স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ২৯ মার্চ ২০২২

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রকৃতঅর্থে তা-ই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। সেই ঘোষণায় উদ্দীপ্ত হয়েই বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ সংগ্রাম। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল ঐক্যবদ্ধ সাধারণ বাঙালি। বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছিল চট্টগ্রামেও।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে প্রহসন-পর্ব শেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শুরু হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল পৌঁছে যায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে অবস্থিত শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জহির আলম খানের নেতৃত্বে পঞ্চাশ জন সৈন্য ঢুকে পড়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভেতর। এলোমেলোভাবে গুলি ছুড়তে ছুড়তে দোতলায় ওঠে তারা। প্রবেশ করে মুজিবের শোবার ঘরে।

বঙ্গবন্ধু প্রস্তুত ছিলেন গ্রেপ্তারের জন্য। কাপড়-চোপড়ের ছোট্ট একটা ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে কালো একটা পাইপ মুখে বেরিয়ে এলেন তিনি। প্রশান্ত মুখ তাঁর। কারণ তিনি তাঁর করণীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ শেষ করেন কিছুক্ষণ আগেই।

গ্রেপ্তারের আশঙ্কা মাথায় রেখেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাত ১২টার দিকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রেরণ করেন ইপিআর ঘাঁটিতে। ইংরেজিতে লেখা সেই ঘোষণাটি স্বল্প সময়ের জন্য প্রচারিত হয় ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারে। ঘোষণাটির বঙ্গানুবাদ অনেকটা এমন : ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহবান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।’

কালুরঘাটস্থ চট্টগ্রাম রেডিও ট্রান্সমিটিং সেন্টার থেকে সম্প্রচারিত হলো ঘোষণাটি।বেলা আড়াইটার দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ঘোষণাটি পাঠ করলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। ঘোষণাটি খুব বেশি সংখ্যক মানুষ শুনতে না পাওয়ায় ২৬ মার্চ দুপুরের দিকে ডা. জাফর, এম এ হান্নানসহ চট্টগ্রামের আরো কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আলোচনায় বসলেন সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার রফিকুল ইসলাম।

চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তার সহযোগিতায় স্বাধীনতার একটি ঘোষণা লিখলেন তাঁরা। সকলের সম্মতিক্রমে ডা. জাফর পরিমার্জনা করলেন ঘোষণাটি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঙালিদের জীবন বাঁচানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদনই ছিল ঘোষণাটির মূল বক্তব্য। বাঙালিদের হাতে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্যও আহবান জানানো হলো ঘোষণায়। আবুল কাশেম সন্দ্বীপও এই ঘোষণাটি পাঠ করে শোনান।

এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মকর্তারা কৌশলগত কারণে সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি অফিসারকে দিয়ে ঘোষণাটি পাঠ করানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এতে করে সামরিক বাহিনীতে থাকা বাঙালি সদস্যরা উৎসাহিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে- এটাই ছিল তাদের প্রত্যাশা। অবশেষে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমানকে অনুরোধ জানানো হয় ঘোষণাটি পাঠ করবার জন্য।

বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও স্বাধীনবাংলা বেতারের কর্মীদের অনুরোধে সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। অনুবাদিত ঘোষণাপত্রটির ভাষ্য ছিল- ‘আমি, মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমান্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।

আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকা- চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর।

এ রাষ্ট্র সকল জাতির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এবং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবার দাবিদার।’

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রণীত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে’ বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তাটি পাঠান। ২৬ মার্চ বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হলে প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এর পর পাঠ করেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে পরদিন সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে একই ঘোষণা জিয়াউর রহমান পাঠ করেন বলে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ওই ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ বলেন, জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলাপ করে ঘোষণাটি তৈরির পর আমার সহকর্মীদের বলে দিলাম একটা ঘোষণা দিতে থাকো, ‘মেজর জিয়া একটি জরুরি ভাষণ দেবেন। জিয়াউর রহমান বলবেন না, মেজর জিয়া বলবেন।’

কিছুক্ষণের মধ্যে মেজর জিয়া একটা জরুরি ভাষণ দেবেন- এভাবে দুই তিনবার অ্যাডভান্স অ্যানাউন্সমেন্ট করা হলো। তারপর তিনি নিজের কণ্ঠে ইংরেজিটা পড়েছেন। বাংলাটা আমার সহকর্মী আব্দুল্লাহ আল ফারুকের কণ্ঠস্বর ভালো, তাকে দিয়ে শুনিয়েছি। এইভাবেই হলো। কোনো রকম পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না, পরিকল্পনা ছিল না এবং এটা স্বাধীনতা ঘোষণা না। এটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে একই কথার পুনরুক্তি করা।

স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে মেজর জিয়া নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আজকে আমার সেই দিনটির কথা খুব মনে পরছে। ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ, যেদিন আমার নেতা মহান রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আমি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলাম’ (দেশ বাংলা পত্রিকা, ১৯৭৭, বিশেষ সংখ্যা)।....‘আমি দুই বারই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলাম। জনাব বেলাল মোহাম্মদসহ (কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা) স্বাধীন বাংলা বেতারের যাঁরা উক্ত ঘোষণার খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন, তাঁরা এখনও বেঁচে আছেন।

আমাকে দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে উক্ত ঘোষণা প্রচারের জন্য তিনি (জনাব বেলাল মোহাম্মদ) আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কালুরঘাটে নিয়ে গিয়ে ছিলেন এবং স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে উক্ত ঘোষণা প্রচারের জন্য অনুরোধ করেছিলেন’। ...‘তদানীন্তন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নেতা এবং বাঙালি জনগণের ভোটে নির্বাচিত সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার একমাত্র বৈধ এখতিয়ার ও বৈধ কর্তৃত্ব তাঁরই (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের) ছিল।

আমাদের কারও ছিল না। আমরা ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধকালীন যে যেখানে যা কিছু করেছি, সবই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে করেছি। আমরা কেউ কিছু কোথাও নিজের কারো নামে, কোনো কিছু দাবি করতে পারি না, যখন বিশ্ববাসী সবাই জানেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু হচ্ছে ওঁনার নামে। তিনি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক ও অনুপ্রেরণা’ (বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম, মুসা সাদিক, বাংলা একাডেমি, ২০০৫, পৃষ্ঠা-১৪৬-১৫১)।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সারা বিশ্বের ইংরেজি ভাষার শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২৬ মার্চ সকালে কলকাতায় পৌঁছা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃত বার্তা থেকে এবং ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার থেকে সারা বিশ্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা জানতে পারে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। খবরটি প্রচারিত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবিসি নিউজে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখেই।
এবিসি নিউজে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দুটো খবর প্রচারিত হয়।
প্রথম নিউজ : শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এবিসি, মার্চ ২৬, ১৯৭১।
হেড লাইন : পাকিস্তান/ সিভিল ওয়ার

সংক্ষিপ্ত খবর (ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান) পূর্ব পাকিস্তান গত ডিসেম্বরে জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের নীতি বদলানোর জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনুরোধে ৩ সপ্তাহের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছে পাকিস্তান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মিটিং করেছে। তার সঙ্গে ভুট্টোও উপস্থিত ছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পরে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে ।

দ্বিতীয় নিউজ : পাকিস্তানে সিভিল ওয়ার শুরু হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করতে নেমে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে- শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল ২৫ মার্চ, ১৯৭১ একটি র‌্যালিতে বক্তৃতা করছেন। তিনি বলেছেন - পূর্ব পাকিস্তানিদের কেউ দাবায় রাখতে পারবে না।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত দ্য স্টেটসম্যানে ২৬ মার্চ পাওয়া দুটি বার্তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়: পাকিস্তানি বাহিনী আন্দোলনকে চাপা দিতে অগ্রসর হওয়ার পর শুক্রবার শেখ মুজিবুর রহমান দুটি বার্তা সম্প্রচার করেছেন। ইউএনআই এ কথা জানায়।

একটি অজ্ঞাত রেডিও স্টেশন থেকে বিশ্বের কাছে পাঠানো এক বার্তায় আওয়ামী লীগ নেতা (শেখ মুজিব) ঘোষণা দিয়েছেন যে ‘শত্রু’ আঘাত হেনেছে এবং জনগণ বীরের মতো লড়াই করছে। বার্তাটি কলকাতা থেকে শোনা হয়েছে। রেডিও স্টেশনটি নিজেকে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। শিলং থেকে শোনা স্টেশনটির পরবর্তী সম্প্রচারে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছেন।

