জাতীয় স্লোগান হোক ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’
যার নির্দেশেই আজও আমরা এগিয়ে চলেছি একটি শোষিত বঞ্চিত জাতির সার্বিক মুক্তির দিকে। অবিভক্ত বাংলায় সেই মুক্তির ভিত রচিত হয়েছিল টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া খোকার হাত ধরেই। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বেড়ে ওঠা খোকা হয়ে উঠেছিলেন মুজিব। নিজের যোগ্যতা ও বাঙালি জাতির ভালোবাসায় মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। দেশপ্রেমের চেতনার অগ্নিমশাল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ। স্বাধীনতা ইতিহাসে এক মহান জাদুকর, মহান কারিগর। জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে ধ্বনিত বিপ্লবের সেই অমর কবিতার রচয়িতা।
জয় বাংলা, বাঙালি জাতিসত্তা, বাঙালির স্বাধিকার, বাঙালির স্বাধীনতা, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম,—যাই বলি না কেন? শব্দগুলোর অপর নাম বঙ্গবন্ধু। বিশ্বব্যাপী যেখানেই লুণ্ঠিত মানবতা, যেখানেই স্বাধীনতার সংগ্রাম, যেখানেই মুক্তির বাতাস সেখানেই অনুপ্রেরণা বঙ্গবন্ধু। এই বঙ্গবন্ধুই হলেন আমাদের জাতির পিতা।
তিনি সেই জাতির পিতা যে জাতিকে স্বাধীনতা এনে দেওয়ার জন্য করেছে দীর্ঘ সংগ্রাম। যার শুরুটা হয়েছিল ’৪৭ সালের ব্রিটিশ ভারত বিভাজন আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। ’৪৭ এ দেশ ভাগের পর পরই খোকা অনুধাবন করেন, প্রকৃতপক্ষে বাঙালিরা তাদের স্বাধীনতা পায়নি, শুধু তাদের প্রভু বদল হয়েছে। ইংরেজদের জায়গায় এসেছে পাকিস্তানিরা।
শেখ মুজিবের ডাকেই বাংলা জয়ের জন্য লড়াই করতে করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষ। বাংলার বিরুদ্ধে তখন পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র তুঙ্গে। প্রতিবাদী মুজিব সমগ্র জাতিকে বুঝাতে শুরু করলেন মাতৃভাষার গুরুত্ব। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, আমরা বাঙালি, আমাদের ভাষাও হবে বাংলা।
প্রস্তাব ক্রমে গঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ভাষার দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিল বঞ্চিত বাঙালিরা। গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। জনতার প্রতিবাদ ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো। জয় বাংলা, জয় শেখ মুজিব। শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ। বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর বাংলার মানুষের আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল শাসক গোষ্ঠী। তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার। সূচিত হয় বাংলা ও বাঙালির প্রাথমিক জয়। এই বিজয়ের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলে স্বাধীনতা লাভের আন্দোলন।
’৫২ থেকে ’৫৪ বাঙালির বিজয়ের আরও এক অধ্যায় সূচিত হয়েছিল এ সময়। পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে বাঁচতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের উদ্দেশ্যে গঠন হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। শিক্ষাবঞ্চিত মানুষকে শেখ মুজিব বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন শিক্ষার গুরুত্ব। চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চরম আন্দোলনের মুখে ’৬২ এর ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সরকার শরিফ কমিশন রিপোর্ট বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল।
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, শিক্ষা আন্দোলন নিঃসন্দেহে ইতিহাসের বাঁক ফেরানো ঘটনা। অভাগা জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্য যখন চরমে, তখন পূর্ব বাংলার জনগণকে উদ্ধার করতে ’৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সাধারণ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে শেখ মুজিব উত্থাপন করেছিলেন ছয় দফা। ছয় দফা দাবি দিয়েছিলেন ধীরে ধীরে চূড়ান্ত স্বাধীনতার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই। যাকে এক কথায় বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
