আমরা আরও কঠিন শব্দের মধ্যে বসবাস করতেছি...

মোকাম্মেল হোসেন
মোকাম্মেল হোসেন মোকাম্মেল হোসেন , সাংবাদিক, রম্যলেখক
প্রকাশিত: ১০:১৫ এএম, ০১ এপ্রিল ২০২২

বানরের জ্ঞানবুদ্ধি যে এত কম, বাঘের জানা ছিল না। সে খুব অবাক হলো। এ রকম গাধা টাইপের একটা প্রাণি চালাক-চতুর হিসেবে খ্যাতি পেল কীভাবে, রয়েল বেঙ্গলের মাথায় ঢুকছে না! সে হুংকার দিয়ে বলল-

: ওই বান্দর! ক্যাচ-ক্যাচ করতেছস কোন কামে?
বাঘের ধমক খেয়ে বানর জিহ্বায় কামড় দিল। সুন্দরবনকে উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা করে বনের সর্দার সভা আহ্বান করেছেন। মেজবান হয়ে বাঘু মামা হরিণকে আক্রমণ করবেন না- এ সহজ জিনিসটা তার মাথায় কেন এলো না? কী লজ্জার কথা! সে হরিণকে এদিকে আসতে দেখেই সতর্কতামূলক ডাক দিয়ে ফেলেছে। বানর কানে চিমটি কেটে বাঘের উদ্দেশে বলল-
: স্যরি বস! ভুল অইয়া গেছে।
বানরের ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি দেখে সমবেত পশু-পাখি হেসে উঠতেই বাঘ গম্ভীর গলায় বলল-

: খামোশ! রঙ্গ-তামাশার টাইম এইটা না। আমরা একটা কঠিন সমস্যার মধ্যে আছি। চিৎ অইয়া পড়া জাহাজের তেলে নদীর পানি সয়লাব অইয়া গেছে। এখন এই সমস্যা থেইকা মুক্তির পথ খোঁজাই সবার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বাঘের কথা শেষ হতে না হতেই মেজাজ গরম করে কাক বলল-
: সমস্যা যারা তৈরি করেছে, তাদের বলেন সমাধান করতে।
কাকের কথা শুনে বাঘ আক্ষেপের সুরে বলল-

: তারা সমাধানের পথে হাঁটলে কুনু কথাই আছিল না; কিন্তু তারা তো সমাধানের পথে না হাঁইটা কেবল উল্টাপাল্টা কথা বলতেছে!
সাপ একটা কেওড়া গাছের গোড়ায় কুণ্ডলী পাকিয়ে বসেছিল। বাঘের সঙ্গে একমত পোষণ করে সে বলল-

: জনাব, আপনি হাছা কথা কইছেন। আমি সবচাইতে বেশি আশ্চর্য হইছি এই সেক্টরের মন্ত্রীর কথা শুইনা। তিনি আমার বংশের একজনের মরহুম হওয়া ছাড়া সুন্দরবনে আর কুনু সমস্যা দেখেন নাই! জ্ঞানের অভাবে তিনি এই ধরনের কথা বলেছেন, এইটা আমি মনে করি না। আমার মনে হয়, এইটা তার বোঝার ভুল। তার ভুল ধারণা ভাঙ্গাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।

বাঘ মাথা নেড়ে জানতে চাইল-
: কীভাবে?
: চলেন, তার সঙ্গে সাক্ষাৎ কইরা সমস্যার আগাগোড়া তারে জানাই।
: খাইছে আমারে! বনের মধ্যে থাইকাই মানুষের চোট কুলাইতে পারি না। বাইরে গেলে রক্ষা আছে? বাইর হওয়া মাত্র তোমারে পিটাইয়া মারবে। আমারে পাইলে প্রথমে আমার ছাল তুইলা নিবে। তারপর আমার চর্বি দিয়া মঘাই কবিরাজরা বিশেষ অঙ্গের মেসেজ অয়েল এবং কলিজা ও গুর্দা দিয়া রতিশক্তিবর্ধক বটিকা বানাবে।
এসময় কাক বলল-

: সুন্দরবনে হিজরত করার আগে আমি ঢাকা শহরের বাসিন্দা ছিলাম। ওইখানকার রাস্তাঘাট সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা আছে। আমি যাই?
বাঘ রাজি হলো না। বলল-
: তোমার গলার স্বর কর্কশ। মেজাজও গরম। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় মন্ত্রীর কথাবার্তা শুইনা বুঝতে পারছি, তিনিও গরম মেজাজের লোক। গরমে-গরমে ঠোকাঠুকি হইলে ঠাণ্ডা লাগলে বিপদ হবে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে পইড়া যাবা। গরমে-গরমে সাক্ষাৎ না হওয়াই উত্তম।

বাঘ এসময় বুলবুলির নাম প্রস্তাব করতেই বুলবুলি লাজুক ভঙ্গিতে বলল-
: মান্যবর! আমি মানুষের ভাষা বুঝতে অক্ষম। মানুষও আমার ভাষা বুঝতে পারবে না। আমি গেলে কোনো লাভ হবে?
পাশ থেকে একটা মৌমাছি গুনগুন সুরে বাঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে উঠল-
: মামা! আমি মৌরানী ইসেকার অধীনে শ্রমিকের কাজ করার সময় একবার এক কৃষকের বাড়ির আঙিনায় মৌচাক গইড়া তোলা হইছিল। তখন আমি মানুষের ভাষা আয়ত্ত করেছি। আপনার অনুমতি পাইলে আমি বুলবুলি আপার দোভাষী হিসেবে কাজ করতে পারি।
বাঘের অনুমতি পাওয়া গেল। ঢাকার আকাশে পৌঁছার পর বুলবুলি অবাক হয়ে বলে উঠল-

: হায় আল্লাহ! এত পিঁপড়া সারিবদ্ধ হইয়া কই যাইতেছে?
মৌমাছি চরকির মতো চক্কর দিয়ে নিচে নেমে এক পলক দেখেই উপরে গিয়ে বলল-
: বুলি আপা! এইগুলা পিঁপড়া না; মানুষ।
: এত মানুষ? মনে হইতেছে, আমরা মানুষের জঙ্গলে প্রবেশ করছি!
উড়তে উড়তে বুলবুলি হঠাৎ বলে উঠল-
: বিষয়টা রহস্যজনক।
: কী!
: ঢাকা শহরের নোংরা-আবর্জনার মধ্যে এত খাবার রাইখা কাউয়ারা সুন্দরবনে ভিড় করেছে কীজন্য?

কিছুক্ষণ বাদেই রহস্য উদঘাটিত হলো। তৃষ্ণার্ত বুলবুলি একটা জলের ধারা থেকে তৃষ্ণা নিবারণ করতে না করতেই তার পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে গেল। এ ঘটনার পর বুলবুলি বলল-
: এইবার বুঝতে পারছি, কলেরায় মরার ভয়েই কাউয়ারা ঢাকা শহর ছাইড়া সুন্দরবনে ভিড় করতেছে।
পাতলা পায়খানার একটা ভেষজ ওষুধ তৈরি করে বুলবুলির মুখে ঢেলে দিতে দিতে মৌমাছি বলল-
: কথা না বইলা চুপচাপ কিছুক্ষণ রেস্ট নেও। তাড়াতাড়ি সুস্থ হইয়া কাজ শেষ কইরা যত দ্রুত সম্ভব এই শহর ছাইড়া পালাইতে হবে।
নির্ধারিত মন্ত্রণালয়ে পৌঁছার পর তারা শুনল, মন্ত্রী নেই। একজনকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে বলল-

: মন্ত্রী মহোদয় সড়ক পরিবহন সেক্টরের লোকজনের সঙ্গে মিটিং করতে বাইরে গেছেন।
বুলবুলি অবাক হয়ে বলল-
: নৌপরিবহনের লোক হইয়া সড়ক পরিবহনের লোকজনের সঙ্গে মিটিং করতেছেন কীজন্য?
লোকটা হেসে বলল-
: নৌপরিবহন সেক্টরের মন্ত্রী হইলেও তিনি হইলেন সড়ক পরিবহন সেক্টরের মা-বাপ। কিছুদিন পরে এই সেক্টরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মন্ত্রী মহোদয়ের দম ফেলারও ফুসরত নাই।

বুলবুলি হতাশার সুরে বলল-
: এখন উপায়?
লোকটি তাদের পরামর্শ দিল-
: মন্ত্রী নাই, তাতে কী হইছে? মন্ত্রণালয়ে উচ্চচপদস্থ কর্মকর্তারা আছেন। আপনেরা তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলেন।
বুলবুলি ও মৌমাছি একজন কর্মকর্তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হওয়ার পর কর্মকর্তার এপিএস বসের কক্ষে প্রবেশ করে বলল-
: স্যার, দুজন দর্শননার্থী আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
: নাম বলেন।
: বুলবুলি ও মৌ...

