ট্রাক নিয়ে কল্পকথা ও শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন
পার্থিব জীবন শেষ করে দুই ব্যক্তি স্বর্গ-নরকের অধীশ্বরের সামনে উপস্থিত হলেন। প্রথম ব্যক্তিকে অধীশ্বর জিজ্ঞাসা করলেন, পৃথিবীতে তুমি কী করতে? প্রথম ব্যক্তি উত্তরে জানালেন, প্রভু, পৃথিবীতে আমি মানুষকে সর্বদা তোমার কথা বলতাম। তোমার দেওয়া আদেশ-নিষেধ পালন ও মেনে চলতে বলতাম। জ্ঞান হওয়া থেকে মৃত্যু অবধি আমি মানুষদের তোমার কথা বলে এসেছি।
উত্তর শুনে অধীশ্বর একটু মুচকি হাসলেন এবং বললেন, আমি সব জানি। তবে একটু অপেক্ষা করো দেখি তোমার পরের জন দুনিয়ায় কী করতো একটু জেনে নেই। তিনি দ্বিতীয়জনকে একই প্রশ্ন করলেন। দ্বিতীয়জন উত্তর দিল সে বাংলাদেশ নামক একটি দেশে ট্রাক নামে একটি পরিবহন চালাতেন। অধীশ্বর বললেন, আমি তা জানি। এই নাও তোমার টিকিট, তুমিই প্রথম স্বর্গে গিয়ে আরাম-আয়েশ করো। অতঃপর তিনি প্রথমজনকেও স্বর্গের টিকিট দিলেন এবং আরাম-আয়েশ করতে বললেন।
অধীশ্বরের বিচার দেখে প্রথমজন একটু ইতস্তত করে তাকে বললেন, প্রভু, ক্ষমা করবেন; একটু অভয় দিলে একটা বিষয় জানার ছিল। অধীশ্বর অভয় দিয়ে বললেন, বলো কী জানতে চাও। প্রথমজন বললেন, এ আপনি কেমন বিচার করলেন। যে ট্রাক চালাত তাকেও স্বর্গে পাঠালেন, আবার সারা জীবন আমি আপনার কথা প্রচার করে এলাম─ সেই আমাকেও স্বর্গে পাঠালেন। বড়ই অদ্ভুত আপনার বিচার।
অধীশ্বর তখন বললেন, দেখো তুমি যখন মানুষকে আমার কথা বলতে তারা চোখ বুজে শুনতো, কেউ কেউ ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে থাকতো। তোমার কথা শুনে আসার পর তাদের অনেকেই আমাকে ভুলে যেত। আর ও যখন ট্রাক নিয়ে রাস্তায় বেরোত তখন অন্যান্য পরিবহনের যাত্রী থেকে শুরু করে রাস্তার আশপাশে যারা থাকত তারা সবাই মনে-প্রাণে আমায় স্মরণ করত। আমি ছাড়া তাদের বাঁচানোর কেউ নেই বলে আকুতি জানাতো। মানুষকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করতে ওর পারফরম্যান্সের কারণেই ওকে স্বর্গে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি। আর কিছু জানতে চাও? প্রথমজন বললেন, না প্রভু, আর কিছু জানার নেই।
উপরোক্ত গল্পটি নিছকই একটি কল্পিত গল্প। আমাদের দেশের ট্রাক ও ট্রাকচালকদের ভয় করে না এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। সারাদেশে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার অধিকাংশই ট্রাকের কারণে। রাস্তায় চলাচলে বাসের হেলপাররা তাই বাসচালককে এই বলে সতর্ক করেন ওস্তাদ, সাবধান! সামনে ট্রাক। শুধু সামনেই নয়, পিছনে, ডানে, বাঁয়ে যেকোনো জায়গায় ট্রাক থাকলে রাস্তার অন্যান্য পরিবহনের চালকরা সর্তক হয়ে যান। ট্রাককে তাই সবাই ভয় পাই।
কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য সেই ট্রাকের জন্য এখন এদেশের একশ্রেণির মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে। সেটি হলো ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক। কারণ, এই ট্রাকেই এখন এদেশের মানুষের বড় একটি অংশের বেঁচে থাকার রসদ থাকে।
এবার আসা যাক শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন প্রসঙ্গে। করোনা মহামারির শুরুতে গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত একটি সুবিশাল গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেন, যা ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির শিরোনাম ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’। এই গ্রন্থে নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন যে কোভিড-১৯ ও সংশ্লিষ্ট লকডাউন বাংলাদেশের শ্রেণি কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সরকার কর্তৃক ঘোষিত লকডাউনের আগের শ্রেণি কাঠামো ছিল এ রকম: (দেশের মোট খানার মধ্যে) দরিদ্র ২০ শতাংশ, মধ্যবিত্ত ৭০ শতাংশ, ধনী ১০ শতাংশ। আর লকডাউনের পরে শ্রেণি কাঠামো সম্পূর্ণ পাল্টে হয়েছে এ রকম: দরিদ্র ৪০ শতাংশ, মধ্যবিত্ত ৫০ শতাংশ, ধনী ১০ শতাংশ। সুতরাং নিশ্চিত যে কোভিড-১৯ এর কারণে মাত্র দুই মাসের মধ্যে ব্যাপক মানুষের শ্রেণিগত অবস্থান পাল্টে গেছে নিম্নগামী হয়েছে, অবনতি হয়েছে।