অদম্য মহানায়ককে চিরস্থায়ীভাবে দমাতে ’৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার দায়ের করে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এমনকি, এসময় পেছন থেকে গুলি করে মারার চক্রান্ত হয়েছিল স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাকে। অভ্যুত্থান হলো বাংলায়। রূপ নিল গণঅভ্যুত্থানে। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন আইয়ুব খান। জাতি ধীরে ধীরে এগোতে থাকে স্বাধীনতার দিকে এক মহান নেতার নেতৃত্বে। লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসায় ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে উপাধি দেয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু’। জয় বাংলার সাথে জয় বঙ্গবন্ধু যুক্ত হয় মূলত ’৪৭ এর আগে। ধাপে ধাপে জয় বাংলার সৃষ্টা জয় বঙ্গবন্ধুর ব্যাপকতা দিনে পর দিন বাড়তেই থাকে। সারা বাংলায় প্রতিধ্বনিত হয় ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’।
৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। এ যেন যোগ্য পিতার কণ্ঠে অনাগত সন্তানের নাম। জয় বাংলার মধ্যেই অসামান্য কারিশমায় বঙ্গবন্ধু সব মুক্তিকামী মানুষকে একত্রিত করেছিল। কি আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল বাংলার মানুষের ওপর? ’৭০ সালের ২৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ মারা গেছে, স্বাধীনতার জন্য বাংলার আরও ১০ লাখ প্রাণ দেবে। ’৭০ এর নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়ে জয় বাংলা স্লোগানে সবাইকে আবদ্ধ করে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল বাঙালির অধিকারকে। বাঙালি কতটা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ তা প্রমাণিত।
তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সাধনা জয় বাংলা’র শক্তি। কি অসামান্য মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বাংলার মানুষকে? এ এমন এক মন্ত্র যা বাংলার মানুষের বুকের ভেতরে ক্ষত হওয়া দীর্ঘ প্রতিবাদের সফল হাতিয়ার, বাঙালিকে বাঙালি হিসেবে জেগে ওঠার কুদরতি হাতিয়ার। জয় বাংলা যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তা প্রবলভাবে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু সব আবেগ, অনুভূতি, নিঃশ্বাস, বিশ্বাস দিয়ে মুড়িয়ে নিয়েছিলেন বাঙালি জাতিকে। দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে বঙ্গবন্ধু বারবার বলতেন, বিশ্বের কোনো শক্তিই আর বাঙালির দাসত্ব-শৃঙ্খলে আটকে রাখতে পারবে না। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। এদিকে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জয় বাংলা স্লোগানে অধিকার আদায়ে প্রস্তুত পূর্ববাংলা। পূর্ববাংলা মুখরিত স্লোগানে স্লোগানে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।
’৭১ এর ২ মার্চ উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। জয় বাংলা ধ্বনিতে উদ্বেলিত বাঙালি। ০৩ মার্চ জাতীয় সংঙ্গীত, ‘আমার সোনার বাংলা’ পরিবেশনের মাধ্যমে পাঠ করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র। বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রতিদিন ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত পালিত হয় হরতাল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হতে থাকে পূর্ববাংলায়। বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা স্লোগানে অধিকারবঞ্চিত, নির্যাতিত আর নিপীড়িত বাঙালিকে এক করে হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির পিতা।
বাঙালি জাতির মুক্তি আর জয়ের মূলমন্ত্র হয়ে উঠে জয় বাংলা। জয় বাংলাকে বুকে ধারণ করে মৃত্যুকে সঙ্গী করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে সমগ্র জাতি। অপেক্ষায় থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের। তখন বঙ্গবন্ধুই যেন বাঙালি জাতির সরকার প্রধান। বঙ্গবন্ধুর সফল নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল, শ্রদ্ধাশীল সমগ্র জাতি। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় কণ্ঠে বারবার ভেসে ওঠে শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সময়ও কালেমা পাঠের সাথে জয় বাংলা উচ্চারণ করবেন। জয় বাংলা স্লোগানকে বঙ্গবন্ধু মুক্তিকামি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন আর বেঁচে থাকার অক্সিজেনে পরিণত করেছিলেন।
শত্রু মোকাবিলার সব প্রস্তুতি শেষ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে জয় বাংলাকে ধারণ করে সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েন মরণপণ যুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু জয় বাংলাকে এমনভাবে মুক্তিকামি বাঙালির রক্তের শিরায় শিরায় মিশিয়ে দিয়েছিলেন যা মারতে মারতে এবং মরতে মরতে বার বার উচ্চারণ করেছেন। জয় বাংলা এমনি এক শক্তিশালী হাতিয়ার। যাতে পরাভূত হয়েছিল পাকিস্তানের মতো কুখ্যাত জাতি। যার মধ্যে লুকায়িত ছিল বাঙালির মায়ের ভাষা, বাঙালির জাতীয়তাবাদ।
বঙ্গবন্ধু কারও একক সম্পদ নয়। যদি বঙ্গবন্ধু কারও একক সম্পদ হতো তাহলে ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে রাস্তায় নেমে আসতো না বাংলার জনগণ, যদি বঙ্গবন্ধু একটি দলের নেতা না হতেন তাহলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাঁর এক কথায় সারা বাংলার মানুষ অস্ত্র জমা দিত না। এখন কিছু মানুষ বলেন, জয় বঙ্গবন্ধু বললে নাকি কাউয়া নামের কুশীলরা বিভ্রান্ত হয়। যারা বঙ্গবন্ধু বলতে বিভ্রান্ত হয় তারা রক্তে মাংসে গড়া মানুষ হলে হতে পারে কিন্তু একজন খাঁটি বাঙালি বা দেশপ্রেমিক হতে পারবে না। জয় বঙ্গবন্ধু তাদের যারা বাংলার স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করে, যারা বাংলার ভূমিকে তাদের মা মনে করেন। জয় বঙ্গবন্ধু হলো বাংলার আপামর গণমানুষের।
বঙ্গবন্ধুর জয় বাংলায় গেঁথে আছে সেই সব নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের জয়। যারা বাংলার মাটি ও মানুষকে ব্রিটিশ, পাকিস্তানি আর এদেশীয় রাজাকার-আলবদরদের শোষণ-নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত করতে যুগ যুগ ধরে লড়াই করেছেন।
জয় বাংলা বললে জয় বঙ্গবন্ধু আসবেই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান আমাদের সবার অস্তিত্বের প্রতীক, একতার প্রতীক, আবেগ-অনুভূতির প্রতীক। জয় বঙ্গবন্ধু না বললে জয় বাংলা কোনোভাবেই সম্পূর্ণ হয় না। কিছু মানুষ আছে যারা জয় বাংলা বলে, কিন্তু জয় বঙ্গবন্ধু বলে না। কেন?
জয় বাংলা এবং জয় বঙ্গবন্ধু নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। যারা বলে না তারা কারা? যারা একেবারেই বিশ্বাস করে না তারা ’৭১ এর পরাজিত শক্তির বংশধর। অন্যদিকে কিছু বামপন্থি যারা ’৫২, ’৫৪, ’৬২, ’৬৬, ’৭১ এ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিল, করেছিল বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা। তাদের তখনও জয় বঙ্গবন্ধু বলতে ইতস্তত ভাব ছিল, এখনও।
স্বাধীনতার পর ন্যাপ, সিপিবি, জাসদ, বাম মোর্চা যারা বঙ্গবন্ধুকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেছে। ’৭৫ এর আগে ন্যাপ মোজাফফর এবং সিপিবি জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুতে ছিল মারাত্মক অ্যালার্জি, জাসদের তো ছিলই। ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর তারা স্লোগান দুটি বর্জন করে। জাসদ ’৭৫ এর আগে পরে অনেক দিন ভয়ানক মুজিববিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের সাথে আবার এখন যুক্ত হয়েছে তাদের প্রজন্ম। এই সমালোচনাকারী আর এদের প্রজন্মরা আবার বলে জয় বাংলা, জয় জনতা? এরা কি বুঝাইতে চায় আল্লাহই জানে? এই স্লোগানদাতারা জয় জনতা স্লোগান দিয়ে মূলত ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টাই করে যাচ্ছে আজীবন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে যে জঘন্য নির্মম হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয়েছিল, যার ফলে দীর্ঘসময় ধরে চলেছে ইতিহাস বিকৃতি আর ইতিহাস ভুলানোর চেষ্টা। এমনকি ২১ বছর মুখে আনা যায়নি বঙ্গবন্ধুর নাম। তাতে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল। জিয়া-খালেদা জিয়া আর ’৭১ এর পরাজিত শক্তির বংশধররা মিথ্যা রাজনীতিক মোহে বঙ্গবন্ধুকে কলঙ্কিত করেছে হাজারো মিথ্যাচারে। আমরা এমনই অভাগা জাতি মিথ্যাচারকে যাচাই না করে, গুজবে যাচাই না করেই কিছু মানুষ তাতে মেতে থাকি। এদের মিথ্যা দিয়ে আর ধর্মীয় অনুভূতি দিয়ে সহজে কাবু করা যায়। সেই কাজটাই করেছেন জিয়া, খালেদা আর ’৭১ এর পরাজিত শক্তি জামায়াত-শিবির। সেই মিথ্যাচার এখনো চলছে দেশ, বিদেশে।
