শীতকালীন অলিম্পিকে চীনের বিস্ময়কর সাফল্যের নেপথ্য কথা
খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ আমার ছেলেবেলা থেকেই। গ্রামে কেটেছে বাল্যকাল; খেলেছি গ্রামীণ প্রায় সব খেলা। জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলার অভিজ্ঞতাও আছে। ক্লাস ফোর অব্দি গ্রামের স্কুলে খেলাপড়া করে, চলে আসি ঢাকায়। শহরে এসে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলেছি এন্তার। ক্রিকেট খেলার সময় প্যাড, গ্লাবস, কাঠের বল ব্যবহারের সুযোগ পেলেও, আধুনিক পিচ বলতে যা বোঝায়, তাতে খেলার সুযোগ পাইনি বললেই চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের হয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের বিরুদ্ধে আধুনিক পিচে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম প্রথম ও শেষবারের মতো।
খেলাধুলায় আমার অর্জন তেমন কিছু নেই। ক্রিকেট, দাবা, ব্যাডমিন্টন ভালো খেলতাম। এসব খেলে যাকিছু অর্জন করেছি, তা উল্লেখ করার মতো নয়। তবে, খেলাধুলা, বিশেষ করে ক্রিকেট নিয়ে ইত্তেফাকের পাতায় বিস্তর লেখালেখি করে আমি প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও ইত্তেফাকের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রাহাত খানের কাছে ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটের সোল এজেন্ট’ উপাধি পেয়েছিলাম।
এটাকে উল্লেখ করার মতো অর্জন বলে আমার বরাবরই মনে হয়েছে। ক্রিকেটের জন্য আলাদা স্টেডিয়াম চেয়ে প্রকাশিত আমার লেখাগুলো মিরপুর জাতীয় স্টেডিয়ামকে শেষপর্যন্ত ক্রিকেট স্টেডিয়াম হতে কতোটা সাহায্য করেছিল, সেটা বলতে পারব না; তবে, বেশ মনে আছে, দেশের ক্রিকেটের ভালো ও মন্দ—উভয় সময়েই আমার কলম ছিল ক্রিকেটের পক্ষে।
লিখতে হলে জানতে হয়, খোঁজখবর রাখতে হয়। আমাকে এর জন্য আলাদা করে কষ্ট করতে হতো না। কারণ, আমি এমনিতেই টিভির পর্দায় খেলা দেখতাম; টেস্ট, ওয়ানডে— সব। ক্রিকেট আসার আগে দেশের ফুটবল নিয়ে অন্য সবার মতো আমারও আগ্রহ ছিল। আবাহনী-মোহামেডান খেলা নিয়ে ক্রেজও ছিল। কিন্তু ক্রিকেটের উত্থান অনেকের মতো আমাকেও ফুটবলবিমুখ করে দেয়। অবশ্য বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসলে আমিও মোটামুটি এক মাসের জন্য টিভির সামনে বসে যেতাম! সারারাত জেগে যে কতো ফুটবল দেখেছি, তার ইয়ত্তা নেই।
চার বছর পর পর অলিম্পিকের আসর বসে। অলিম্পিক নিয়েও বরাবর আগ্রহ ছিল। সুযোগ পেলে টিভির পর্দায় খেলা দেখতাম। সার্গেই বুবকা, কার্ল লুইসদের ক্রীড়ানৈপুণ্য আজও চোখের সামনে ভাসে। অলিম্পিক বলতে তখন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিককেই বুঝতাম। শীতকালীন অলিম্পিক বা প্যারা অলিম্পিক দেখার সুযোগ তখন কম ছিল। যতদূর মনে পড়ে, টিভিতে শীতকালীন অলিম্পিক ও প্যারা অলিম্পিক খুব কমই দেখা যেতো।
আমি চীনে আসি ২০১২ সালে, আর চীন ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিক ও প্যারা অলিম্পিক আয়োজনের সুযোগ পায় ২০১৫ সালে। তখন থেকেই স্টেডিয়ামে বসে সরাসরি অলিম্পিক দেখার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। এ স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রথম শর্ত ছিল ততদিন পর্যন্ত চীনে থাকা। সে-শর্ত পূরণ হয়েছিল। কিন্তু মহামারি এসে সব এলোমেলো করে দিল। আমি বেইজিংয়েই থাকলাম, অলিম্পিকও বেইজিংয়েই আয়োজিত হলো, কিন্তু স্টেডিয়ামে বসে অলিম্পিক দেখার স্বপ্ন আমার পূরণ হলো না!
স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখতে না-পারলেও, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো, টিভির পর্দায় অলিম্পিক দেখেছি; কখনও লাইভ, কখনও রেকর্ডকৃত অংশবিশেষ। চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)-র সিসিটিভি-র স্পোর্টস চ্যানেলে অলিম্পিকের বিভিন্ন ইভেন্ট লাইভ দেখিয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত চলেছে এই লাইভ সম্প্রচার। শীতকালীন অলিম্পিক দিয়ে শুরু হয়েছিল, শেষ হয়েছে শীতকালীন প্যারালিম্পিক দিয়ে। টিভির পর্দায় চীনা ক্রীড়াবিদদের নৈপুণ্য দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়েছি।
আশা করেছিলাম, চীনা ক্রীড়াবিদরা ভালো করবেন; আমার সেই আশাবাদ আগের এক লেখায় প্রকাশও পেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে চীনা ক্রীড়াবিদদের নৈপুণ্য ছিল আশাতীত, রীতিমতো তাক লাগানো। বিশেষ করে প্যারালিম্পিকে চীনা ক্রীড়াবিদরাও বলতে গেলে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন।
বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের সবচেয়ে আলোচিত ক্রীড়াবিদ ছিলেন ফ্রিস্টাইল স্কিয়ার কু আইলিং (Gu Ailing)। ১৮ বছরের কু আইলিং একাধিক কারণে গোটা প্রতিযোগিতাজুড়ে আলোচনায় ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম নেওয়া প্রতিভাবান এই মেয়েটি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। কিন্তু ২০১৯ সালে তিনি মাতৃভূমি চীনের (তাঁর মা চীনা) হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি ৮ বার চ্যাম্পিয়ন, ৩ বার রানার আপ ও একবার তৃতীয় হন। এর মধ্যে চারটি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় খোদ যুক্তরাষ্ট্রে।
হয়তো ২০১৯ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে কু আইলিং-য়ের ‘দেশপ্রেম’ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সেগুলো তেমনভাবে উঠে আসেনি, বা এলেও আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু শীতকালীন অলিম্পিকের সময় যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল গণমাধ্যমগুলো তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। ফক্স নিউজের এক আলোচক তো এমনটা পর্যন্ত বললেন যে, কু আইলিং যুক্তরাষ্ট্রে যে-মানের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, সে-মানের প্রশিক্ষণ আর কোনো দেশে পাওয়া যাবে না। তিনি কু-কে ‘সুযোগসন্ধানী’ বলেও আখ্যায়িত করলেন। এদিকে, খোদ বেইজিংয়েও কু আইলিংকে পাশ্চাত্যের সাংবাদিকদের তির্যক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি অবশ্য খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আর প্রতিযোগিতায় তাঁর পারফরমেন্সও প্রমাণ করেছে যে, তিনি সমালোচনার চাপে এতোটুকু আত্মবিশ্বাস হারাননি।
শীতকালীন অলিম্পিকশেষে পদকতালিকার দিকে তাকালে মার্কিন রক্ষণশীল গণমাধ্যমগুলোর গাত্রদাহের কারণটা উপলব্ধি করা যাবে। পদকতালিকায় তৃতীয় স্থানটি চীনের। চীন পেয়েছে মোট ৯টি স্বর্ণপদক। এর ঠিক পরেই ৮টি স্বর্ণ নিয়ে চতুর্থ স্থানে যুক্তরাষ্ট্র। আবার, চীনের ৯টি স্বর্ণের মধ্যে ২টি এনে দিয়েছেন কু আইলিং! তিনি বেইজিং অলিম্পিকে একটি রৌপ্যপদকও পেয়েছেন। শীতকালীন অলিম্পিকের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে ফ্রিস্টাইল স্কিয়িংয়ে স্বর্ণপদক জিতেছেন তিনি। পাশাপাশি, তিনিই একমাত্র স্কিয়ার যিনি একটি অলিম্পিকে তিন-তিনটি পদক জিতলেন!
