পদক বাতিল, কমিটি বহাল!

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ১৯ মার্চ ২০২২

সমালোচনার মুখে মো. আমির হামজার স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল করা হয়েছে। চলতি বছর সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। শুক্রবার আমির হামজার নাম বাদ দিয়ে নতুন করে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নামের তালিকা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সেখানে আমির হামজা ছাড়া আগে ঘোষণা করা সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। একজন মৃত ব্যক্তি, যার নিজের কোনো সুযোগ ছিল না পদক চাওয়ার তাকে দেওয়া হয়েছিল তার পুত্রের জোর তদবির আর প্রচেষ্টায়। সে পুত্র একজন উপ-সচিব যে শ্রেণিটি এখন বাংলাদেশের সবকিছুর হর্তাকর্তা।

আমরা জানি সরকারি কর্মীর কর্তব্য কী? সেটা হলো দেশের মানুষের সেবা। উপ-সচিব মো. আছাদুজ্জামান নিজের ঘরেই সেই বড় সেবার কাজটি সম্পন্ন করতে চেয়েছেন। তদবির আর প্রভাব খাটিয়ে নিজের মৃত বাবাকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছিলেন। তার বাবা আমির হামজাকে সাহিত্যিক হিসেবে বড়, ছোট বা মাঝারি লেখকরা কেউ চেনেন না। বইও আছে কয়েকটি মাত্র এবং একটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। তবে তার যেসব কবিতা এখন পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো কবিতা বলে মানতেও নারাজ তারা।

উপ-সচিবের বাবা আমির হামজা পুরস্কার পেয়েছেন, এ খবর এক আশ্চর্য বার্তা হিসেবে ছড়িয়ে যায় সাহিত্য ভুবনে। এই আমির হাজমা খুনের মামলায় যাবজ্জীবন প্রাপ্ত ছিলেন এবং মারা যাওযার পর তার পুত্রের কল্যাণে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের ভূষিত হলেন, যা কেউ সহজভাবে নিতে পারেনি। ফলে সরব হয়ে ওঠে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম। সরকার বাতিল করতে বাধ্য হয়। কিন্তু যে কমিটি এ কাজ করল তাদের কিছু হবে না? আজ এ প্রশ্ন সর্বত্র।

আমির হামজার ছেলে বলেছেন, তার বাবা কবিয়াল বিজয় সরকারের শিষ্য ছিলেন। বিজয় সরকার পদক পাননি। বারবার নাম আসে বাউল শাহ আবদুল করিমের। তিনিও পান না। শাহ আবদুল করিমের অদূরদর্শিতা যে তিনি তার সন্তানকে একজন উচ্চ পদের আমলা বানাতে পারেননি, শিল্পী হিসেবেই তৈরি করেছিলেন।

আমলারা নিজেরা শিল্প সাহিত্য চর্চা করছেন, সাহিত্য সংস্কৃতির পুরস্কার পদক কারা পাবেন সেটা নির্বাচন করছেন। সেই বিবেচনায় উপ-সচিব মো. আছাদুজ্জামান বড় সচিবদের দিয়ে খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পিতাকে পদক পাইয়ে দিতে যে, ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন তাকে খাটো করে দেখার আবকাশ নেই।

বাংলাদেশ এমন একটা সময় পার করছে যে সময় খুনের মামলায় জেল খাটা আসামিকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক দেওয়া হয় সাহিত্যে অবদানের জন্য। নিশ্চয়ই খুনিও সাহিত্য রচনা করতে পারেন এবং রাষ্ট্র সেই উদারতায় পৌঁছতে পেরেছে। তবে আমির হামজার লেখা কতটা সাহিত্য সেই প্রশ্ন করার সময়ও এটা কি না সেটাও ভাবনার বিষয়।

তবে এদেশের কবি সাহিত্যিকদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এই যে তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের ভ্রান্ত যুক্তি ও অস্বচ্ছ চিন্তা যে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগৎ গিলে খাচ্ছে সেই প্রশ্নটাও করতে পারছেন না। এই তো কিছুদিন আগে, মোদী সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার মুখের ওপর ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। কেন ফেরালেন পুরস্কার?

সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “নব্বই বছরে আমায় শেষে পদ্মশ্রী নিতে হবে? ফোন করে বললেই চলে যাব আমি? শিল্পীদের কোনো সম্মান নেই আর।’ শিল্পীর আত্মমর্যাদাবোধ এমনই হয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও পদক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রত্যাখ্যানের এই নীরব অহঙ্কারে তারা আলোকিত।

যারা নানাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন, নিজ নিজ কর্ম দিয়ে যারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন তাদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার জন্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার মানে ভালো কাজের স্বীকৃতি। প্রশ্ন হলো আমির হামজার গান কি বাঙালি জাতির বৃহত্তর অংশকে প্রভাবিত করেছে? নাড়া দিতে পেরেছে?

বাউলশিল্পী শাহ আবদুল করিমের গান আজ সীমানা পেরিয়ে বাঙালির মুখে মুখে। তার গান ছাড়া কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই হয় না। হেন বাঙালি নেই, যে তার গান শোনেনি। তাকে বাদ দিয়ে বাংলা গানের ইতিহাস লেখা যাবে না। তিনিও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক। না গান, না সাহিত্য, না মুক্তিযুদ্ধ– কোন ক্যাটাগরিতেই তিনি যোগ্য বিবেচিত হন না। কারণ, তার সন্তান প্রভাবশালী নয়, উঁচু শ্রেণির কেউ নেই তার কথা বলার।

আমাদের সমাজে পুরস্কার পদক বা কিছু পাওয়ার জন্য মানুষ মরিয়া। কতটা ভালো কাজ করছেন সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় রাজনীতি বা ক্ষমতার প্রভাব কাজে লাগিয়ে পুরস্কার বা পদক বাগিয়ে নেওয়া। দু-একজন মানুষ মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রম বা তাদের কথা আলাদা। কিন্তু তারা তো ব্যতিক্রমই। মূলধারাটা এখন বদলে গেছে; যা তোষামোদী লবিং আর স্তাবকতায় পরিপূর্ণ।

এমন একটা বাস্তবতায় পদক বা পুরস্কার যে মানের হওয়ার কথা সেটাই হচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ দিক যেটা তা হলো, দরখাস্ত দিয়ে তাতে সুপারিশ লিখিয়ে পদক পেতে হয়। এই প্রাপ্তি ভিক্ষের চেয়েও হীন বলেই মনে করছেন আসল লেখকরা। কিন্তু সেই স্বীয় মর্যাদাবোধই আজ লুপ্ত।

একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক নিয়ে মাঝে মধ্যেই বিতর্ক ওঠে। ২০২০ সালে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। সে বছর সাহিত্যে মুক্তিযোদ্ধা এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের না ছিল প্রাপ্তদের তালিকায়। কিন্তু নাম ঘোষণার পর থেকেই সাবেক এই আমলার সাহিত্যে অবদান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও অনেকে তীব্র সমালোচনা করে মন্তব্য করেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রকাশিত হয়। এমন প্রেক্ষাপটে তার নাম বাদ দিয়ে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করতে বাধ্য হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। রইজ উদ্দিনের বেলায় যা, আমির হামজার বেলায়ও তাই। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য যদি দিতে হয় তবে তা-ই হোক। সাহিত্যে দিতে হবে কেন?

সামান্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগেও যেখানে একজন ব্যক্তির বংশ পরম্পরার সব খবর নেওয়া হয়; যাবতীয় আমলনামার অনুসন্ধান করা হয়, সেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে রাষ্ট্র কোনো ধরনের খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করবে না? উপ-সচিব আবেদন করবেন আর সচিব সাহেবের সুপারিশে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কারটি এভাবে দিয়ে দেওয়া যায়?

পুরস্কার বাতিল হলেও যেনতেন ভাবে, যাকেতাকে পদক ও পুরস্কার দেওয়ার সংস্কৃতি বাতিল হয়নি।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।

এইচআর/এমএস

সামান্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগেও যেখানে একজন ব্যক্তির বংশ পরম্পরার সব খবর নেয়া হয়; যাবতীয় আমলনামার অনুসন্ধান করা হয়, সেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে রাষ্ট্র কোনো ধরনের খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করবে না? উপ-সচিব আবেদন করবেন আর সচিব সাহেবের সুপারিশে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কারটি এভাবে দিয়ে দেওয়া যায়?

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।