নাম শুনে কর্মকর্তা দর্শনার্থীদের পাঁচ মিনিট পর তার কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে ফ্রেশরুমে ঢুকলেন। একটু আগে পান খাওয়ায় ঠোঁট-দাঁত লাল হয়ে আছে। লালভাব দূর করতে হবে। তিনি টুথব্রাশে পেস্ট লাগালেন। দাঁত ব্রাশ করার সময় কলপের কুয়াশা ভেদ করে একটা সাদা চুল উঁকি মারছে দেখে তিনি সেটাকে টান মেরে উপড়ে ফেললেন। এরপর মুখে ক্রিম মেখে, মাথার চুল পরিপাটি করে বের হতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তিনি দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন-

: বুলবুলি ও মৌ নাম শুইনা আমি মনে করছিলাম নারীজাতি। যাক, কোনো সমস্যা নাই। বলো, কী বলতে চাও?
বুলবুলি মৌমাছির সাহায্য নিয়ে কথা বলা শুরু করল। সে বলল-
: আমরা আসছি সুন্দরবন থেইকা। বাঘ মামা আমাদের পাঠাইছেন।
: আরে! তোমাদের না পাঠাইয়া বাঘ নিজে আইলেই তো সবচাইতে ভালো হইত। কথাবার্তা শেষে তার সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতিস্বরূপ চামড়াটা ছুলাইয়া ড্রয়িংরুমে টাঙাইয়া রাইখা দিতে পারতাম।
: ছোলামোলা হওয়ার ভয়েই তিনি আসেন নাই।

: অঃ। পশু-পাখিও দেখতেছি আইজকাইল মানুষের মতো চালাক-চতুর হইয়া উঠেছে! ঠিক আছে, তোমাদের বক্তব্য বলো।
: আমরা অনেক দাবি লইয়া আসছি। প্রথম দাবি হইল, অবিলম্বে সুন্দরবনের ভিতর দিয়া জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে হবে।
: কেন?
: জাহাজের শব্দে আতংকগ্রস্ত বনের পশুপাখিদের ঘুম হারাম হইয়া গেছে।
: ঢাকা শহরে আমরা আরও কঠিন শব্দের মধ্যে বসবাস করতেছি। আমাদের কেউ তো আতংকিত হয় না!
: শব্দ ছাড়াও জাহাজের কালোধোঁয়া ও আবর্জনায় সেখানকার পরিবেশ দূষিত করতেছে।

: দূষণের দেখছো কী? এক সপ্তাহ ঢাকা শহরে থাকো। দূষণ কারে কয়, টের পাবা। কিন্তু কই, আমরা তো একবারও নাক উঁচা কইরা তোমাদের মতো বলতেছি না, এইটা বন্ধ কর; ওইটা বন্ধ কর। যতসব পাগলের কারবার। ওইদিন এক এনজিও নেত্রীরে দেখলাম, প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়াইয়া 'সুন্দরবন আমার মা' এই কথা বলতে বলতে বেহুঁশ হইয়া যাইতেছে। আরে! ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় বসবাস কইরা ম্যা-ম্যা কইরা মায়াকান্না কাঁদলে বিদেশী সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে ঠিকই; কিন্তু মায়ের কোনো উপকার হবে কী? হবে না। মায়ের জন্য দরদ থাকলে জঙ্গলে যাইতে হবে। শরীরে কাদা-পানি লাগাইতে হবে। যাক এইসব। তোমাদের দ্বিতীয় দাবি কী, সেইটা বলো।
: জাহাজ অ্যাকসিডেন্ট খাওয়ার পর যে তেলগুলা নদীর জলে ভাইসা রইছে, তা দ্রুত অপসারণ করতে হবে।

: তার আগে তোমরা বলো, জলের মধ্যে তেল; না তেলের মধ্যে জল? আমি যদি বলি, তেলের মধ্যে জল এবং জল সরাইয়া নিতে হবে, তখন কী করবা? শোন, কষ্ট কইরা তেল অপসারণ করার দরকার নাই। আর কয়েকটা দিন টাইম দেও। চন্দ্র-সূর্যের হিসাব মাইনা জোয়ার-ভাটার ধাক্কায় ভাইসা থাকা বেবাক তেল আপসে-আপ বে অব বেঙ্গলে চইলা যাবে।
: তেলের কারণে ওইখানকার নদ-নদীর জলজ প্রাণিরা অক্সিজেনজনিত সমস্যায় ভুগতেছে। ততদিনে তারা তো মারা যাবে!
: সাপের মতো বেক্কল না হইলে কেউ মারা যাবে না। পেপসি-কোক খাওয়ার অভ্যাস আছে? অভ্যাস থাকলে বিষয়টা সহজে ক্যাচ করতে পারবা। আমরা লাখ-লাখ পেপসি-কোক খাওয়ার স্ট্র নদীর জলে ছিটাইয়া দিব। জলজ প্রাণীরা নাকের মধ্যে সেই স্ট্র ফিট কইরা মুক্ত বাতাস থেইকা অফুরন্ত অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারবে।

: সমস্যা শুধু জলজ প্রাণির না, গাছপালারও। সুন্দরবন শ্বাসমূলীয় বন। এই বনের গাছপালা শ্বাসমূল দিয়ে নিঃশ্বাস গ্রহণ করে। তেলের আস্তরণ জোয়ারের সময় মাটির ওপরে বইসা যাইয়া গাছের শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত করতেছে। এর ফলে বনের গাছপালা মইরা যাবে।
: গাছ মরলে সমস্যা কী? নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদ-নদী থাকলেই চলবে। নদ-নদীর ওপর দিয়া জাহাজ ও নৌকা চলবে। জাহাজের সারেং গাইবে- হুলা হুলা হুইল্যা। নৌকার মাঝি গাইবে- নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা। এইটাই হইল বাংলার চিরন্তন রূপ। এই রূপ ধইরা রাখার জন্য জংলার গাছপালার চাইতে বাংলার নদ-নদীরে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

: সুন্দরবনের পশুপাখিরা তাহলে কোথায় যাবে?
: তারা বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় চইলা আসবে। সরকার দেশে অনেক সাফারি পার্ক গইড়া তুলতেছে। সেইখানেও আশ্রয় নিতে পারবে।
: সুন্দরবন তো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ!
: দরকার মনে করলে বিশ্ব ঐতিহ্যরে আমরা আমাদের জাদুঘরে সংরক্ষণ করব। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে সবার আগে দেশের অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানের বিষয়টা আমাদের দেখতে হবে। ঠিক আছে?
ফেরাটা সুখকর হলো না। মন খারাপ করা উদাস হাওয়ায় উড়তে উড়তে হঠাৎ বুলবুলি মৌমাছিকে বলল-
: যে ধরনের কথাবার্তা শুনলাম, মনে হইতেছে, এরা অচিরেই সুন্দরবনকে খেয়ে ফেলবে। কাজেই ধ্বংসস্তুপে ফিরে কী লাভ? তুমি যাও, আমি আর বনে ফিরব না। যে কয়টা দিন বাঁচি, আদাড়ে-বাদাড়ে ঘুইরা কাটাইয়া দিব।
বুলবুলির কথার উত্তরে মৌমাছি বলল-
: আপু! বনের পশুপাখি বন ছাইড়া কোথায় যাবে? তুমি বনেই থাকবা। বনের মধ্যেই সুখের ঘর বানবা। সুন্দরবন লইয়া চিন্তিত হওয়ার কিছু নাই। সুন্দরবন হইল প্রকৃতির সন্তান। মা তার সন্তানরে ঠিকই রক্ষা করবে।

লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আপু! বনের পশুপাখি বন ছাইড়া কোথায় যাবে? তুমি বনেই থাকবা। বনের মধ্যেই সুখের ঘর বানবা। সুন্দরবন লইয়া চিন্তিত হওয়ার কিছু নাই। সুন্দরবন হইল প্রকৃতির সন্তান। মা তার সন্তানরে ঠিকই রক্ষা করবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।