেশি সময় লাগে। কেন লাগে, কারণ আমাদের আয় অনেক বাড়ছে। ৩০০ থেকে ৪০০ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশ থেকে ২ হাজার ৫৯১ ডলার মাথাপিছু ডলারের দেশ। এখন সবাই গাড়ি কিনছেন।’

মন্ত্রীর চোখে উন্নয়নের রঙিন চশমা আছে বলে তিনি আসল সমস্যাটা দেখতে পাননি। মন্ত্রী তো বরাবরই ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাফেরা করেন, তাই গণপরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। ঢাকায় সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য বাস-মিনিবাস বাড়ছে না, বাড়ছে শুধু ব্যক্তিগত ছোট যান।

এগুলো জায়গা দখল করলেও মানুষ পরিবহন করে কম। তাই ছোট গাড়ি যত বাড়বে, পাল্লা দিয়ে যানজটও বাড়বে। মিরপুরের একজন মানুষকে মতিঝিলে অফিস করতে রাস্তায় কাটাতে হয় পাঁচ ঘণ্টা। এটা কখনোই একটা উন্নত দেশের রাজধানীর চিত্র হতে পারে না।

রাজধানীতে এখন মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে, পরিকল্পনা হচ্ছে পাতাল রেলের। কিন্তু যেভাবে গাড়ি বাড়ছে, আর যানজট বাড়ছে; তাতে কোনোকিছু করেই এই শহরকে সচল রাখা যাবে না। পরিকল্পিত গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে এই শহর শিগগির মৃত শহরে পরিণত হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর পূর্বাভাস সত্যি হলে শুধু ঢাকা নয়, গোটা বাংলাদেশই একদিন অচল হয়ে যাবে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তো উন্নয়নের কথা বলেছেন। কিন্তু সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কদিন আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ঢাকা শহরের অবস্থা দেখে খারাপ লাগে, লজ্জাও লাগে।‘ রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থা দেখেই সড়ক পরিবহণ মন্ত্রীর এই লজ্জা।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রী মনে করেন, বর্তমানে দেশ যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হচ্ছে তার সঙ্গে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা মানানসই নয়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর ১১টি দেশের তালিকায় রয়েছে। সেই বাংলাদেশের সঙ্গে এটা মানায় না।

শহরের বাসগুলো ভালো করতে অনেক চেষ্টা করেছি। রংচং করে বাস বের করে, ফিটনেস নেই। এই ছবির পরিবর্তন করতে হবে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়নকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তার সঙ্গে তুলনা হয় না। সেটার সঙ্গে মেলে না।

কিন্তু টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা একটি সরকারের সড়ক পরিবহন মন্ত্রী যদি লজ্জার কথা বলেন, তাহলে মানুষ যাবেটা কোথায়? কার কাছে প্রতিকার চাইবে? আপনারা পদ্মা সেতু করছেন, মেট্রোরেল করছেন, টানেল করছেন; তাহলে ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থা বদলাতে পারছেন না কেন?

টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থেকে যদি আপনারা পরিস্থিতি বদলাতে না পারেন, তাহলে আর কবে পারবেন? গণপরিবহন ব্যবস্থা বদলাতে না পারা তো সড়ক পরিবহন মন্ত্রীর ব্যর্থতা। নিছক লজ্জা লাগে বললে তো পরিবহন ব্যবস্থা বদলে যাবে না। বাংলাদেশের এখন যা অবস্থা তাতে অর্থের জন্য কিছু আটকে থাকছে না। বিরোধী দলের হরতালের কারণে কাজ করতে পারছেন না, এমন অজুহাত দেওয়ারও সুযোগ নেই।

আপনারা এখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারছেন। খালি রাস্তাটা সচল করতে পারছেন না, পরিবহন ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে পারছেন না। ১৩ বছরে যেহেতু পারেননি, তার মানে আপনারা পারবেনও না। বরং স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরে যানজট উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে যাবে, আর সড়ক পরিবহন মন্ত্রীর লজ্জা আরও বাড়বে।

রাস্তার অবস্থা দেখে আমাদের ভয় হয়। আর মন্ত্রীদের বক্তব্য শুনলে আমাদেরই লজ্জা হয়।

১০ এপ্রিল, ২০২২

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থেকে যদি আপনারা পরিস্থিতি বদলাতে না পারেন, তাহলে আর কবে পারবেন? গণপরিবহন ব্যবস্থা বদলাতে না পারা তো সড়ক পরিবহন মন্ত্রীর ব্যর্থতা। নিছক লজ্জা লাগে বললে তো পরিবহন ব্যবস্থা বদলে যাবে না। বাংলাদেশের এখন যা অবস্থা তাতে অর্থের জন্য কিছু আটকে থাকছে না। বিরোধী দলের হরতালের কারণে কাজ করতে পারছেন না, এমন অজুহাত দেওয়ারও সুযোগ নেই।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।