২৭ মার্চ মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া সকালের প্রথম সম্প্রচার থেকে পাওয়া বার্তার বিষয়বন্তু প্রকাশ করে: আজ বিশ্বের কাছে পাঠানো এক বার্তায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের স্বাধীনতার জন্য বীরের মতো লড়াই করছে। একটি অজ্ঞাত রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে সম্প্রচারিত ওই বার্তা মুম্বাই থেকে শোনা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, রেডিও স্টেশনটি পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম অথবা চালনায় অবস্থিত।

বার্তায় জনাব রহমান বলেন: ‘আজ রাত ১২টার দিকে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী হঠাৎ করে পিলখানা ও রাজারবাগে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ঘাঁটিতে হামলা চালায়। হামলায় অসংখ্য (নিরস্ত্র) মানুষ নিহত হয়।
ঢাকায় ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে কঠিন লড়াই চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জনগণ অকুতোভয়ে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছে।’

‘বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ অবশ্যই যেকোনো মূল্যে দেশের প্রতিটি কোণে শত্রু বাহিনীকে প্রতিরোধ করবে।
‘আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন এবং শত্রুর কাছ থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে তিনি আপনাদের সাহায্য করবেন। জয় বাংলা।’

২৭ মার্চ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দৈনিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বঙ্গবন্ধু দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণার কথা প্রচার করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা কোনো ছেলে খেলা নয়, এটা যে কেউ দিতে পারে না। আর দিলেই তাতে কাজ হয় না। বাংলাদেশে গত একশ বছরের ইতিহাসে অনেক বড় নেতার জন্ম হয়েছে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এরা কেউই স্বাধীনতার ঘোষণার পরিবেশ পাননি। একমাত্র ১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের একচ্ছত্র নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পেরেছিল।

আমাদের স্মরণকালের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই একমাত্র সব রকম রাজনৈতিক শর্ত পূরণ করে স্বাধীনতা ঘোষণার পরিবেশ পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা তিনিই করতে পারেন যাঁর ব্যাপক জনসমর্থন থাকে, আন্তর্জাতিক পরিচিতি থাকে, সামরিক বাহিনীর সমর্থন থাকে, একটা বিকল্প সরকার গঠন ও পরিচালনার প্রস্তুতি ও সক্ষমতা থাকে।

এই সবগুলো শর্তের ‘ষোলকলা’ পূর্ণ হয়েছিল ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যার পর আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়ানো শুরু হয়। বিশেষ করে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রায়শই জিয়াউর রহমানকে অনেক বড় করে দেখানো চেষ্টা করা হতে থাকে তার মৃত্যুর পর । পৃথিবীর ইতিহাসে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে দাবিদার কেউ না থাকলেও আমাদের দেশে এ নিয়ে কূটক্যাচালের অন্ত নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তিনি প্রায় তিন দশক ধরে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে। জাতির আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক, জনগণের ভাগ্য-বিধাতা রূপে বাংলার জনগণ যাঁর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমথন ব্যক্ত করেছিলেন, শুধু তাঁরই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার আইনি ও নৈতিক অধিকার ছিল। তাঁর কথাতেই জনগণ বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছাড়া আর কেউ নন।
মেজর জিয়া রেডিওতে যে ঘোষণা পাঠ করেছেন, তা ছিল ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭.৪৫ মিনিটে। তাহলে ২৬ মার্চ জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এই ঘোষণায় দেশ স্বাধীন হওয়ার কল্পগল্প বিশ্বাসযোগ্য হয় কীভাবে? এই অলীক গল্প বলা বন্ধ হওয়া উচিত অবিলম্বে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/জিকেএস

প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা কোনো ছেলে খেলা নয়, এটা যে কেউ দিতে পারে না। আর দিলেই তাতে কাজ হয় না। বাংলাদেশে গত একশ বছরের ইতিহাসে অনেক বড় নেতার জন্ম হয়েছে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এরা কেউই স্বাধীনতার ঘোষণার পরিবেশ পাননি। একমাত্র ১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের একচ্ছত্র নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পেরেছিল।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।