বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ : ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নায়ক
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ের নায়ক তিনি। একটা সময় এসেছিল যখন তাঁর কোনো বিকল্প ছিল না। সেই সময়ে আঁধার ঘরের আলো ছিলেন তিনি। উত্তাল সময়ে ঢেউ সামাল দিয়ে তীরে ভিড়িয়ে ছিলেন তরী। ১৯৯০ সালের বড় দুঃসময়ে তিনি হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি থেকে রাষ্ট্রপতি। দায়িত্ব শেষে আবার ফিরেছিলেন তাঁর পদে। ১৯৯৬ সালে আবারও তাঁকে ডেকে এনে বসিয়ে দেয়া হয় রাষ্ট্র্রের সবচেয়ে সম্মানের আসনে।
সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁর কর্মজীবনে প্রথমে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালের জুন মাসে তাঁকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয়। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন।
১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারক পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তাঁর দেওয়া রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। যদিও সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আইনের লোক ছিলেন, লেখক ছিলেন না। তবে তাঁর ভাষণগুলো নিয়ে একটি বই আছে ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ: গণতন্ত্র বিনির্মাণ’। তাঁর কলেজশিক্ষক সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইনই ছিলেন এর উদ্যোক্তা। কিশোরগঞ্জের গুরু দয়াল কলেজে তিনি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ছাত্র হিসেবে পান। সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন সেই বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন: বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাজনীতিক নন। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ বিধানে তাঁকে রাজনীতি ও রাজনীতিক পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে হয়েছে। ...তবে তিনি রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও দলাদলি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি নিজেকে নিরপেক্ষতার এমন এক দুর্ভেদ্য দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছেন।
আমাদের দলীয় বিভাজন ও বিদ্বেষে অভ্যস্ত আমাদের রাজনীতিকেরা সেই নিরপেক্ষতাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেননি। এ কারণে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের কাছেই অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন দায়িত্ব পালনকালে। ১৯৯১ সালের ৫ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সাহাবুদ্দীন বলেছিলেন, ‘সংবিধানমতে প্রধানমন্ত্রীসহ সব মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা মাত্র। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধি নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভাকে যথেষ্ট ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করা আমি প্রয়োজন বলে মনে করি। তাই মন্ত্রিপরিষদের কোনো কাজে আমি হস্তক্ষেপ করিনি। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালিত হোক এটাই আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ও সাধনা।’
১৯৯০ সালের শেষ দিকে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। এরশাদ চেয়েছিলেন ক্ষমতায় থেকে তিনি আরেকটি নির্বাচন করবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল ও পাঁচদলীয় বাম জোট তাঁর পদত্যাগের দাবিতে অনড় থাকে। বিরোধী দলের আন্দোলন দমনে এরশাদ ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, কারফিউ জারি করেন। কিন্তু মানুষ তাঁর নির্দেশ মানেনি। তারা কারফিউ ভেঙে রাজপথে নেমে আসে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করেন এবং তিন জোটের রুপরেখা অনুযায়ী তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। তারপরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা।
১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয় এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে আগের দায়িত্বে ফিরে যান। বিস্ময়কর হলো, সে সময় বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎটুকু করেননি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতারা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি পদ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। প্রথমে তিনি রাজি হননি। পরে শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হলো যে তিনি রাজি না হলে তাঁর বাড়ির সামনে বসে অনশন করবেন। শেষ পর্যন্ত সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন।
আওয়ামী লীগ শাসনামলের পাঁচ বছর সাহাবুদ্দীন আহমদের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো মতভেদ হয়নি। তাঁর পরামর্শেই আওয়ামী লীগ সরকার প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছিল। ফলে, বিচার প্রলম্বিত হলেও এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেননি।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তিনি। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নেন। সেই থেকে তিনি নিজ বাসায় প্রায় স্বেচ্ছাবন্দি জীবন কাটিয়েছেন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমরা দলের বাইরে সবকিছু শত্রু মনে করি।
মতের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তাকে এড়িয়ে চলি। তাই তাঁর খোঁজখবর কেউ রাখেনি। সাহাবুদ্দীন আহমদ এ দেশের আইনের শাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখে গেছেন, গণতন্ত্র উত্তরণে যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন, জাতি তা অবনতমস্তকে স্মরণ করবে চিরকাল। এই মানুষটির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম