কোন পথে শ্রীলঙ্কা?
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর এগিয়ে যাচ্ছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে জাতিগত বিদ্বেষ বাড়ছিল। যদিও তা সংঘাতের দিকে যায়নি। তামিল আর সিংহলীদের পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরোধ চলছিল। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় নজিরবিহীন বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগ দাবি করছে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট দেশটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ সংকট মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
২০১৯ সালে যে জনতা গোতাবায়াকে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় এনেছিল,সেই মানুষগুলোই এখন ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমেছে। তাদের স্লোগান এখন ‘গোতা বাড়ি যাও’। এ অবস্থায় জনগণকে শান্ত করতে পুরো মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেছে। কিন্তু গোতা ও তাঁর ভাই সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে এখনো নিজ নিজ পদ আঁকড়ে আছেন। তাই সরকারের জারি করা জরুরি অবস্থা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশের বেশির ভাগ অংশে বিক্ষোভ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। দিন যত যাচ্ছে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।
অবাক বিষয় হচ্ছে, অর্থনীতির দুর্দশায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভে সারা দেয়নি তামিলরা। লংকার তামিল সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পূর্বাঞ্চল তুলনামূলকভাবে শান্ত রয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তামিল জনগোষ্ঠীর এই অঞ্চলটি অব্যাহত বিক্ষোভ করেছে। তামিলরাও নিঃসন্দেহে রাজাপক্ষেদের চলে যাওয়া চায়। এই শাসক পরিবার এবং সামগ্রিকভাবে শ্রীলঙ্কান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ অনেক গুরুতর। এরপরও এই শাসক পরিবারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে যোগ দেওয়া নিয়ে তারা দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ খুঁজলে
দেখা যায়, রাজাপক্ষেদের নিয়ে সিংহলিদের মধ্যে হতাশা তামিলরা আগেও দেখেছে এবং পরে কেটে যেতেও দেখেছে। এ ছাড়া তামিলদের অনেকেই বেদনাদায়ক এক অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়ায় এবং সে কারণেই তারা জানে যে তাদের জন্য রাস্তায় বেরিয়ে আসার ঝুঁকি সিংহলিদের চেয়ে অনেক বেশি বেদনাদায়ক হবে। তাই মৃত্যুর মুখে তারা আর যেতে চায়না।
আন্তর্জাতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার সংকটের শেষ নেই বলেই মনে হচ্ছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে গত কয়েক দশকে ছোট দ্বীপটি তামিলদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞ, বামপন্থী বিদ্রোহ, তামিল স্বাধীনতা আন্দোলন, গণহত্যা, মুসলিমবিরোধী সহিংসতা, অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা এবং অবিরাম অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটও কয়েক দশক ধরে একের পর এক সরকারগুলোর অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত পরিণতি। এই সংকট দেশটির সব সম্প্রদায়কেই কঠিনভাবে আঘাত করেছে। জ্বালানি ঘাটতি, বিদ্যুৎবিভ্রাট এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। দ্বীপজুড়েই লোকজনকে যানবাহনের জ্বালানি ও রান্নার গ্যাস কেনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়। কাগজের অভাবে স্কুলগুলোর পরীক্ষা বাতিল হয়েছে এবং কিছু সংবাদপত্র মুদ্রণ বন্ধ করে দিয়েছে। হাসপাতালগুলো অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ ছাড়া চলছে এবং অনেক অস্ত্রোপচার বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
রাজাপক্ষের শাসনামলে স্বজনপ্রীতি একটি প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। দেখা গেছে, রাজাপক্ষে পরিবারই সরকারের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিল। প্রেসিডেন্টের ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি ভেঙে যাওয়া মন্ত্রিসভায় আরো দুই ভাই বাসিল ও চামাল এবং প্রধানমন্ত্রীর ছেলে নামালও মন্ত্রী ছিলেন।
পরিবারটি লংকার জাতীয় বাজেটের ২৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারা ৯টি মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করে এবং মন্ত্রিসভার ৩০টি পদের মধ্যে সাতটিই তাদের হাতে ছিল। রাজাপক্ষে ও তাঁদের আত্মীয়দের জীবন যাপন হচ্ছে প্রাচুর্যে ভরা। সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলোর বদৌলতে প্রায়ই তাঁদের নিত্যনতুন গাড়িতে এবং বিলাসবহুল ছুটি কাটাতে দেখা গেছে। এসব বিষয় তাঁদের সাবেক সমর্থক সিংহলি সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার লোকজনের মধ্যে ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে দিনে দিনে।
নিজেদের প্রধান নির্বাচনী এলাকা থেকে রাজাপক্ষে পরিবারের চাপের মুখে পড়া এবারই প্রথম নয়। ২০১৫ সালে মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্টের পদ হারান তাঁর সাবেক মিত্র ও বিরোধী দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত তথাকথিত ‘সুশাসন’ জোটের কাছে। তবে সুশাসন জোটের সরকার খুব বেশি দিন টেকেনি।
মূলত পাশ্চাত্য গোষ্ঠী এবং কলম্বোকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা উৎসাহী নাগরিক সমাজের অতিউৎসাহী সহায়তায় তারা ক্ষমতায় এলেও তারা প্রতিশ্রুত সংস্কারগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। পরে ২০১৯ সালের ইস্টার বোমা হামলার সময় অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ছাড়াও দুর্নীতি ও অভ্যন্তরীণ বিরোধে কথিত সুশাসন জোট দুর্বল হয়ে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে রাজাপক্ষে পরিবার প্রত্যাবর্তনের ভিত্তি স্থাপন করে। শুরু হয় তাদের একক আধিপত্য।
২০১৯ সালের নির্বাচনে গোতা একটি কট্টরপন্থী সিংহলি জাতীয়তাবাদী প্ল্যাটফরমে উঠে সিংহলি ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করেন। তিনি নির্বাচনের আগে বোমা হামলাকে উগ্র জাতীয়তাবাদী বাণিজ্যের সুযোগ হিসেবে নেন। এর ফলে ওই হামলা দেশের কিছু অংশে মুসলিমবিরোধী সহিংসতার সূত্রপাত ঘটায়। ২০২০ সালে রাজাপক্ষে তাঁর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা জোরদার করেন, সংসদকে দুর্বল করেন এবং দেশকে আরো স্বৈরাচারী পন্থায় নিয়ে যান। তিনি ন্যায়বিচারের জন্য তামিল ও আন্তর্জাতিক দাবি প্রত্যাখ্যান করেননি, যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দেন এবং এমন একটি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেন, যা তাঁকে সংসদের নজরদারি ছাড়াই দেশ শাসনের সুযোগ দেয়।
ঠিক এই সময়টাতে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যেভাবে গৃহযুদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণবাদী নীতির ফলে অকার্যকর হয়ে পড়ছিল, সেটা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। ২০১৯ সালে তাঁর নির্বাচনের পর থেকে রাজাপক্ষে শুধু একের পর এক অপরিণত নীতি গ্রহণ করে অর্থনৈতিক পতনকে ত্বরান্বিত করেছেন। এর মধ্যে কর হ্রাস ও রাসায়নিক সারের ওপর নিষেধাজ্ঞা অন্যতম। একদিকে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি রপ্তানির অনুপাতে অনেক বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে, অন্যদিকে ফুলেফেঁপে উঠে সরকারি খাত। সর্বশেষ পর্যটনশিল্প ও বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহের ওপর করোনা মহামারির প্রভাব এবং পূর্ব ইউরোপে চলমান যুদ্ধ দেশটির অর্থনীতির পতনকে দ্রুততর করে।
সিংহলি জনগোষ্ঠীর জন্য যা নতুন, সেটাই চার দশক ধরে বারবার সয়ে আসছে তামিল জনগোষ্ঠীর লোকজন। কারসাজি করা অর্থনৈতিক দুর্ভোগ ছিল শ্রীলঙ্কান রাষ্ট্রের যুদ্ধকালীন কৌশলের অংশ। যুদ্ধের সময় তামিল অঞ্চলের একটি বড় অংশ কঠোর নিষেধাজ্ঞার অধীনে ছিল, জ্বালানি, ওষুধ, মিষ্টি এবং এমনকি বৈদ্যুতিক খেলনার ওপরও সরকারি বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিল। সুতরাং বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট যখন দ্বীপজুড়ে মানুষের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠেছে, তখন তামিল জনগণের জন্য এটা অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। এর মধ্যে উত্তর-পূর্ব এলাকার লোকেরা দ্রুত কেরোসিনের বাতি ও সাইকেলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কারণ এটা তারা দীর্ঘ যুদ্ধের সময় করেছিল।
গোতা যখন প্রতিরক্ষাসচিব ছিলেন, তখন শ্রীলঙ্কার সেনারা তামিল যোদ্ধাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল, বন্দি মহিলা যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা ঘটিয়েছিল এবং খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়ানো বেসামরিক লোকদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। এই কাজগুলো তামিল মানসিকতার ওপর একটি অমোচনীয় ছাপ রেখে গেছে। তাই তামিলদের জন্য ‘গোতা বাড়ি যাও’ স্লোগানটি যথেষ্ট নয়। তারা তাঁকে শুধু বাড়ি পাঠাতে চায় না, তারা চায় তিনি যেন হেগে যান, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচারের মুখোমুখি হোন।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস