তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৈরী আবহাওয়া
বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী দিন দিন মৌসুমি আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করা শুরু করেছে। ২০২১ সালের শুরু থেকে সারা বিশ্বে আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করছে। যেমন- ২০২২ সালের শীত মৌসুমে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে শীতকালীন যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে তা ফেব্রুয়ারি মাসের গড় বৃষ্টিপাত অপেক্ষা ৪০০ শতাংশ বেশি। আজ থেকে ৫০ বছর আগে বছরের কোন এক নির্দিষ্ট মাসে বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প উপস্থিত থাকত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা অপেক্ষা বেশি পরিমাণ জলীয় বাষ্প উপস্থিত থাকছে ও অতিবৃষ্টি আকারে ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হয়ে পানিচক্র পূর্ণ করছে।
২০২১ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্য ও আমেরিকার ওয়াশিংটন রাজ্যে রেকর্ড ভঙ্গ করা গরম আবহাওয়া বিরাজ করছিল। এরপর ওই দুই রাজ্যে ব্যাপক দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। রেকর্ড ব্রেকিং তাপমাত্রা ও দাবানলের মাত্র ছয় মাস পরে ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যে কানাডার ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বৃষ্টিপাত ও প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়ে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি করে। চলতি বছরের (২০২২ সালের) মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বিশ্বের শীতলতম মহাদেশ এন্টার্কটিকার পূর্বপ্রান্তের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি রেকর্ড করা হয়েছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার কেন্টাকি রাজ্যে একটি টর্নেডো প্রায় ৮ ঘণ্টা ধরে চারটি রাজ্যের ওপর দিয়ে অতিক্রম করে, যার কারণে প্রায় ১০০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আমেরিকার ইতিহাসে ডিসেম্বর মাসের এত বেশি প্রাণহানি ঘটায়নি কোনো টর্নেডো। ভারতীয় উপমহাদেশেও ২০২১ সালে আবহাওয়া বিরূপ আচরণ করেছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে বন্যার স্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিক বন্যা সংগঠিত না হলেও বর্ষার শেষে হঠাৎ করে বন্যা নেমে আসে তিস্তা নদীর দুই তীরে।
২০২২ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ও নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য মাত্র ৩০ ঘণ্টায় ৭০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়, যাতে ১৯ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ বাঁচাতে নিজেদের বাড়ির ছাদে অবস্থান করে উদ্ধারের জন্য অপেক্ষা করে। আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় এ ধরনের বৃষ্টিপাতকে ১০০০ বছর একটি বৃষ্টিপাতের ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়।
একইভাবে বঙ্গোপসাগরও ২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে খুবই অস্বাভাবিক আচরণ করছে। যেমন- একটি নিম্নচাপ আন্দামান ও নিকবার দ্বীপের কাছে সৃষ্টি হয়ে তা ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ওপর দিয়ে অতিক্রম করে আরব সাগরে গিয়ে আবারও ও ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে প্রথমে ভারত ও পাকিস্তানের উপকূলে আঘাত করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ওমানের রাজধানী মাস্কটের পাশ দিয়ে স্থলভাগে আঘাত করে ব্যাপক বন্যা ও ক্ষয়-ক্ষতি করে। উল্লেখ্য যে, আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আগে শুধু ওমানের পূর্ব উপকূলেই আঘাত করতো।
এ বছরই প্রথম ওমানের উত্তর উপকূলে আঘাত হানে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে (গত ১০০ বছরের ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ডিসেম্বর মাসে কোনো ঘূর্ণিঝড় ১৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে আঘাত হানার ঘটনা নেই বললেই চলে) ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’ ভারতের ওড়িষ্যা উপকূলে আঘাত হানার পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অতিক্রম করে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘাটায়। ফলে মুন্সিগঞ্জ জেলার আলু চাষীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গত ১০০ বছরের ইতিহাসে মাত্র দুবার মার্চ মাসে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। এবার মার্চে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়ছিল। গভীর নিম্নচাপের পর শেষ মুহূর্তে সেটি আর ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়নি।
সাম্প্রতিককালে আটলান্টিক মহাসাগর ও মেক্সিকো উপসাগরে সংঘটিত অনেক ঘূর্ণিঝড়ের চলার পথে অনিশ্চয়তা দেখা গেছে ঘূর্ণিঝড়গুলোর জীবনচক্রে। ঘূর্ণিঝড়গুলোর জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক অনিশ্চয়তা থাকলেও বিজ্ঞানীরা অনেকটাই নিশ্চিত যে, বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির কারণে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি হচ্ছে, এর প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের ওপর।
বিশেষ করে সাম্প্রতিককালের ঘূর্ণিঝড়গুলো উচ্চ গতিবেগ, রেকর্ড ভঙ্গ করা পরিমাণ বৃষ্টিপাত, মন্থর গতিবেগ, স্বাভাবিক অপেক্ষা উঁচু জলোচ্ছ্বাস, উপকূলের কাছে এসে হঠাৎ মন্থর হয়ে যাওয়া ও হঠাৎ করে শক্তিশালী হয়ে ওঠা। গত ১৬৯ বছরের ইতিহাসে আটলান্টিক মহাসাগরে ক্যাটাগরি-৫ মানের হ্যারিকেন সংঘটিত হয়েছে ৩২টি। যার মধ্যে গত চার বছরে সংঘটিত হয়েছে পাঁচটি। আরব সাগরের ইতিহাসে ষষ্ঠবারের মতো ক্যাটাগরি-৪ মানের ঘূর্ণিঝড় ‘তাউকত’ সৃষ্টি হয়েছিল ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুমে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২০ বছরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলো অনেক শক্তিশালী হচ্ছে।
উপরোক্ত পরিসংখ্যান প্রমাণ দেয় বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হ্যারিকেন (আটলান্টিক ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়), টাইফুন (পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়) ও ঘূর্ণিঝড় (ভারত মহাসাগরে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়) দিন দিন বেশি শক্তিশালী হচ্ছে।
সর্বোপরি বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে বায়ুমণ্ডলে বেশি পরিমাণ জলীয় বাষ্প ধরে রাখছে, যা অতিবৃষ্টি আকারে পতিত হয়ে ব্যাপক বন্যা ঘটাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।
বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বায়ুপ্রবাহের মান ও দিকের (বিশেষ করে জেট স্ট্রিম অনেক আঁকাবাঁকাভাবে চলছে ও অনেক স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে স্থির হয়ে থাকছে) ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। যে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া (অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, অসময়ে ঘূর্ণিঝড়) দেখা যাচ্ছে।
লেখক: আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক, স্কুল অব এনভাইরোমেন্ট অ্যান্ড সাস্টেনিবিলিটি, সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, সাসকাটুন, কানাডা।
[email protected]
এইচআর/এএসএম