রমজানে পরিশুদ্ধ হোক অন্তরাত্মা
আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে রোজা পালন শুরু হলো। রহমত, মাগফেরাত আর নাজাতের সওগাত নিয়ে শুরু হয় রমজান। নিজেকে পরিশুদ্ধ করে পবিত্র করার বিশেষ এক মাস রমজান। সিয়াম সাধনার এক কঠিন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে নিজেকে আবারও পরিশুদ্ধ করার এ শুভ যাত্রায় বিশ্ব মুসিলম উম্মাহকে জানাই মাহে রমজানের শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ।
বিশ্বময় মহামারির এ সময়ে যাদেরকে আল্লাহতায়ালা সুস্থ রেখেছেন তাদের উচিত হবে আল্লাহর দরবারে বেশি বেশি শুকরিয়া আদায় করা। মাহে রমজানের কোন অজুহাত না দেখিয়ে রোজা রাখা এবং রাতগুলোকে বিশেষ ইবাদতে রত থেকে অতিবাহিত করা। মুমিন বান্দারা পবিত্র এই মাসটির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে। তারা শুধু ভাবে কবে থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। রমজান মাসের জন্য শাবান মাস থেকেই তারা নিজেকে বিশেষভাবে প্রস্তুত করে তোলে।
একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। রমজান আসার আগেই যেন বাজারে আগুন লেগে যায়। কিন্তু পবিত্র রমজানের দিনগুলো ইবাদতে রত থেকে অতিবাহিত করার চিন্তা অনেকেরই থাকে তবে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। দেখা যায় রমজান শুরু হওয়ার ক’দিন পূর্ব থেকে দ্রব্যমূল্যের দাম এত বেড়ে যায় যে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।
রোজার মাস এলেই দেখা যায়, ইফতার সমাগ্রীসহ বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজীয় দ্রব্যের দাম আচমকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ রমজান মাস ছাড়া বছরের অন্যান্য মাসগুলোতে এ সকল খাদ্য দ্রব্যের দাম অনেকটা সহনীয় পর্যায় কিংবা মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই থাকে। ব্যতিক্রম ঘটে কেবল রমজান মাসে। অধিক মুনফালোভীরা তাদের গুদামে রমজান মাসের নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য দ্রব্য অবৈধ, অনৈতিকভাবে মওজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতেও দেখা যায়। যদিও এদের সংখ্যা কম কিন্তু বাজার ব্যবস্থাকে এই কম সংখ্যক লোকই নিয়ন্ত্রণ করছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য অন্যতম সম্মানজনক কাজ। কিন্তু অবৈধ মজুদদারির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা এটি নিষেধ। মহানবী (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাজারে পণ্যের অভাবের সময় পণ্য মজুদ করে রাখে সে বড় পাপী’ (মুসলিম)। পণ্যসামগ্রী মজুদ করে দাম বৃদ্ধি অথবা অধিক মুনাফা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদিস শরিফে মজুদদারকে নিকৃষ্ট, অভিশপ্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর মজুদদার হয় অভিশপ্ত।’ আরো বলা হয়েছে, ‘বিভ্রান্ত লোকই শুধু মজুদদারী করে’ (ইবনে মাজা)। একটু ভেবে দেখেছেন কি? কত ভয়াবহ বিষয়। মহানবি (সা.) মজুদদারকে অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে এ কাজ থেকে মুক্ত রাখুন। বাজারে যারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারের উচিত হবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এবার আসছি মাহে রমজানে ইবাদতের গুরুত্ব প্রসঙ্গে। হাদিসে পবিত্র মাহে রমজানের রোজা রাখার গুরুত্বের ওপর বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে। যেমন হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবি (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিশ্বাস এবং আন্তরিকতা আর উত্তম ফল লাভের বাসনায় রমজান মাসে রোজা রাখে, তার পূর্বের সর্বপ্রকার পাপ ক্ষমা করা হবে’ (বুখারি, মুসলিম)।
পবিত্র রমজানের দিনগুলোতে আমাদেরকে অনেক বেশি কুরআন পড়তে হবে এবং এর মর্মার্থ বুঝতে হবে। কেননা রমজান কুরআন নাজিলের মাস। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন: রমজান মাস-ই হল সেই মাস; যাতে নাজিল করা হয়েছে কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)
রমজান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়। রমজানের সম্মানে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এ মাসর বরকত লাভে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। হাদিসে এসেছে-হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন রমজান আসে তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের আবদ্ধ করে রাখা হয়।’ (বুখারি, মুসলিম)
রোজা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। রোজার প্রতিদান আল্লাহতায়ালা নিজে দিবেন বলেন ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বান্দার সব আমল তার নিজের জন্য; কিন্তু শুধু রোজা আমার জন্য। আর রোজা যেহেতু আমার জন্য, তাই আমি নিজ হাতেই এর প্রতিদান দেব।’ (বুখারি) মহানবি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখে এবং নেকি অর্জনের নিয়তে রোজা রাখে, আল্লাহ তার সব গোনাহ মাফ করে দেন।’ (বুখারি)
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর পথে যে ব্যক্তি রোজাব্রত পালন করে, আল্লাহ তার মুখমণ্ডলকে জাহান্নামের আগুন থেকে সাত বছরের দূরত্বে নিয়ে যাবে। (বুখারি, মুসলিম)
শুধু রোজা রাখলেই কি রমজান মাসের সার্থকতা? না, এটি মোটেও ঠিক না। রোজাও রাখতে হবে এবং বেশি বেশি নফল ইবাদতও করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে রমজান মাসের রোজা কেবল এতটুকুই না যে, নির্দিষ্ট সময় খানা-পিনা থেকে বিরত থাকলেই আমরা সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবো। বরং তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে প্রকৃত অর্থে রোজাও রাখতে হবে আর বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে রত হতে হবে। সেই সাথে সব ধরনের মন্দ কাজ পরিত্যাগ করে বছরজুড়ে পুণ্যের ওপর জীবন পরিচালনা করতে হবে।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে সুস্থ্যতার সাথে এবং তার ইবাদতে রত থেকে পবিত্র মাহে রমজানের দিনগুলো অতিবাহিত করার তৌফিক দান করুন।
এইচআর/জেআইএম