ড. বারকাত হিসাব করে দেখিয়েছেন, ২০২০ সালের লকডাউনের আগে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ আর (ঠিক দুই মাস পরে) কোভিড-১৯ এ লকডাউন করার দুই মাস পরে ৩১ মে (২০২০) নাগাদ এক লাফে ওই দরিদ্র শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৮০ লাখে। অর্থাৎ কোভিড-১৯ এর কারণে মাত্র দুই মাসে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ।
আবার দরিদ্রদের মধ্যে যারা হতদরিদ্র ‘যারা দিন আনে দিন খায়’ (অথবা যাদের সরকারি পরিসংখ্যানে খানার আয়ের সর্বনিম্ন ১০ ডিসাইল হিসেবে ধরা হয়) তাদের সংখ্যা ছিল লকডাউনের আগে মোট খানার ১০ শতাংশ কিন্তু লকডাউনের দুই মাস পরে তাদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৫ শতাংশ অর্থাৎ লকডাউনের আগে তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যা ছিল যেখানে মোট ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ, সেখানে লকডাউনের পরে (মাত্র দুই মাসের মধ্যে) সে মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ২৫ লাখ অর্থাৎ হতদরিদ্র গ্রুপে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন ২ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ। এরা লকডাউনের আগে ‘দরিদ্র’ শ্রেণিতে ছিলেন, ৬৬ দিনে ‘হতদরিদ্র’ গ্রুপে নেমে গেছেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন, কোভিড-১৯ এ ‘মধ্যবিত্ত’ শ্রেণি কাঠামোতে পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক এবং বহুধা। লকডাউনের আগে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে মোট মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা ছিল (মোট খানার ৭০ শতাংশ) ১১ কোটি ৯০ লাখ, যা লকডাউনের পর (মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে) কমে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৫০ লাখ। অর্থাৎ মাত্র দুই মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ অতীতের ৩ কোটি ৪০ লাখ মধ্যবিত্ত গ্রুপের মানুষকে টেনে নিচে নামিয়ে ছেড়েছে।
তিনি এই বইয়ে সমাজ পরিবর্তনের সম্ভাব্য শক্তি হিসেবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হওয়ার সম্ভাবনার কথাও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সবাই একইরকম মধ্যবিত্ত নয়। মধ্যবিত্তদের মধ্যে বড় তিনটি উপ-শ্রেণি আছে: নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত।
অধ্যাপক বারকাত আরও বলেন যে, কোভিড-১৯ (ও সংশ্লিষ্ট লকডাউন) এই তিন ধরনের মধ্যবিত্তের (মধ্যবিত্তের উপ-শ্রেণির) ওপর একই রকম প্রভাব ফেলেনি। তার হিসাবে, লকডাউন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে নিম্ন-মধ্যবিত্তের: লকডাউনের আগে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে ছিলেন মোট ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষ, যাদের সংখ্যা লকডাউনের ৬৬ দিনের মাথায় হয়েছে ৩ কোটি ৯১ লাখ অর্থাৎ মাত্র দুই মাসের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ১ কোটি ১৯ লাখ নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ আসলে হারিয়ে যাননি, তারা দরিদ্র শ্রেণিতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন।
মধ্য-মধ্যবিত্তের মানুষের অবস্থাও নাকাল। লকডাউনের আগে তারা ছিলেন মোট খানার ২০ শতাংশ আর লকডাউনের (২ মাস) পরে নেমে এসেছেন ১৪ শতাংশে অর্থাৎ ৩ কোটি ৪০ লাখ মধ্য-মধ্যবিত্তের সাইজ সংকুচিত হয়ে এখন তা ২ কোটি ৩৮ লাখ হয়েছে। অর্থাৎ ১ কোটি ২ লাখ মধ্য-মধ্যবিত্তদের ৮০ শতাংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত গ্রুপে আর ২০ শতাংশ দরিদ্র গ্রুপে যোগ দিয়েছেন। তার হিসেবে উচ্চ-মধ্যবিত্তরাও কিন্তু আগের জায়গায় নেই।
লকডাউনের আগে দেশে উচ্চ-মধ্যবিত্তরা (মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে সবচেয়ে ওপরে যাদের অবস্থান) ছিলেন মোট খানার ২০ শতাংশ লকডাউনের পরে যা নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে। অর্থাৎ লকডাউনের আগে উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ, যা লকডাউনের পরে নেমে এসেছে ২ কোটি ২১ লাখে। অর্থাৎ উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যেও ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ শ্রেণি মইয়ে নিচের দিকে চলে গেছেন, সম্ভবত যোগদান করেছেন মধ্য-মধ্যবিত্ত গ্রুপে। তবে এদের মধ্যে নগণ্য সংখ্যক শ্রেণি মইয়ে উঠে ধনীও হয়ে যেতে পারেন (কারণ মহামারি অবস্থায় বিভিন্ন কারণে কিছু মানুষের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়)। তিনি দেখিয়েছেন, শ্রেণি মইয়ের সবচেয়ে ওপরে বসবাসকারী ধনীদের (অতি ধনীসহ) অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি বরং তাদের কারও কারও অবস্থা আরও ভালো হয়েছে।
প্রখ্যাত গবেষক আবুল বারকাত দেখিয়েছিলেন যে, কোভিড-১৯ এর ফলে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশের শ্রেণি কাঠামো পুরো পাল্টে গেছে। ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে লকডাউনের আগের তুলনায় লকডাউনের পরে (মাত্র ৬৬ দিনের মধ্যে) কমপক্ষে ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষ শ্রেণি মইয়ে নিচের দিকে নেমে গেছেন। এই যে ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষ লকডাউন থাকার মাত্র দুই মাসের মধ্যে শ্রেণি মইয়ে ওপর থেকে নিচের দিকে নামতে বাধ্য হলেন তাদের শ্রেণিগত অবস্থানও তিনি উল্লেখ করেছিলেন।
লকডাউনের আগের মাসেও ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ছিলেন ‘দরিদ্র’, যারা ‘হতদরিদ্র’ গ্রুপে নেমে গেছেন (‘দরিদ্র’ শ্রেণিতেই আছেন তবে ‘দরিদ্রতর’ হয়েছেন), ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ ছিলেন ‘নিম্ন-মধ্যবিত্ত’ যারা ‘দরিদ্র’ শ্রেণিতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন, ১ কোটি ২ লাখ মানুষ ছিলেন ‘মধ্যবিত্ত’ যারা প্রধানত ‘নিম্ন-মধ্যবিত্ত’ গ্রুপে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন, আর ১ কোটি ১৯ লাখ ‘উচ্চ-মধ্যবিত্ত’ যারা ‘মধ্য-মধ্যবিত্তে’ যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। লকডাউনের ৬৬ দিনে শ্রেণি মইয়ের ওপর থেকে নিচে নামতে বাধ্য হওয়া মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখ নয়, আসলে সে সংখ্যা হবে ৬ কোটি ৮০ লাখ। এ দুই সংখ্যার যে পার্থক্য ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ তারা আসলে হতদরিদ্র ছিলেন, আর লকডাউনে হয়েছেন নিঃস্ব-ভিক্ষুক।
কল্যাণকামী অর্থনীতিবিদ ড. বারকাতের ওই গবেষণার ফলাফল এখন দৃশ্যমান। প্রায় দুই বছর আগে গবেষণার তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যানের বাস্তবতা আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের খবরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে। হতদরিদ্র ও ভিক্ষুক মানুষের সংখ্যা যে প্রশ্নাতীত ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমরা ঢাকা শহরসহ অন্যান্য বড় বড় শহরে বেরোলেই দেখতে পাই।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির ট্রাক থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার চিত্র প্রমাণ করে যে, অধ্যাপক বারকাত শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট যে পরিসংখ্যান গবেষণার মাধ্যমে তার বইয়ে তুলে ধরেছেন ক্রমান্বয়ে তা দৃশ্যমান হচ্ছে। সামনে হয়তো আরও বেশি করে এ দৃশ্য আমাদের চোখে পড়বে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম