নারী পুরুষের বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ চাই
জেসমিন সুলতানা
‘টেকসই আগামীর জন্য/জেন্ডার সমতার আজ অগ্রগণ্য’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এবারের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে। ১৮০৭ থেকে ১৯১৪ দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল আজকের দিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর নিজেকে নিয়ে আলাদা করে চিন্তা করার, ভাবার, নিজেদের অধিকারকে চিন্তাচেতনা ও মননে ধারণ করার একটি দিন।
১৮০৭ সালে কর্মজীবী নারীদের শিল্প কারখানায় সময় কাটানো, তাদের প্রতি মানবিক আচরণ বিধির প্রয়োগ, শ্রম মজুরির বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছিল নারীরা। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্রেট নারী সংগঠন এক সমাবেশের আয়োজন করে এতে নেতৃত্ব দেয় সমাজতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কর্মী ক্লারা জেট কিন।
১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে বিশ্বের ১০০টি দেশ অংশগ্রহণ করে, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার দাবি জানানো হয় অবশেষে ১৯১৪ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মর্যাদা দেওয়া হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে দিবসটির মর্যাদা উপলব্ধি করে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে পালন করে আসছে। তবে, দিবসটির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ছুটি ঘোষণা করা হয়নি যদিও অনেক দেশ তাদের দেশে নারীর প্রতি সন্মান দেখিয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে।
১৮০৭ থেকে ২০২২ দীর্ঘ পথ পাড়ি প্রায় ২১৪ বছর নারী কি অনেক এগিয়ে, একই অবস্থানে? না অনেক পিছিয়ে। ১৮০৭ সালের দাবি, প্রেক্ষাপট, অবস্থা, অবস্থান এখনকার সময় থেকে অভিন্ন নয়, মনে হয় একই চিত্র আজও বিরাজমান। ২০২২ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশে আমরা কতটুকু সমৃদ্ধ হয়েছি, কতটুকু দাবি আদায় করতে পেরেছি? আন্দোলন, সংগ্রাম, দাবি আদায়ে কতোটা ভূমিকা পালন করছি কৃতকার্য হতে পারছি তা ভাবার বিষয়। আমরা যেহেতু আইনপেশায় জড়িত তাই আইন অঙ্গনের নারীদের অবস্থানের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত, দেশের উচ্চ আদালতের নারী বিচারপতি মহোদয় প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। নিজেদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সমাজের উচ্চস্তরে প্রতিষ্ঠিত। বিচারাঙ্গনের মতো কঠিন জায়গায় নির্ভীক দায়িত্ব পালন ও ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে তারা বিচারাঙ্গনে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন।
আপিল বিভাগে প্রথম নারী বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে নারী বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম বিচার বিভাগে নারীদের নিয়োগ নিশ্চিত করার ফলে ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ (সহকারী বিচারক) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন মাননীয় বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
প্রথম নারী জেলা জজ হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান, ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি আপিল বিভাগে দায়িত্ব পান। ২০১৭ সালে অবসরে যান বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। বর্তমানে জুডিসিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এরপর আপিল বিভাগে নিয়োগ পান মাননীয় বিচারপতি জিনাত আরা। তিনিও একজন ন্যায়বিচারক ছিলেন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে অবসরে গেছেন। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন মাননীয় বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ।
আপিল বিভাগের তিনি তৃতীয় নারী বিচারপতি। নিশ্চয়ই তিনি তার শিক্ষা মেধা, মননকে কাজে লাগিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগেও বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন ছয় নারী বিচারপতি। ৪৬ বছর আগে দেশে নারী বিচারক ছিলেন মাত্র একজন। তবে বিচারিক ও উচ্চ আদালত মিলিয়ে বর্তমানে নারী বিচারকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২৯-এ। এর মধ্যে বিচারিক আদালতে আছেন ৫২২ জন বিচারক।
অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাংলাদেশের একজন অ্যাটর্নি জেনারেল, তিনজন এডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল পুরুষ আইনজীবী, ডিপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ৬৫ জন পুরুষ আইনজীবী ১২ জন নারী আইনজীবী। অ্যাসিস্টান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল ১৫০ জনের মাঝে ৫০ জন নারী আইনজীবী।
পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রের মতোই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর রচিত হয় একই সনের ১৬ ডিসেম্বর তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশের সংবিধান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। এখানে মানুষের মৌলিক অধিকারসহ নারীর অধিকারগুলো বিভিন্ন অনুচ্ছেদে অত্যন্ত সুনিপুণ ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা নারীর আপন সত্তাকে উদ্ভাসিত করে। আমরা গর্বিত হই।
বাংলাদেশের সংবিধান নারীর অধিকারের প্রতি এক অসাধারণ স্বীকৃতি। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নারী-পুরুষে বৈষম্য করার কোনো সুযোগ নেই।
– সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’।
– সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না’।
– সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’।
– সংবিধানের ২৮ (৩) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী- পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না’।
– সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, ‘নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না’।
– সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের সমতা থাকবে’।
– সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারীপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না। – সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ৯ অনুচ্ছেদের অধীনে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের উন্নয়নে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। নারী দের শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা,ক্ষমতা থাকার পরও নারী আজ বৈষম্যের শিকার। প্রতিবাদ করার কেউ নেই সবাই কেমন যেন ভোঁতা,অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছি।
বাংলাদেশের প্রতিবাদী বিভিন্ন সংগ্রামী নারী সংগঠন গুলো কেমন যেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছি। অনেকেই আছেন টক শো গুলিতে কথার ফুলঝুড়ি বাস্তবে কঠিন সময় গুলোতে কখনোই আমরা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে দেখিনা।
আমাদের পেশাজীবী নারী সংগঠন গুলোর ও তেমন অস্তিত্ব নেই দিব্য চোখে দেখা যায় না। পেশা জীবী নারীদের সম্মিলিত কোন সংগঠন নেই। যেখান থেকে নারীর প্রতি যেকোন সহিংসতায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যেকোন আক্রমণে সম্মিলিত ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করতে পারিনা।
"আমরা পুরুষ শাসিত" শুধু ঘরেই না কর্মক্ষেত্রেও পুরুষদের চোখে নারী অযোগ্য ক্ষমতাহীন কিন্তু নারীকে ক্ষমতা দিন দেখিয়ে দিবে সে কতোটা যোগ্য। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারী,বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, সংসদের মাননীয় স্পিকার নারী, প্রশাসনে নারী, পুলিশ প্রশাসনে নারী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীতে নারী, চিকিৎসায় নারী, সাংবাদিকতায় নারী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নারী, রাজনীতিতে নারী কর্পোরেট জগতে নারী কাজ করছে নিজ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে।
আপন মহিমায় মহিমান্বিত হচ্ছে তারপরও আমরা কি সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত অধিকার ভোগ করছি? পবিত্র সংবিধান প্রদত্ত অধিকার আদায় ও ভোগ করছি? নারীর প্রতি সব প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ সিডো মানছি?" আমার কন্যা সন্তানটিকে কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, রাস্তায়, গণপরিবহনে এবং বাড়িতে নিরাপত্তা দিতে পারছি? পুত্র নেই, কন্যা সন্তানের সম্পত্তি নিয়ে আমি কি উদ্বিগ্ন নই?
আমরা কি সমান অধিকার ভোগ করছি? কি পারিবারিক, কি রাজনৈতিক, কি অর্থনৈতিক, কোন জায়গায়ই নারী ভূমিকা তেমন নেই, তাকে জায়গা দেয়া হয় না কোন একটি প্রোগ্রামে, কার্যক্রমে নারীদের ব্যবহার করা হয়। সুসংবাদ হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরা বাবার সম্পত্তির অধিকার পেলো।
ধর্মীয় মাহফিলে শুক্রবারে ওয়াজের নামে নারীদের বিরুদ্ধে অশ্লীল ওয়াজ করে বিষোদ্গার করা হয়। যারা তাদের নিয়ন্ত্রণ করে তাদের নারী নির্যাতন,যৌতুক,বাল্য বিবাহ সম্পর্কে বয়ান করার নির্দেশ দেয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়ানক অবস্হা হলো নারী নির্যাতনও ধর্ষণের মতো ঘটনা। কোর্ট গুলোতে সবচেয়ে সহজ মামলা নারী নির্যাতন মামলা। কন্যা শিশুটি রক্ষা পাচ্ছেনা বাবার হাত থেকে, ভাইয়ের হাত থেকে, পরিবারের কাছে থেকে,শিক্ষকের হাত থেকে, হায়েনা দের হাত থেকে. একজন নারী ধর্ষিত হওয়ার পর শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে তার পরিবার, কোন কোন ক্ষেত্রে আদালত ধর্ষকের সাথে ঐ নারীর বিয়ের ব্যবস্থা করেন অবাক পৃথিবী অবাক তার মানুষেরা।
আমাদের মেয়েদের বিদেশে চাকুরির জন্য পাঠাচ্ছি, চাকুরির নামে তারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী নারী শ্রমিকসহ সকল শ্রমজীবী নারী শ্রমিকদের আমরা কতটুকু নিরাপত্তা দিচ্ছি?
বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা দিয়েছেন। নারীর ক্ষমতায়নের গৌরবের জায়গাটিতে তিনি নারীদের গর্বভরে বসিয়েছেন। জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার,বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করেছেন, এমপি করেছেন, রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে দিয়েছেন, বিচারপতি করেছেন, জেলা প্রশাসক করেছেন,পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করেছেন, বিভিন্ন পেশায় নারীদের সর্বোচ্চ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু আমরা অনেকেই রাজনৈতিক ভাবে দূর্বৃত্তায়নের শিকার, কেন আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিজেদের অপকর্মের জন্য সবার কাছে ছোট করাবো। আমরা ওনার কথা কখনো ভাবি দেশ, জাতি, তথা নারী উন্নয়নে তিনি কতোটা নিবেদিত প্রাণ। নারী স্বমহিমায় সৎ জীবনযাপন করি আজকের ২০২২ সনের নারী দিবসে এই হোক অঙ্গীকার।
আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক আমরা নারী নির্যাতন মুক্ত, ধর্ষণ মুক্ত, মাদকমুক্ত,দুর্নীতি মুক্ত, নির্লোভী, নারী পুরুষের বৈষম্য মুক্ত বাংলাদেশ চাই। দুমুঠো ভাত কাপড় নয়, নারী চায় তার যথাযোগ্য সন্মান ও মর্যাদা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব নারীদের জন্য নারী দিবসের সংগ্রামী শুভেচ্ছা।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
এইচআর/জেআইএম