পণ্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া এবং বিকল্প বাজারব্যবস্থা
সংবাদপত্রের নিয়মিত খবরে পরিণত হয়েছে ভোজ্যতেল মজুত ও জরিমানা। যেগুলো অনুসন্ধানী দল গিয়ে ধরছে এবং জরিমানা করছে, সেই খবরই আমরা জানতে পারছি। আসলে দেশে একশ্রেণির মানুষ অতি মুনাফার লোভে এই তেলবাজি করে চলেছে। যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, সাথে সাথে তার মজুতের প্রতিযোগিতা বাড়ে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় কতটা প্রভাব ফেলেছে তা টিসিবির গাড়ির সামনে দীর্ঘ লাইন দেখেই ধারণা করা যায়। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে খোলাবাজারে ভোজ্যতেলের দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিল। বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার ভ্যাট কমানোর ঘোষণা দেয়। অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আরোপিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগেই ১০ শতাংশ শুল্ক কমানো হয়েছে। তা ১৫ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ আছে। ছোলার আমদানি শুল্ক ছিল না।
সরকার ভ্যাট কমানোর ঘোষণা দিলেও বাজারে তার প্রভাব কতটা পড়েছে? গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বাজারে তেলের ‘দাম কমেছে মুখে মুখে, বাস্তবে কমেনি’। ভ্যাট কমানোর ঘোষণা দেওয়ার পরও বাজারে কোথাও বোতলের গায়ে লেখা দামে, কোথাও লেখার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে সয়াবিন তেল।
কিছু ব্যবসায়ী দাবি করছেন, গায়ের দামেই তারা কোম্পানির কাছ থেকে কিনে আনছেন। তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। শুধু তেল নয়, সব ধরনের পণ্যের দামই বাড়তির দিকে। চাল-ডাল বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। সবজির দামও বেশি। সাধারণ মানুষ দুষছে সরকারকে। বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, এমন কথাই বলা হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে, বাজারে সরকারের আদৌ কোনো নজরদারি আছে কি না। যথাযথভাবে বাজার মনিটর করা হচ্ছে কি না, এটাই একটা বড় প্রশ্ন। অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। এটাই বড় কথা। এটাই বাস্তব।
স্বাভাবিকভাবেই ভিড় বাড়ছে টিসিবির ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রে। একসময় সরকারি ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রে নিম্ন আয়ের মানুষের লাইন দেখা যেত। কিন্তু এখন মধ্যবিত্তদেরও লাইনে দেখা যাচ্ছে। আমার পরিচিত অনেকেই অপেক্ষাকৃত কম বেতনে চাকরি করেন। তারা এখন সরকারি ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রে লাইন দিয়ে পণ্য কেনেন।
টিসিবি সূত্রে জানা যায়, খোলা ট্রাকে পণ্য বিক্রি গত বছরের তুলনায় আড়াইগুণ বেড়েছে। টিসিবির পণ্য বিক্রি এমন জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকলে, আমাদের বুঝতে অসুবিধা হবে না যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কেমন চলছে। কোন পর্যায়ে চলে এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, দোকানদার ও ব্যবসায়ীরাও তাদের লোক লাইনে দাঁড় করিয়ে পণ্য কিনছেন। কারণ টিসিবির পণ্য কিনে তারা বাজারমূল্যে বিক্রি করলে অধিক লাভ করতে পারছেন। স্থানীয় দোকানদার ও ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত লোক লাইনে দাঁড় করিয়ে টিসিবির পণ্য কেনাচ্ছেন। এতে অনেক সাধারণ ক্রেতা বঞ্চিত হচ্ছেন। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও তারা পণ্য পাচ্ছেন না।
মধ্যম আয়ের দেশ বাংলাদেশ। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আগামী অর্থবছর আমাদের মাথাপিছু আয় আরও বেড়ে হবে তিন হাজার ৮৯ মার্কিন ডলার।’ হয়তো তখন এই বর্ধিত মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাজারে দ্রব্যমূল্য কয়েক ধাপ বেড়ে যাবে। টিসিবির ট্রাকে ন্যায্যমূল্যের পণ্য কেনার লাইনও হয়তো আরও লম্বা হবে। সেটাও ভাবতে হবে।
এখন বাজার সামাল দিতে নজরদারির কোনো বিকল্প নেই। ভোক্তা অধিকার যে অভিযান শুরু করেছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। টিসিবির পণ্য বিক্রির আওতা আরও বাড়াতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রির যে সূচনা হয়েছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে গ্রামে গ্রামে নিয়ে যেতে হবে টিসিবির পণ্য বিক্রির সেবা।
বিকল্প বাজারব্যবস্থা ছোট আকারে হলেও এভাবে গড়ে তুলতে পারলে বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য কমবে। তাতে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ভোক্তাদের স্বস্তি দেওয়া যাবে। সেই সাথে প্রতিটি পরিবারের জন্য কার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা লেখা থাকবে। সেই অনুপাতে পণ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
কথা হচ্ছে, সবার আগে সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে হবে। একথা আজ নিন্দুকেরাও বিশ্বাস করে যে, শেখ হাসিনাকে দেশের মানুষ বিশ্বাস করে। তার প্রতি দিন দিন মানুষের আস্থা-ভরসা বাড়ছে। ২০০৮ সালে নির্বাচনের পরে তিনি বলেছিলেন, ‘জানতে চাই আমার চেয়ে দেশের মানুষকে কে বেশি ভালোবাসে।’
এত দিনে দেশের মানুষ সে প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে। করোনাকালে যে ভাবে সরকার মানুষের পাশে ছিল। নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া দামে দুর্গতিতে পড়া মানুষের পাশেও সরকার সেইভাবে থাকবে। এটাই সবার আশা।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম