আমাদের ভেনিস হোক ঢাকা

ড. মাহবুব হাসান
ড. মাহবুব হাসান ড. মাহবুব হাসান , কবি, সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:০৬ এএম, ২০ মার্চ ২০২২

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন ঢাকার ৫৩টি খাল উদ্ধার করতে পারলে মানুষ ভেনিসে বেড়াতে যাবে না, ঢাকায় আসবে। ওই সব মানুষ যে বাংলার নয়, সেটা আমরা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি। বিদেশিরা ভেনিসে যাবেন না, ঢাকায় আসবেন। তার এই কথিত স্বপ্নটা বেশ আরামদায়ক আমাদের কাছে। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন আর বাস্তব সত্য এক ভিন্ন স্বাদ দেয়। তা তেতো!

দিন কয়েক আগে রাজধানীর পশ্চিমাংশের বছিলার লাউতলা খালের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার পর সেখানে তিনি এ-কথা বলেন। তার এই স্বপ্ন যদি সত্য সত্যই বাস্তব হতে পারে, তাহলে বিদেশিরা আসুক বা না আসুক, আমাদের বিনোদনের এবং মহানগরীর সৌন্দর্য বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

দুই কোটি মানুষ বাস করে এই মহানগরে। তারা প্রতিদিন না হোক বছরে একবার যদি মহাগরের ৫৩টি খালে নৌভ্রমণ করতে পারে, যদি পাড় বাঁধিয়ে ছোটখাটো ব্যবস্থার স্থাপনা করে আয়-রোজগার করতে পারে, তাহলে কতো পরিবারের বেকার যুবকের জন্য সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে যাবে, তা একবার কল্পনা করুন।

আসলে- স্বপ্ন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন- এই ধারণাকেন্দ্রিক চেতনাকে যদি আমরা ঠিকভাবে কাজে লাগাতাম তাহলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামকে আজ দখল হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধারে এমন গলদঘর্ম হতে হতো না। মন্ত্রী মহোদয় এই যে ৫৩টি খালের কথা বললেন, সেই তালিকায় কি বেগুনবাড়ি খাল বা ধোলাইখাল আছে?

মতিঝিলের ভেতর দিয়ে, পুরানা পল্টনের মাঝ দিয়ে, ফকিরারপুলে দক্ষিণাংশ দিয়ে প্রবাহিত, নটর ডেম কলেজের দক্ষিণ দিয়ে বয়ে চলা (নাম ভুলে গেছি) খালটির নাম কি সেই তালিকায় আছে? তালিকায় নাম আছে কি নেই, তার চেয়েও বড় হচ্ছে বিদ্যমান দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার করা হোক। কিন্তু যে সব খালের ওপরে বহুতল ভবন উঠে গেছে রাজউকের পারমিশন নিয়ে, সেগুলো কি হবে?

প্রায়ই আমরা টিভির খবরে দেখি উত্তরের মেয়র খাল উদ্ধারে অনেক বাড়িঘর ভেঙে দিচ্ছেন। তার সঙ্গে আছেন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অফিসার এবং ম্যাজিস্ট্রেট। সব মিলিয়ে একটি উদ্ধার অভিযান আমাদের মনে আগামী ঢাকার একটি রূপকল্প দেখতে পাই। এবং খুশি হই এই ভেবে যে শেষতক সরকার ঢাকার আদি প্রবাহের বেদখল হওয়া খালগুলো উদ্ধর করতে নেমেছে।

তবে, সেই খুশির বান অচিরেই থেমে যায়, যখন আর কোনো ফলোআপ সচিত্র নিউজ দেখি না টিভিতে। শুরু করা খাল উদ্ধার কাজটি কি চলছে না কি কেবল নিউজের জন্য মন্ত্রী, মেয়ররা প্রক্সি দিয়ে চলেছেন? আমাদের মনে একধরনের অবিশ্বাস জন্মেছে। কারণ এমন অনেক প্রকল্প আছে, যা শুরুর পর থেকে ১০-১২ বছর চলে গেলেও কোনো অগ্রগতি নেই।

আবার কোনো কোনো প্রকল্প ভুল ডিজাইনসহ অন্যান্য ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো প্রকল্প শুরুও করা হয়নি (বিদ্যুতের কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলোর ৮-১০টি বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ১০-১২ বছর ধরে সেই প্রকল্পের পিডিসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে/হচ্ছে) সেই শঙ্কা থেকেই আমরা স্বস্তি পাই না সরকারের কোনো প্রাগ্রসর প্রকল্পের উদ্বোধন হতে দেখলে।

ঢাকা মহানগরের খাল উদ্ধারের কথা বহু পুরোনো । প্রায় সব সরকারই খাল উদ্ধারের কথা বলেছেন এবং আমাদের মনে ভেনিসের স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো খাল উদ্ধারের পরিবর্তে খাল ভরে তার ওপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করেছেন। মহানগরী ঢাকার সম্প্রসারণ করতে গিয়েও দখলদারদের গ্রাসে গেছে খাল। সেগুলো সে-সময়ই উদ্ধার করা যেতো, কিন্তু করা হয়নি। কেন করা হয়নি, তা আমাদের জানানো হয়নি। তাদের দৃষ্টিতে মহানগরীর বাসিন্দাদের কোনো মূল্যই নেই বা ছিল না।

