সেই মার্চ আর এই মার্চ

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ০৯ মার্চ ২০২২

প্রতি বছরই মার্চ মাস আসে। তবে সব বছরের সব মার্চ এক রকম নয়। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের পর থেকে বাঙালির জীবনে মার্চ আসে এক জাগরণের বাণী নিয়ে। ঐক্য এবং পরিবর্তনের দমকা হাওয়া বয়েছিল একাত্তরের মার্চে। ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম দিনটিই যে অমন আগুনের ফুলকি ছড়াবে সেটা কি কেউ ভেবেছিল?

দুপুরে জানা যায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। অধিবেশন স্থগিত হওয়া মানে সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত করা। শাসকগোষ্ঠীর বদমতলব বুঝতে বেগ পেতে হয়নি বাঙালি জাতির। ততদিনে বাঙালি কাতারবন্দি হয়েছে শেখ মুজিবের পেছনে। অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের সংগ্রামে আর ছাড় নয়। নেতা ঘোষণা দেওয়ার আগেই জনতা স্লোগান তুলেছে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। অধিবেশন স্থগিত হওয়ার প্রতিবাদে মানুষ রাজপথে নেমে আসে। বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত থাকে না। শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে উত্তাপ। বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলে গুলি চলে। মৃত্যুর তালিকা লম্বা হতে থাকে। স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট চলতে থাকে। জনতার সাগরে উর্মি জাগলে তা কি আর বালির বাঁধ দিয়ে রোধ করা যায়? মার্চের প্রথম দিন থেকে ষষ্ঠ দিন পর্যন্ত এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, গোঁজামিল দিয়ে আর সামাল দেওয়া যাবে না পরিস্থিতি।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবেন ওই জনসভা থেকে – এটা প্রচার হয়ে যায় সারাদেশে। তখন আমি কলেজ ছাত্র, ঢাকা থেকে অনেক দূরে উত্তরের এক প্রান্তে থাকি। তবে ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় রাজনৈতিক খবরাখবর রাখি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দুপুর থেকেই বসেছিলাম রেডিওর সামনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য।

রেসকোর্স ময়দান থেকে ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচারের কথা ছিল। কিন্তু সন্ধ্যা হলেও ভাষণ আর প্রচার হয় না। আমরা উদ্বিগ্ন। এক সময় ঢাকা বেতারই চুপ হয়ে গেলো। মানুষ নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু করে দেয়। কী হলো ঢাকায়, কী হতে পারে? বঙ্গবন্ধু কী স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন? তিনি কি গ্রেফতার হয়েছেন? ঢাকা কি বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছে? কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেওয়ার কেউ নেই।

রাত কাটলো গভীর উৎকণ্ঠায়। সকালে জানা গেলো, রেডিওতে গতকাল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে দেওয়া হয়নি। সকালে সেই ভাষণ প্রচার হবে। রেডিওর বাঙালি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কলাকুশলীদের প্রতিবাদের মুখে পাকিস্তানিরা নত হতে বাধ্য হয়েছে।

মানুষ যাতে ভালোভাবে ভাষণটি শুনতে পারে সেজন্য আওয়ামী লীগ সমর্থক আব্দুল লতিফ নামের একজন প্রাইমারি শিক্ষক বোদা বাজারে তার বইয়ের দোকানে মাইক লাগালেন। চারদিক থেকে শত শত মানুষ এসে জড়ো হতে লাগলো বাজারে। সবাই কান খাড়া করে রেডিও শোনার অপেক্ষায়।

একসময় ভেসে এলো সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠ ‘ভাইয়েরা আমার’, অতো মানুষ অথচ পিনপতন নীরবতা। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো সেই ভাষণ। ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতার সে কী উল্লাস! জয় বাংলা স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে গোটা বাজার। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ধ্বনি দিয়ে শুরু হয় মিছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের সেই মহাকাব্যিক ভাষণটি ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বমানবের সম্পদে পরিণত হয়েছে।

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এই বজ্রকণ্ঠ বাণী ছিল কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি যদি হুকুম দেওয়ার নাও পারি, তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ...রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।
বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন।

আজ মুক্ত স্বদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কি আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছি? বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার লক্ষ্যে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তাকে হত্যা করে আমরা হাঁটছি বিভেদ ও অনৈক্যের চোরাগলিতে।

দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তা আমাদের এতটাই মূঢ় করেছে যে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে নিয়ে বিতর্ক করতেও অনেকের বিবেকে বাধে না। যারা ক্ষুদ্র তারা বড়ো কিছু দেখতে চায় না। কিন্তু যিনি বড়ো তাকে ছোট করে সাধ্য কার? বাংলাদেশ, বাঙালি এবং বঙ্গবন্ধু- এক এবং অভিন্ন।