২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকের পদকতালিকায় স্থান পাওয়া শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে নাম ছিল না চীনের। এদিকে, বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের আগে মোট ২৩টি শীতকালীন অলিম্পিকে চীনের মোট অর্জন ছিল মাত্র ১৩টি স্বর্ণপদক। সে হিসেবে, কু আইলিংয়ের দুটি স্বর্ণপদক যদি তর্কের খাতিরে বাদও দিয়ে দিই, চীনের স্বর্ণ থাকে ৭টি, যা উল্লেখযোগ্য সাফল্য। চীন এবার ৪টি রৌপ্য ও ২টি ব্রোঞ্জপদকও পেয়েছে।
তবে আসল খেলা দেখিয়েছেন চীনের প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদরা। তাদের ক্রীড়া-নৈপুণ্যের কাছে এমনকি কু আইলিংয়ের নৈপুণ্যও যেন হার মেনেছে। হ্যাঁ, বেইজিং শীতকালীন প্যারালিম্পিকে চীনা ক্রীড়াবিদদের মধ্যে কোনো কু আইলিং ছিলেন না। তারপরও, প্যারালিম্পিকের পদকতালিকার শীর্ষে জ্বল জ্বল করছে চীনের নাম! চীনের প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদরা ১৮টি স্বর্ণ, ২০টি রৌপ্য ও ২৩টি ব্রোঞ্জপদক উপহার দিয়েছেন প্রিয় স্বদেশকে। পদকতালিকার দ্বিতীয় স্থানটি পেয়েছে যুদ্ধকবলিত ইউক্রেন। সে-দেশের প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদরা স্বদেশের জন্য জয় করেছে ১১টি স্বর্ণ, ১০টি রৌপ্য ও ৮টি ব্রোঞ্জ। তালিকায় তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানগুলো হচ্ছে যথাক্রমে কানাডা (৮টি স্বর্ণ), ফ্রান্স (৭টি স্বর্ণ), ও যুক্তরাষ্ট্রের (৬টি স্বর্ণ)।
শীতকালীন প্যারা অলিম্পিকে চীনের আগের পারফরমেন্স সম্পর্কে যাদের ধারণা নাই, তাদের পক্ষে বেইজিং শীতকালীন প্যারা অলিম্পিকে চীনা প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের অর্জনের বিশালত্ব আন্দাজ করা মুশকিল। আর তাদের মধ্যে যারা গ্রীষ্মকালীন প্যারা অলিম্পিকে চীনের অর্জন সম্পর্কে জানেন, তাদের জন্য বিষয়টা আরও কঠিন। গ্রীষ্মকালীন প্যারা অলিম্পিকের প্রথম আসর বসেছিল ১৯৬০ সালে, রোমে। এর পর একে একে আরও পাঁচটি গ্রীষ্মকালীন প্যারা অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়, যেগুলোর একটিতেও চীন অংশগ্রহণ করেনি। চীন প্রথম গ্রীষ্মকালীন প্যারা অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে ১৯৮৪ সালে। সেবার ২টি স্বর্ণপদক জেতে চীনা প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদরা। এরপর আরও চারটি গ্রীষ্মকালীন প্যারা অলিম্পিকে অংশ নিয়ে দেশটি যথাক্রমে পদকতালিকার ১৫, ১০, ৯, ও ৬ নম্বর স্থান দখল করে। তবে, ২০০৪-এর এথেন্স গ্রীষ্মকালীন প্যারা অলিম্পিক থেকে শুরু হয় চীনের জয়যাত্রা। এথেন্স থেকে টোকিও—টানা ৫টি গ্রীষ্মকালীন প্যারা অলিম্পিকে চীন পদকতালিকার শীর্ষ স্থান দখল করে।
শীতকালীন প্যারা অলিম্পিকে চীনের ফলাফল এতোদিন ছিল ঠিক উল্টো। বিশ্বে শীতকালীন প্যারা অলিম্পিকের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, সুইডেনে। তারপর একে একে আরও ৬টি শীতকালীন প্যারালিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেগুলোর একটিতেও চীন অংশগ্রহণ করেনি। চীনের ক্রীড়াবিদরা প্রথম শীতকালীন প্যারা অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেন ২০০২ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের সল্ট লেক সিটিতে। সেবার চীন কোনো পদক পায়নি। তারপর একে একে আরও ৩টি গেমসে অংশ নিয়েও কোনো পদক জিততে পারেননি চীনের প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদরা। ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার পিয়ংছাংয়ে আয়োজিত শীতকালীন প্যারা অলিম্পিকে চীন প্রথম ও একমাত্র পদকটি জয় করে। ঘটনাক্রমে সেটি ছিল স্বর্ণপদক! পদকটি জিতেছিল চীনের মিশ্র হুইলচেয়ার কার্লিং দল (দলে তিন জন পুরুষ ও এক জন নারী)। সেবার চীনের অবস্থান ছিল পদকতালিকায় ২০ নম্বরে।
হ্যাঁ, পাঠক ঠিকই পড়েছেন ও বুঝেছেন! বেইজিং শীতকালীন প্যারা অলিম্পিকের আগে চীনা প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদরা শীতকালীন প্যারা অলিম্পিকে মাত্র একটি পদক জিতেছিলেন! মজার ব্যাপার হচ্ছে, পিয়ংছাং গেমসে স্বর্ণজয়ী মিশ্র হুইলচেয়ার কার্লিং দলটি এবারও স্বর্ণপদক জিতেছে। পার্থক্য এটুকু যে, চীনের ঝুড়িতে এবার আরও ১৭টি স্বর্ণসহ ৬০টি পদক যুক্ত হয়েছে; চীন এক লাফে পদকতালিকার ২০তম স্থান থেকে উঠে এসেছে প্রথম স্থানে। এ অর্জনকে, চীনের প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের এই অর্জনকে, বিস্ময়কর বললেও কম বলা হবে।
লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।
[email protected]
এইচআর/এমএস