ক্ষমতাদর্পী সরকারগুলো জনগণের কথা ভাবে না, বসতিদের সুযোগ সুবিধার তোয়াক্কা করে না। হাতিরঝিল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার পরও রামপুরা খালটিকে পরিকল্পিতভাবে উন্নীত করা হয়নি। শোনা যায় লোকমুখে, হাতিরঝিলের সঙ্গে সমন্বিত করেই রামপুরার খালটিকে নান্দনিক করে তোলার প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। এক অদৃশ্য কারণে হাতিরঝিল থেকে ওই অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নেয়া হয়েছে নতুন প্রকল্প।

সত্য যে কোথায় লুকিয়ে আছে, তা আমাদের জানতে দিচ্ছে না সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও তার স্থানীয় বিভাগ। এবার আমরা ৫৩টি খালের নামই কেবল জানতে চাইছি না। সেই খালগুলো উদ্ধারের পর সেগুলোর উন্নয়ন রোডম্যাপও দেখতে চাই। সেগুলো প্রকাশ্যে আনতে হবে। বাসিন্দাদের চোখের সামনে তা থাকতে হবে।

এবার ভেনিসের কথায় আসা যাক। ছবিতেই আমরা দেখেছি, ভেনিসের খালগুলোর দুই পাড় কেবল বাঁধানোই নয়, সেখানে বসতিদের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। খালের ওপরে নান্দনি ডিজাইনের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে যাতায়াতের সুবিধার জন্য, সড়কের সঙ্গে যোগসূত্র রেখেই। কফিশপ থেকে শুরু করে নানান ধরনের আয়োজন সেখানে আছে।

খালগুলোর দুই পাড়ে বাড়িগুলোর ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে বসবাস আর কফিশপসহ বিভিন্ন রকম পণ্যের দোকান দেওয়া যায় এবং তা মেইনটেইন করা সহজ হয়। এ বিষয় ছাড়াও খালের প্রবাহ, তার পানি যাতে দূষিত না হয়ে পড়ে তার জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্রকল্প চলতে/ থাকতে হবে। প্রকল্প মেইনটেইন করা খুবই সহজ কিন্তু বুদ্ধিনির্ভর কাজ।

খালে প্রবাহ ঠিক রাখা ও পানি দূষণমুক্ত রাখা এর ছোট আকারের নৌযানগুলোর নান্দনিক ডিজাইন করে, চালক বা সেই কোম্পনির চালকদের প্রশিক্ষিত করাও জরুরি। একটি বা দুটি কোম্পানিকে এর দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। ওয়াটার ট্রিটমেন্টের জন্য একটি, নৌযানের জন্য একটিই যথেষ্ট।

ঢাকা মহানগরে যে সব বাস চলাচল করে তারা যদি খালগুলোতে তাদের নৌযান পরিচালনার দায়িত্ব পায়, তাহলে ওই নৌপ্রবাহের বারোটা বাজতে সময় লাগবে না। তারা কেবল দস্যু মার্কাই নয়, অন্যায়কারী, আইন অমান্যকারী সম্প্রদায়। ঢাকা থেকে ওই সব বাস ও সব কোম্পানির চালক হেলপারসহ যাবতীয় কিছু অপসারণ ছাড়া এই মহানগরকে পরিচ্ছন্ন ও ত্রুটিমুক্ত করা সম্ভব নয়। এরা কেবল ট্রাফিক আইন ভাঙতেই ওস্তাদ নয়, সড়কে আবর্জনা নিক্ষেপেও ওস্তাদ। ওই সব শ্রমিক ওস্তাদদের হাত থেকে ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন রাখা ও সড়ক নিরাপদ করার একটাই উপায় তাহলো একটি মাত্র কোম্পানিকে সড়কে বাস চালানোর পারমিশন দেওয়া।

আমরা স্থানীয় সরকারের কাছে যেমন, তেমনি ঢাকার দুই রাজনৈতিক মেয়রের কাছে এই নিশ্চয়তা চাই তারা যেন মহানগর পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টি প্রাধান্য দেন। (নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটান ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (এমটিএ)-এটির মালিক সিটি) আর সেই সঙ্গে ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালানোর শিক্ষাটি কার্যকর করেন। না হলে তাদের দেওয়া ওয়াদা বাগাড়ম্বর বলেই মনে হবে। আমরা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে এতোটাই বাগাড়ম্বর শুনে এসেছি যে ওতে আর বিশ্বাসের রেশটুকুও নেই।

ঢাকার খাল উদ্ধারের যজ্ঞ যেন বালখিল্যের কথা না হয়, সেটাই আমাদের প্রধান চাওয়া। ৫৩টি খাল উদ্ধারে অনেক দিন লাগবে, সেটা আমরা জানি। জানেন মহানগরের গরিব-ধনী সব মানুষ। তবে তা যেন মেগাপ্রকল্পের মতো দশক পেরিয়ে না যায়, সেটা মনে রাখতে হবে। আমরা আজ ক্লান্ত এই উন্নয়নের দীর্ঘসূত্রতায়। কথা ও কাজ যেন সমন্বিত হয়ে এগোয় এটাই হোক তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস

৫৩টি খাল উদ্ধারে অনেক দিন লাগবে, সেটা আমরা জানি। জানেন মহানগরের গরিব-ধনী সব মানুষ। তবে তা যেন মেগাপ্রকল্পের মতো দশক পেরিয়ে না যায়, সেটা মনে রাখতে হবে। আমরা আজ ক্লান্ত এই উন্নয়নের দীর্ঘসূত্রতায়। কথা ও কাজ যেন সমন্বিত হয়ে এগোয় এটাই হোক তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।