দুই.
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। নয় মাস অসম সাহসিকতার সঙ্গে মরণপণ লড়াই করে ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতায় আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ৫০ বছর পূর্ণ করছি। স্বাধীনতা হীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। কিন্তু স্বাধীনতা মানে আসলে কি? সাধারণভাবে কারও অধীনতা না মানাই স্বাধীনতা। বেঁচে থাকার, চলার এবং বলার স্বাধীনতা না থাকলে জীবন অর্থবহ হয় না। বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়াক, আমরা এটা যেমন চাই পাশাপাশি নাগরিক হিসেবেও আমরা রাষ্ট্রের কাছে স্বাধীনতা চাই। অবাধে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা। মত প্রকাশ করবার স্বাধীনতা। বৃত্তি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা।

স্বাধীনতা আসলে একটা অনুভূতি। জীবনযাপনের একটা বহিঃপ্রকাশ। কারও কাছে সেটা রাজনৈতিক হতে পারে, কারও কাছে সামাজিক, আবার কারও কাছে সেটা হতেই পারে একান্ত ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার। কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানুষের কাছে এর অর্থ হলো মুক্ত হয়ে জীবনযাপন করা। যেটা তার পছন্দ নয় সেটাকে সরাসরি ‘না’ বলে নিজের মতো এগিয়ে যাওয়া!

তবে সবাই যদি নিজের মন মতো, নিজের ইচ্ছে মতো চলতে চায়, তাহলে একটা চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। সৃষ্টি হবে অকল্পনীয় এক নৈরাজ্যের! সেটা যাতে না হয় তাই রাষ্ট্র প্রবর্তন করেছে নানা বিধিনিষেধ, নিয়মকানুন, আইনি কাঠামো। কারণ, ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মানুষের নিজের শুভবুদ্ধির ওপর সবটা ছাড়ে দিলে সব সময় খুব একটা ভালো ফল পাওয়া যায় না। কারণ প্রাণী হিসেবে মানুষের জন্মগত স্বার্থপরতা অন্যের স্বাধীনতার পরিপন্থি। তাই বৃহত্তর স্বার্থে রাষ্ট্রকেই হাতে তুলে নিতে হয়েছে তার দেশের মানুষকে স্বাধীন রাখার দায়িত্ব!

অর্থাৎ এটা বোঝা যাচ্ছে যে, প্রকৃত অর্থে কিন্তু কেউই স্বাধীন নয়। সবাইকেই কিছু না কিছু নিয়ম মেনে চলতেই হয়। কিন্তু যেহেতু সেটা আমাদের জীবনযাপনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে কোনো রকম ছন্দপতন ঘটায় না, আর আমরা এটাও বুঝি যে এসব নিয়মকানুন থাকার জন্য একটা শান্তিশৃঙ্খলার পরিবেশ বজায় থাকে, তাই এই ‘নিয়ন্ত্রিত’ স্বাধীনতা আমরা মেনে নিয়েছি। আর রাষ্ট্রও মেনে নিয়েছে অন্যকে ক্ষতি না করে নিজের মত প্রকাশ করার অধিকার ও ‘না’ বলার অধিকার।

কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে সেটা কতটা পালিত হচ্ছে? আমরা কি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি? সত্যি কথা স্বাধীনভাবে বলার আগে মানুষ ভাবছে আদৌ এসব বলা ঠিক হবে কি না! বললে না জানি কী বিপদ ঘনিয়ে আসে! বর্তমানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিসর অদ্ভুত ভাবে পালটে যাচ্ছে! একটা বিশেষ শ্রেণিই ঠিক করে দিচ্ছে মানুষের আচার-আচরণ কী হবে!

অথচ স্বাধীনতা ইট-কাঠ-পাথর নয়, স্বাধীনতা একটা জীবন দর্শন, একটা বাঁচার ভঙ্গিমা! সেটার সার্বিক পুনরুজ্জীবন একান্ত দরকার। যে বিরুদ্ধ মত পোষণ করছে সে-ও যে দেশের ভালো চায়, নানা কাজের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরিয়ে দিয়ে তা শোধরাতে চায়, সেটা বোঝার মতো মনের প্রসারতা থাকা দরকার! অন্যের মতকে গুরুত্ব দেওয়া, তাকে ‘না’ বলতে দেওয়ার মতো পরিসর তৈরি করাই তো আসলে স্বাধীনতা! সেটা না হলে, যতই মহাকাশে স্যাটেলাইট যাক আমরা কিন্তু সেই মধ্য যুগের অন্ধকারের দিকেই পিছিয়ে যাবো। অন্ধকারের পথযাত্রা রোধে স্বাধীনতা হোক আলোর ঝরনাধারা।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/ফারুক/এমএস

স্বাধীনতা একটা জীবন দর্শন, একটা বাঁচার ভঙ্গিমা! সেটার সার্বিক পুনরুজ্জীবন একান্ত দরকার। যে বিরুদ্ধ মত পোষণ করছে সে-ও যে দেশের ভালো চায়, নানা কাজের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরিয়ে দিয়ে তা শোধরাতে চায়, সেটা বোঝার মতো মনের প্রসারতা থাকা দরকার! অন্যের মতকে গুরুত্ব দেওয়া, তাকে ‘না’ বলতে দেওয়ার মতো পরিসর তৈরি করাই তো আসলে স্বাধীনতা!

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।