’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে বাঙালি জাতির পিতা রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ আমাদের মাঝে এলেন আমাদের জাতির পিতা, বাংলার স্বাধীনতার ঘোষক। যার কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছিল এক মহান কবিতা। কোন এক অদৃশ্য জাদু ছিল সেই কবিতায়। যে কবিতাকে আজ স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। তিনি সেই মহান যাদুকর, যার ডাকে স্কুল পালানো ছেলেটি, পাড়ার মোড়ের দর্জি, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া যুবক, কিষাণ দিনমজুরসহ মাঠের লুঙ্গি পরা লোকটিও জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে কম্পিত করেছিল বাংলার রাজপথ আর যোগ দিয়েছিল মাতৃভূমিকে উদ্ধারের সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীনতা আলাদা কোনো শব্দ নয়। আলাদা নয় বাঙালি আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। আলাদা নয় ‘জয় বাংলা’ আর ‘জয় বঙ্গবন্ধু’।
যে মহানায়ক জয় বাংলার জন্য অজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, কী উচ্চারণ করেছিল ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটবিদ্ধ পিতার রক্তের প্রতিটি বিন্দু? যার প্রতিজ্ঞা ছিল, শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সময়ও কালেমার সাথে উচ্চারিত হবে জয় বাংলা। খুনিরা জানত না জয় বাংলা নামের অমর বাণীর প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু অমর। আমরা পারিনি পিতার অমর বাণীকে বুকে ধারণ করে পিতাকে অমর করতে। পারিনি বলেই আমরা হারাতে বসেছিলাম পিতার আদর্শ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা, বাংলা আমাদের দেশ। জয় বাংলা আমাদের ঐক্যের বন্ধন যার পিতা বঙ্গবন্ধু।
শুধু নয়টি মাস যুদ্ধেই অর্জিত হয়নি বাঙালির স্বাধীনতা। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘপথ পরিক্রমায় হাজারো চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে দুঃসাহসিক ভূমিকায় দ্বিধাহীন চিত্তে অগ্রসর হতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দুটি একাত্তরেই প্রথম আসে নাই। এ সময় স্লোগান দুটো আরও শক্তিশালী হয়েছে। বেড়েছে এর ব্যাপ্তি।
জয় বাংলা এসেছে ’৪৭ এর আগে থেকেই। যে জয় বাংলার স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু তার নামে স্লোগান দিলেই দেশের কিছু মানুষ ভাবে কট্টর আওয়ামী লীগ কর্মী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের নয়, সারা বাংলার। শিল্পী যেমন মনের মাধুরী দিয়ে এঁকে যায় তার শিল্প, তেমনি বঙ্গবন্ধু জয় বাংলার ভেতরে তিলে তিলে গেঁথেছেন ভাষা বঞ্চিত বাঙালির ইতিহাসের কথা, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, নেতৃত্ব দিয়ে ভাষা আদায়ের ইতিহাস।
গেঁথেছেন ব্রিটিশদের নির্যাতনের ইতিহাস, সেখান থেকে মুক্ত করার ইতিহাস। গেঁথেছেন নাপাক জাতির ’৪৮, ৫২, ৫৪,৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০, ৭১ নির্যাতনের করুণ ইতিকথা। গেঁথেছেন পিতা হিসেবে পরাধীন বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার সব জীবন্ত ইতিহাস। শুধু জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করলেই জাতির পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় না। স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয় না। আসুন সবাই সমস্বরে দাবি জানাই, আমাদের জাতীয় স্লোগান হোক ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কৃষি ও সমবায় উপ-কমিটি, সাংগঠনিক সম্পাদক বঙ্গবন্ধু পরিষদ।
এইচআর/ফারুক